বিংশ শতকের ত্রিশের দশকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি বিষ্ণু দে ছিলেন মূলত মননশীল। তাঁর কাব্যে আবেগের পরিবর্তে বুদ্ধির প্রাধান্য অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। এরূপ একজন কবি ব্যক্তিত্ব যখন শতাব্দী প্রাচীন পূর্বসূরী এক কবির সম্পর্কে আলোচনার নিয়োজিত হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে কৌতুহল জাগে। ঈশ্বর গুপ্ত যুগসন্ধির কবি, সাময়িকতার কবি ; তবুও তাঁর মধ্যে এমন কোন চিরন্তন প্রতিভা বিষ্ণুদের মতো শিক্ষিত মার্জিত রুচিসম্পন্ন কবি আবিষ্কার করে ছিলেন, তা ভেবে দেখার বিষয়।

প্রবন্ধের শুরুতেই বিষ্ণু দে ঈশ্বর গুপ্তের সামাজিক প্রেক্ষাপটটি আলোচনা করেছেন। ১৭৫৮ সালে পলাশির যুদ্ধের পর এদেশে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হতো সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয় মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায় তাদের চিরাচরিত ধ্যানধারণা দূরে সরিয়ে রেখে ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির অনুকরণে ব্রতী হয়। ঠিক এই যুগসন্ধির সময়কালে দাঁড়িয়ে ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন।

ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মূল্যায়ন সর্বতোভাবে সমর্থন করেছেন বিষ্ণু দে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন “মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির কবি, ঈশ্বর গুপ্ত বাঙালির কবি, বাংলার কবি।” বিষ্ণু দে এই মন্তব্যকেই অনুসরণ করে বলেছেন ঈশ্বর গুপ্ত “খাঁটি বাঙালি কবি”। তিনি আরও বলেছেন শিক্ষিত বাঙালি কবি এবং খাঁটি বাঙালি কবির মধ্যে দূর্লঙ্গ ব্যবধান। যারা খাঁটি বাঙালি কবি তাদের সঙ্গে জনসমাজের নিবিড় যোগ থাকে, আর যারা শিক্ষিত বাঙালি কবি তারা বাঙালি সংস্কৃতির উচ্চচূড়ায় বসে থাকতে পারেন, কিন্তু দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না। অথচ দেশীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে ছাড়া কখনোই দেশীয় সংস্কৃতি পূর্ণতা পায় না।

দেশীয় ঐতিহ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য বাস্তবতা। এই বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায় মধ্যযুগের সাহিত্যে, লোকশিল্প এবং লোকসাহিত্যে। আধুনিক সাহিত্যে যে ভাববিলাস বা ভাবালুতা সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে তা শিক্ষিত বাঙালির বিশেষত্ব হতে পারে কিন্তু সাধারণ বাঙালির নয়। আজকের শিল্প সাহিত্যে বাংলার এই ঐতিহ্য অর্থাৎ সাধারণের কথা লুপ্ত হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর সমগ্র কবি জীবনে এই ঐতিহ্যটাকেই ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তাই তাঁর কবিতায় সমকালীন ঘটনার ছায়াপাত আছে। দুর্ভিক্ষ নীলকরদের অত্যাচার, শিখ যুদ্ধ, বিবাহ বিবাহ, নারীশিক্ষা এবং এমনকি বাঙালির রসাল পরিতৃপ্তির উপাদান হিসেবে আনারস, পাঁঠা, তোপসে মাছ প্রভৃতির বর্ণনা রেখেছে। বিষ্ণু দে যে অনুসরণ করে আমরা ঈশ্বর গুপ্তের এই বাস্তব সচেতনতার কিছুটা পরিচয় গ্রহণ করব।

আজকের বাঙালি ভুলেছে বাংলা নববর্ষের কথা। বহুদিন পূর্বে ঈশ্বর গুপ্ত ইংরেজি নববর্ষের সম্পর্কে লিখেছিলেন—

“খৃষ্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর।

প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।।”

ইংরেজি নববর্ষে খ্রীস্টানরা আনন্দে মাতবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার সঙ্গে বাঙালি নারীরা যদি (পুরুষ তোবটেই) অংশগ্রহণ করে এবং মধ্য পান করে তাহলে তা দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে বৈকি। ঈশ্বর গুপ্ত তাই বাঙালি নারীদের ব্যঙ্গ করে লিখলেন—

“শাড়ী পরা এলোচুল আমাদের মেম

বেলাক নেটিভ লেডি সেম, সেম, সেম্

সিন্দুকের বিন্দু সহ কপালেও উল্কি

নসী, যশী, ফেমী, বামী, যামী, সামী গুলি”

সংবাদ প্রভাকরের পৃষ্ঠায় বিরোধ বিবাহের স্বপক্ষে অনেক কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তিনি বোধহয় এই বিষয়টাকে মেনে নিতে পারেননি। আসলে সমাজের দ্রুত পরিবর্তন তাকে কিছুটা বিচলিত করেছিল। তাই তিনি তাঁর কবিতার বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। নারী শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর একটি ব্যঙ্গ কবিতার পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল—

“লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল/তারাই এখন চড়বে ঘোড়া

আর কি এল তাদের করে পিড়ি পেতে অন্ন দেবে

পর্দা তুলে ঘোমটা খুলে

সেজে গুজে সভায় যাবে।”

রসনাতৃপ্ত বাঙালির পরিচয় দিয়েছেন নানান কবিতায়। এরূপ একটি কবিতা ‘পাঠা’—

“রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।

তুমি যাও পেটে যাও সেই পুণ্যবান 

তুমি সাধু, সাধু তুমি ছাগীর সন্তান”

কবিত্বের বিচারে তাঁকে কখনোই প্রথম শ্রেণির কবি বলা চলে না। কবিতার রূপনির্মিতেও তিনি সচেতন ছিলেন না। তাঁর কবিতার মধ্যে রুচীর দোষও ঘটেছে। কিন্তু তাঁর কবিতার মতে সমকাল যেভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে তা আজ কাজের মধ্যে নেই। বাস্তবতা যদি আধুনিক সাহিত্য ধারার ভিত্তি হয় তাহলে ঈশ্বর গুপ্ত যে আধুনিক কবিদের গুরুস্থানীয় তা শিকার করে নিয়েছেন বিষ্ণু দে।