সূচনা: সাধারণত বিশেষ কোনাে অঞ্চলে সংঘটিত কোনাে ঘটনা বা চরিত্রকেন্দ্রিক কাহিনি যা সেই অ্যলের মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় মনে। রাখে এবং বিশ্বাস করে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করে, তাকে কিংবদন্তি বলে। মৌখিক ইতিহাসে এক প্রধান উপাদান হল কিংবদন্তির কাহিনি বা বীরগাথা (Legends)।
শ্রীকৃষ্ণ: ভারতের কয়েকটি কিংবদন্তি (Legends) চরিত্রের মধ্যে মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র উল্লেখযােগ্য। মহাকবি ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে পাণ্ডব ও কৌরব পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে অষ্টম অবতার ছিলেন কৃষ্ণ। যদুবংশে তার জন্ম। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় কৃষ্ণ বলেছেন যখন ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে তখন আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। বৈদিক সাহিত্যের ঋষি কৃষ্ণ ও মহাভারতের রাজনীতিবিদ যােদ্ধা কৃষ্ণ, গীতার দার্শনিক কৃষ্ণ, বৈয়বদের প্রেমাস্পদ কৃষ্ণ এবং পৌরাণিক কৃষ্ণ মিলেমিশে ভারতীয় পৌরাণিক কৃয় চরিত্রটি বিভিন্ন অবতার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
রামচন্দ্র: অযােধ্যার সূর্যবংশীয় রাজা দশরথের তিন রানির মধ্যে কৌশল্যার গর্ভজাত রাম ছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র। অযােধ্যার সিংহাসনে রামের অভিষেকের পূর্বে দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রী কৈকেয়ী পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার কাছে দুটি বর প্রার্থনা করেন। এক বরে তিনি ভরতকে সিংহাসন দান এবং অপর বরে তিনি রামচন্দ্রের চোদ্দো বছরের বনবাস জীবন দাবি করেন। রাজসিংহাসন ছেড়ে পত্নী সীতা ও ভ্রাতা লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে রামের বনবাস যাত্রা, রাবণের বিরুদ্ধে রামের জয়লাভ এবং সীতাকে উদ্ধারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
গ্রিসের কিংবদন্তি বা লেজেন্ডসমূহ
হারকিউলিস: প্রাচীন গ্রিসের কিংবদন্তি চরিত্রের মধ্যে অন্যতম হল হেরাক্লেস (Heracles)। রােম-সহ পাশ্চাত্য দেশগুলিতে এই চরিত্রটি হারকিউলিস নামে পরিচিত। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী হারকিউলিস ছিলেন গ্রীসের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। তিনি ছিলেন দেবরাজ জিউস-এর পুত্র। তার মা ছিলেন আক্লমিনা। মিনিয়দের সঙ্গে যুদ্ধে পারদর্শিতা দেখানােয় রাজকুমারী মেগারা তাকে বিয়ে করেন। অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় তিনি নিজের স্ত্রী-পুত্রদের হত্যা করেছিলেন। দানব অ্যান্টিউসের বিরুদ্ধে, নদী দেবতা অ্যাকিলাসের বিরুদ্ধে এবং ট্রয়ের যুদ্ধে তিনি তার বীরত্বের পরিচয় রাখেন।
প্রমিথিউস: প্রাচীন গ্রিসে আর একটি কিংবদন্তি চরিত্র হল প্রমিথিউস। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী প্রমিথিউস ছিলেন টাইটান গােত্রের এক দেবতা। টাইটান দেবতা ইয়াপেতুস ও ওশেনিড ক্লাইমেনের সন্তান ছিলেন প্রমিথিউস। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী তিনি ছিলেন মানুষের স্বচ্ছ উপকারী বন্ধু। গ্রিক দেবতারা প্রমিথিউস ও তার ভাই এপিমেথিউসকে মানুষের জীবনধারণের সকল প্রয়ােজনীয় উপাদান সরবরাহের আদেশ দেন। পাশাপাশি প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রমিথিউস এগিয়ে আসেন। মানুষকে অন্য প্রাণীদের থেকে শ্রেষ্ঠ করে তােলার জন্য তিনি তাদের অর্থাৎ মানুষদের সােজা হয়ে হাঁটতে শেখান। পাশাপাশি স্বর্গে গিয়ে সূর্যের কাছ থেকে মশাল জ্বালিয়ে আগুন এনে তিনি মানুষকে উপহার দেন। তার এই কাজে ক্ষুধ হয়ে দেবতা জিউস প্রমিথিউসকে পাহাড়ের সাথে বেঁধে রেখে নির্মম অত্যাচার চালান। জিউসের প্রতীক একটি ইগল এসে রােজ প্রমিথিউসের হৃৎপিণ্ড খেয়ে যেত আর প্রমিথিউসের নতুন আর একটি হৃৎপিণ্ড তৈরি হত। শেষে হারকিউলিস ইগলরূপে জিউসকে তাড়িয়ে প্রমিথিউসকে মুক্ত করেন।
ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি বা লেজেন্ডসমূহ
রবিন হুড: ইংল্যান্ডের লােককাহিনির এক জনপ্রিয় কিংবদন্তি চরিত্র হল রবিন হুড। রবিন হুড ছিলেন একজন ডাকাত। তিনি অত্যন্ত দক্ষ তিরন্দাজ ও অসি যােদ্ধা ছিলেন। ত্রয়োদশ/চতুর্দশ শতকের এই চরিত্রটি গরিবের বন্ধু হিসেবে পরিচিতি পান। রবিন হুড কিছু অনুগামী ডাকাতদের নিয়ে ম্যারিম্যান নামের একটি দল গড়ে তােলেন। এই দলের সদস্যরা ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ধনসম্পদ লুট করে গরিবদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন। রবিন হুড ও তার অনুগামীরা লিঙ্কন (ইংল্যান্ডের লিঙ্কনে তৈরি একধরনের ঝলমলে সবুজ রঙের কাপড়) বস্ত্র পড়ত। কথিত আছে রবিন হুড ও তার দল ম্যারিম্যানের সদস্যরা নটিংহ্যামশায়ারের শেরউড জঙ্গলে বাস করতেন। প্রথম জীবনে তিনি একজন মধ্যচাষি বা জমিদার ভৃত্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অসাধু এক শেরিফ (শহরের আইনরক্ষক)-এর দ্বারা জমিচ্যুত হলে ডাকাত হয়ে ওঠেন।
সুমেরীয় কিংবদন্তি বা লেজেন্ডসমূহ
গিলগামেশ: প্রাচীন সুমের সভ্যতার এক অন্যতম কিংবদন্তি চরিত্র হল গিলগামেশ। সুমেরীয়, আক্কাদীয়, আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় পুরাণ মিলিতভাবে মেসােপটেমীয় পুরাণ নামে পরিচিত। এই মেসােপটেমীয় পুরাণের এক অন্যতম চরিত্র গিলগামেশ। গিলগামেশ মহাকাব্যে এই চরিত্রটির বর্ণনা মেলে। কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা এই মহাকাব্য থেকে জানা যায় যে, গিলগামেশ ছিলেন উরুক রাজ্যের রাজা। গিলগামেশের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল। দেবসত্ত্বা এবং এক-তৃতীয়াংশ ছিল মানব সত্ত্বা। গ্রিক বীর ইউলিসিস এবং আরবীয় নাবিক সিন্দবাদের মতাে গিলগামেশও পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণ করেছিলেন।
উপসংহার: কিংবদন্তি চরিত্রগুলি নিজ নিজ দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচায়ক।
Leave a comment