‘বিষাদ-সিন্ধু’কে বাঙালি মুসলমান সমাজের মহাকাব্য বলা হয় কেন?

উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের চর্চায় যে ক-জন মুসলিম সাহিত্য সাধক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) সর্বাধিক খ্যাতিমান। তবে, তাঁর খ্যাতির মূল উৎস ‘বিষাদসিন্ধু’ (রচনাকাল ১৮৮৫-১৮৯১) গ্রন্থটি। বাঙালি সমাজে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বলতে মীর মশরারফ হোসেন এবং মীর মশাররফ হোসেন বলতে ‘বিষাদ-সিন্ধু’কে বুঝাত। কালজয়ী রচনা ‘বিষাদ-সিন্ধু’র শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তির মূলে আছে গ্রন্থটির অপূর্ব ভাষাশৈলী, মানবিক আবেদন, আকর্ষণীয় গল্পরস, নানাবিধ চরিত্রের মহাসমাবেশ এবং সমকালের চাহিদা প্রভৃতি।

‘বিষাদ-সিন্ধু’কে বাঙালি মুসলমান সমাজেরমহাকাব্য বলার কারণ: : ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ এর কাহিনির মতো মুসলমান সমাজেও মহররম তথা কারবালা কাহিনি বহুল প্রচারিত। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’কে কেন্দ্র করে প্রচুর গ্রন্থ রচিত না হলেও বহু মুসলমান কবি-সাহিত্যিক এর থেকে প্রেরণা নিয়ে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে ‘বিষাদসিন্ধু’র জনপ্রিয়তার একটি বিশেষ কারণ গ্রন্থটির কাহিনিগত দিক। হজরত মুহাম্মদ (স) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হাসান-হোসেনের বিষাদময় মৃত্যু কাহিনি স্বভাবতই মুসলমানদের অন্তরকে গভীর ভাবে শোকার্ত করে তোলে। একারণেই বাংলাদেশে এক সময়ে ‘জঙ্গনামা’ শ্রেণির কাব্য শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সর্ব শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ঘটনাটির হৃদয়বিদারী শোকাবহ পরিণতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত হয়েছে মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কারবোধ দুই ধারার মিলিত প্রবাহ সহানুভূতিশীল পাঠকের অন্তরকে কী বিপুল পরিমাণে আবেগমণ্ডিত করতে সক্ষম, সার্থক শিল্পীর রচনা ‘বিষাদসিন্ধু’ই তার প্রমাণ।

মীর মশাররফ হোসেন এর পূর্বে এ দেশীয় মুসলমানদের রচনা ‘মুসলমানী শব্দ’ দ্বারা অনেক বেশি জর্জরিত ছিল। মুসলমানী বিষয় হলেও ‘বিষাদ-সিন্ধু’তে তিনি বিশুদ্ধ বাংলারই চর্চা করেন। ভাষার ক্ষেত্রে এ ঐতিহাসিক পদক্ষেপের কারণে শিক্ষিত হিন্দু সমাজ এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও মশাররফ হোসেন এর ভাষার প্রশংসা করেন। ফলে তাঁর ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনা সর্বমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়। মিথের আশ্রয়ে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা একাধারে দেব-দেবীর মহিমা প্রচার করতো বা পূজা করতো এবং অন্যদিকে সাহিত্য রসও আস্বাদন করতো। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচিত হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি মুসলিম সমাজ পেয়েছিল তাদের আরাধ্য মিথ ও কাহিনি। ‘বিষাদসিন্ধু’র সাহিত্য রস, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য (নতুন সাংস্কৃতিক খোরাক) ও ধর্মীয় পুণ্যলাভের তৃপ্তি এ গ্রন্থকে সাধারণ মুসলিম সমাজে করে তুলেছে অশেষ জনপ্রিয়। ‘বিষাদসিন্ধু’র রচনারীতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষণীয়- প্রথম সুযোগেই অবিলম্বে পাঠক চিত্তের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার যোগসূত্র স্থাপনে লেখক দারুণভাবে আগ্রহী। এ আত্মীয়তা স্থাপনের ফলে অতি সহজেই স্বয়ং পাঠক সমগ্র কাহিনির অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে আরো কারণ ছিল বাঙালির গল্প শোনার প্রবণতা। বাঙালি সমাজ চিরদিনই রূপকথার মোহে আচ্ছন্ন ছিল-যা তারা আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছিল ‘বিষাদসিন্ধু’র মধ্যে।

বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থের প্রকরণ প্রকৃতি বিচারে সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারও মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। কেউ মনে করেন, এটি গদ্যে লেখা মহাকাব্য। ‘বিষাদ-সিন্ধু’র স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর সঙ্গে মহাকাব্যিক কাঠামো ও বিষয়ের সাদৃশ্য রয়েছে। স্বয়ং লেখক এজিদ বধ পর্বের অন্তিম প্রবাহে একে ‘মহাকাব্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া এরিস্টটল মহাকাব্যের যেসব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন ‘বিষাদ-সিন্ধু’তে সেসবের বেশ কয়টি লভ্য। এরিস্টটল মহাকাব্যের আদি-মধ্য-অন্ত এ ত্রিস্তর বিশিষ্ট যে অবিচ্ছিন্ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কাহিনির উল্লেখ করেছেন তা ‘বিষাদ-সিন্ধু’র তিনটি পর্বের (মহররম, উদ্ধার, এজিদ বধ) গাঢ়বদ্ধ কাহিনি বিন্যাসের মধ্যে পাওয়া যায়। এজিদ চরিত্রের উত্থানের মধ্য দিয়ে কাহিনি শুরু আর তার অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি।

উপসংহার: ‘বিষাদ-সিন্ধু’র বিস্ময়কর রচনা গুণ মশাররফ হোসেন-এর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার কারণ, বস্তুত এ কারণে সুদীর্ঘকাল যাবৎ সমগ্র দেশব্যাপী পাঠক সাধারণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অম্লান রয়েছে। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনাতে একাধারে কাহিনির ঐতিহাসিকতা, ঘটনার বিষাদময় মুহূর্ত, কাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে শুদ্ধ বাংলা শব্দের ব্যবহার, রূপকথার হাতছানি প্রভৃতি ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনাকে জনপ্রিয় এবং কালজয়ী করে তুলেছে। তাই ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনাকে বাঙালি মুসলমান সমাজের মহাকাব্য বলা হয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।