দামিনী কবিতাটির নামকরণ ও তার প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে ভাবনাটি প্রথমেই মনে আসে সেটি হল ‘দামিনী’ শব্দটির অর্থগত ব্যঞ্জনা। রবীন্দ্র পরবর্তী বেশ কিছু কবি অগ্রজের উত্তরাধিকারকে রক্ত-মজ্জার প্রবল অস্তিত্বে ধারণ করে চলবেন বলে পথে নেমেছিলেন। নজরুল ইসলামও এই সাধনার অনুবর্তী ছিলেন। তাঁর একটি গানের কথা কবিতাটির নামকরণের অর্থকে নতুনভাবে প্রাণিত করে।
গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে
কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে
চির সৌদামিনী রাধিকা।
শ্রাবণের ঘন কালো মেঘের মাঝখানে একফালি ধারালো আলো দামিনী। যার অর্থ বিদ্যুৎ। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিলাসে এই শ্রাবণের দুকূল ছাপানো নদী, কালো মেঘের মাঝে উজ্জ্বল আলোকের প্রতিবেশ পাঠকের খুবই পরিচিত। কালো মেঘের পরতে পরতে উজ্জ্বল শানিত আলোর নাম যেমন দামিনী ঠিক তেমনি শ্যামবর্ণ কৃষ্ণের সঙ্গে সদাপ্রেমময়ী রাধিকার উজ্জ্বল অবস্থানটিও দামিনীর মতোই মানব চক্ষুকে করে আলোকিত। রাধিকার প্রেমময়ী রূপের মতোই দামিনীর উদ্ভাসিত আলো। বিষ্ণু দে-র ‘দামিনী’ কবিতার ভাব ও অর্থগত ব্যঞ্জনায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’। এ উপন্যাসের নায়িকাও দামিনী। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রসৃষ্ট এই নায়িকা চরিত্র দামিনীই বিষ্ণু দে জীবন অনুসন্ধানী প্রেমের পূর্ণ প্রতিমা। ফলে দামিনীর অর্থ ও প্রকরণগত ব্যঞ্জনাটি ব্যাখ্যা করতে হলে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি সর্বাগ্রে স্মরণীয়। ‘চতুরঙ্গে’ বিধবা নায়িকা দামিনী সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভিতরকার দামিনী বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠেছে।” প্রেম পিপাসার্তা এই নারী প্রেমের পূর্ণতায় জীবনকে অভিজ্ঞ করতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল মৃত্যুময় উপত্যকাতে। সেখান থেকে ফিরবার তার আর কোনো পথ ছিল না। শচীশকে প্রিয়জ্ঞানে কাছে পেতে চেয়ে সে শ্রীবিলাসের প্রেমকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দেয়নি। আবার জীবনের উপাত্তে পৌঁছে শ্রীবিলাসের প্রতিদানহীন ভালোবাসাকে অনুভব করে পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্যই তার জন্মান্তর কামনা।
বিষ্ণু দে দামিনীর এই প্রেমপিপাসু নারী সত্তার আর্তি সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। চিরন্তন প্রেমিকা রমণীর প্রতিনিধি হয়েও দামিনীকে আমরা বিদ্রোহিনী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেছি। সমাজের নির্মম শোষণ ও নিপীড়নের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত দামিনী গুরুর শুষ্ক নিয়মসর্বস্ব বিধানকে একমাত্র বলে মেনে নেয়নি। লীলানন্দের আশ্রমে শচীশকে দেখে তার মধ্যে প্রেমের যে অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে তাকে সে গোপনও রাখেনি কখনও। কিন্তু শচীশের প্রত্যাখ্যান যখন সে পেয়েছে তখন সে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে। অবশ্যই সেই বিদ্রোহের স্বরূপ সামাজিক অবস্থান থেকে শচীশকে কখনও নামিয়ে আনেনি। বরং শচীশকে গুরুপদে বরণ করে শ্রীবিলাসকেই বিবাহ করেছে সে। কিন্তু প্রেমের পূর্ণতায় শ্রীবিলাসকে আশ্রয় করে পরিপূর্ণ জীবন-যাপনের স্বপ্নকে সে সত্যি করে তুলতে পারেনি কখনও। তাই পুণর্জন্ম চেয়েছে দামিনী। আকণ্ঠ জীবনতৃষ্ণা বুকে চেপে রেখে বলেছে ‘সাধ মিটিল না’।
রবীন্দ্রনাথের দামিনীর এই প্রেম চিন্তাই সঞ্চারিত হয়ে গেছে কবি বিষ্ণু দে-র মনে। প্রেমকে জীবন দিয়ে অনুভব করে তাকেই চিরজাগ্রত করে রাখবার সাধনাই দামিনীর সাধনা। বিষ্ণু দে-র এই ভাবনাকে মনে রেখেই অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “দামিনী কবির চোখে দেহ ও প্রেমবাসনার এক দীপ্ত আধার হয়ে ওঠে। যে সমুদ্রের তীরে দামিনীর বিলাপ, সেই সমুদ্রই দামিনীর মধ্যে লীন হয়েছে।” জীবনরসে রসিক দামিনীর চির আকাঙ্ক্ষিত প্রেম যেন সময়প্রতিমা হয়ে বিষ্ণু দে-র চিত্তকে আন্দোলিত করেছে।
আসলে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগণের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন নারীত্বের নমনীয় সংজ্ঞাটিকে ভেঙে ফেলে তাকে প্রেমের বীর্যে অশঙ্কিনী করে গড়ে তুলতে। মেঘের ভিতরকার সেই অশঙ্কিনী মূর্তি দামিনী। বুদ্ধিগত প্রেমেরও অন্য প্রতিনাম দামিনী। আবার চিরন্তনী প্রকৃতির মাধুর্যে ভরা প্রেমের যে প্রকাশ তারও প্রকাশ রূপ দামিনী। বিষ্ণু দে র কবিতায় দামিনীর তাৎপর্য শুধু আপামর নারীর প্রেমধর্মের রূপকে আশ্রিত। কারণ বিষ্ণু দে দামিনীর বিশেষ বা ব্যক্তিক প্রেমের সীমাভূমি স্পর্শ করেই নির্বিশেষ প্রেমের অরূপলোকে পৌঁছে গেছেন। দামিনী তাই কবি চেতনায় চিরন্তন বিরহক্লিষ্টা নরনারীর প্রতীকী আশ্রয়। প্রেমের পূর্ণস্বরূপে পৌঁছাবার জন্যই যার বাঁচা ও মরা। প্রাত্যহিক মানবজীবনের সব হারানোর শূন্যতার মাঝে রবীন্দ্রঐতিহ্যের সমগ্রতার প্রতীক দামিনী। তাকে আশ্রয় করেই সভ্যতার বিকাশের মন্ত্রণাপর্বে উত্তরাধিকারের আর্তি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে নিয়েছে। দামিনী তাই বিষ্ণু দের রবীন্দ্র উত্তরাধিকারের একটি ধারাবাহিক প্রতীক আশ্রিত ভাবনা—একথা বলাই যায়।
“অন্ধ, খুঁজি চেনা মুখ যার পরণে ঢাকাই শাড়ি
কপালে সিঁদুর, ধলেশ্বরী
কোথায় শুকতারা অন্তরঙ্গ সেই আশাবরী!”
Leave a comment