আধুনিক কবি বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) তাঁর আধুনিক কাব্যরচনা করতে গিয়ে বারংবার ঋণী হয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে; তাঁর ব্যবহৃত শব্দ কাব্য এমন কী শীর্ষনাম ও বিষ্ণু দে তাঁর কাব্যে অহরহ ব্যবহার করেছেন, যেমন রবীন্দ্রনাথে ‘ঊর্বশী’ ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর ‘ঊর্বশী ও আর্ট মিস’ কাব্যে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ‘চোরাবালি’ কাব্যে ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ ব্যবহৃত হয়েছে ‘সন্দীপের চর’ কাব্যে। তার ‘দামিনী’ কবিতাটি (প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের ২৫ আষাঢ় তারিখে) বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ এর অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের নায়িকা হল দামিনী’ বাংলা উপন্যাসে সাহিত্যে ও নারীচরিত্রের বিবতর্নে ‘দামিনী’র ভূমিকা অপরিসীম, বাঙালি পাঠকের কাছে ‘দামিনী’ তিলে তিলে নূতন হোক’ বিঝুদের কাছেও দামিনী চির নতুন। দামিনী সম্পর্কে শ্রীনিবাস জানিয়েছে—“দামিনী যেন শ্রাবণের মেয়ের ভিতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ ; অস্তরে চঞ্চল অর্জুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছৌ রবীন্দ্রনাথ তাঁর দামিনী চরিত্রকে যেখানে সমাপ্তি দিয়েছেন—বিষ্ণু দে সেখান থেকেই তাঁর কবিতায় ‘দামিনী’কে শুরু করেছেন।

দামিনীর প্রেমের হাহাকার দিয়ে এ কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রকৃতির বুকে তার প্রতিস্থাপিত করে তার প্রেমের হাহাকার ও অতৃপ্তিকে সর্বব্যাপ্ত করে দিয়েছেন কবি—‘মিটিল না সাধ। শচীনের পিছনে বৃথাই ছুটে সে আজ ‘ক্লান্ত প্রাণ এক’ শেষ পর্যন্ত বিবাহ করেছে শ্রী বিলাস কে, কিন্তু বিবাহ হলেই তো তার প্রেম সম্ভাবিত হয় না আর তাই-ই সে হৃদয় দিয়ে বিলাসের সাথে ভরাট পূর্ণিমায় সমুদ্রের তীরে হাওয়া পরিবর্তনে এসে মৃত্যুর কোলে পৌঁছে দামিনী অনুভব করেছে-শ্রী বিলাসের ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে না পেরে সে অন্যায় করেছে। তাই সে প্রার্থনা করেছে পুনর্জন্ম । প্রেম পিপাসার্ত, প্রেম বুভুক্ষু দামিনী পরজন্মকে করে তুলতে চায় সার্থক পরজন্মে লবণাক্ত এই বিশাল পরিধিকে সে প্রেম পরিধি রূপেই পেতে চায়। সেই নবজন্মে সে পেতে চায় অগাধ পূর্ণিমার নীলিমা। উপন্যাসের শেষে দামিনী মন্তব্য ছিল—’সাধ মিটিল না, জন্মন্তের তারার যেন তোমাকে পাই? তার এই মন্তব্যের রেশ ধরে এই কবিতার সূচনা। যাই হোক-দামিনীর প্রেমতৃা এখন সঞ্চারিত হয়েছে কবি হৃদয়েও। প্রেমের জন্য কবির অন্তরও হয়েছে ব্যাকুল। দামিনীকে উদ্দেশ্য করে তাই কবি বলেন— 

আমার জীবনে তুমি বুঝি প্রত্যহই ঝুলন পূর্ণিমা।

মাসী বা ফাল্গুনী কিংবা বৈশাখী রাস বা কোজোগরী

এমন কী অমাবস্যা নিরাকরে তোমারই প্রতিমা

আমার ও মেটে না সাধ তোমার সমুদ্রে যেন মরি।

অর্থাৎ দামিনী তাঁর জীবনে প্রায় প্রত্যহই ঝুলন, অথবা মাসী বা ফাল্গুনী কিংবা বৈশাখী অথবা রাস। শুধু এক ঋতুতে নয়, প্রতি ঋতুতেই দামিনী তাঁকে জাগিয়ে রাখে। শুধু আলোতেই নয় অমাবস্যার রাত্রে অমানিশাতেও কবি তারই ধ্যান করেন, শত বিরহের মাঝে ও কবিকে দামিনী জাগিয়ে রাখে। দামিনীর দেহের সমুদ্রে ডুব দিয়ে প্রেমের অমূল্য রত্ন ভাণ্ডারকে সংগ্রহ করতে চান কবি ; ‘বন্য করে তুলতে চান জীবন-যৌবনকে। রহস্যময়ী দামিনীর রহস্যময় প্রেমকে শ্রীবিলাস-শচীশ ভয় পেলেও কবি ভয় পাননি। কবির জীবনরস উপভোগের একান্ত সহারী হয়ে উঠেছে এই দামিনী।