বিশ্বায়ন বলতে কেবল আন্তর্জাতিক সংযোগ-সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়ার কথা বলা হয় না। কারণ আন্তর্জাতিক সংযোগ ও মিথষ্ক্রিয়া বহু আগেও ছিল। হাজার হাজার বছর আগেও মানুষ এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় বসবাস করত। সেই সুপ্রাচীনকালেও পরিযান ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে দূর-দূরান্তের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি ও সংরক্ষিত হত। এ ধরনের সংযোগের সুবাদে জ্ঞান ও নব নব আবিষ্কার নতুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দীপনার সৃষ্টি হত। সমকালীন বিশ্বে বাণিজ্যপক্ষগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অধিবাসীদের মধ্যে অপরোক্ষ সংযোগের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংযোগ-সম্পর্ককে বিশ্বায়ন বলা হয় নি, বা বিশ্বায়ন বলা যায় না। এর পিছনে কারণ আছে।
প্রাচীন কালের সংযোগ-সম্পর্ক এবং আধুনিক কালের বিশ্বায়ন অভিন্ন নয়, ভিন্ন। প্রাচীন কালের সংশ্লিষ্ট সম্পর্কসমূহ ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল, কিন্তু মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই সমস্ত সম্পর্ক ছিল নিতান্তই অগভীর, পাতলা ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াহীন। কিন্তু আজকের দিনের বিশ্বায়নের সম্পর্কজনিত ঢেউ অনেক বেশী গভীর। বিশ্ববাপী অসংখ্য মানুষের মধ্যে আজকাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর সংযোগ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বাবাসীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দূরদূরান্তের সম্পর্ক নয়। আজকের এই সম্পর্ক ব্যবসা-বাণিজ্যিক, কূটনীতিক বা মিশনারী পথে সৃষ্ট নয়। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষজন আজকাল সরাসরি বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে পরস্পরের পাশাপাশি আসছে। দুনিয়াজুড়ে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এক ব্যাপকতর ও জটিলতর সম্পর্কের জাল তৈরী হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভ্রমণ, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি।
বিশ্বায়নের ধারণা
বিশ্বায়নের ব্যাপারে আগ্রহের আতিশয্য বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে দেখা যাচ্ছে। অথচ আজও ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রক্রিয়া, নীতি, বাজার-কৌশল, অবস্থা এবং এমন কি মতাদর্শের অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বস্তুত বিশ্বায়ন হল একটি অস্বচ্ছ ও ব্যাপকভাবে অর্থবহ ধারণা। বিশ্বায়ন কোন একক প্রক্রিয়া নয়; এ হল বিবিধ প্রক্রিয়ার এক জটিল যৌগ। প্রক্রিয়াসমূহ অধিক্রমণমূলক ও পরস্পর সংবদ্ধমূলক সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ে; আবার অনেক সময় প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিরোধিতামূলক বা প্রতিবাদমূলক। এই কারণে বিশ্বায়নের কোন সরল সংজ্ঞা প্রদান সহজ নয়। বর্তমানে বিশ্বায়ন কোন বিমূর্ত ধারণামাত্র নয়। এ হল এক সামগ্রিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী বহমান।
অনেকে বিশ্বায়ন বলতে ‘সীমারেখাহীন বিশ্ব’ (borderless world) এর কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সীমারেখার মত রাজনীতিক সীমার প্রবেশ্যতার কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি দেশ-কাল ভেদে মানুষের মধ্যে সাবেকি বিভাজনের ধারণার গুরুত্বহীন ও ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রাসঙ্গিকতার কথা বলা হয়েছে। এই কারণে অনেকের অভিমত অনুসারে বিশ্বায়ন মানুষের মধ্যে জাতি ও রাষ্ট্রের সীমাতিক্রান্ত সম্পর্কের সঙ্গে সংযুক্ত। এ হল সামাজিক আয়তনের এক নতুন বাহ্যিক নকশা। এর মধ্যে অঞ্চলের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংযোগ-সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান পরিধি সকল রকম সীমারেখাকে অতিক্রম করে যায় এবং আন্তমহাদেশীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা হয় যে, এখন কমপিউটারের একটি বোতাম টিপলে বৈদ্যুতিন টাকা (electronic money) বিশ্বব্যাপী তরঙ্গায়িত হয়ে যায়। অর্থাৎ বিশ্বের কোথাও আর্থনীতিক কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে টাকাকড়ি ও অন্যান্য বৈত্তিক বাজারসমূহ তৎক্ষণাৎই প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে। অনুরূপভাবে ক্যাবল (Cable) ও উপগ্রহ প্রযুক্তির মাধ্যমে টেলিফোনের বার্তা ও টেলিভিসনের অনুষ্ঠান সমগ্র দুনিয়ায় নিমেষেই পৌঁছে যায়।
পরিবহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। তারফলে ভৌগোলিক ব্যবধান বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, উপগ্রহ-ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইন্টারনেট প্রভৃতি উদ্ভাবনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর জাতিরাষ্ট্রসমূহের সাবেকি একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ এখন আর নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভ্রমণ-ব্যবস্থা (tourism)-র অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। তার ফলে মানুষ এখন দেশ-দেশান্তরে যাচ্ছে। গণ-মাধ্যমসমূহের সুবাদে মানুষ এখন সহজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। তারফলে মানুষের জীবনচর্চা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও ব্যক্তিগত স্বার্থসমূহের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। চাকরি-বাকরি, চুক্তি ও আনুষঙ্গিক কারণসমূহের জন্য মানুষ দেশে-বিদেশে বিদেশী কোম্পানীসমূহের উপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তারফলে জাতীয় সত্তা, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্য ও পরিচয় সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা ব্যাপক প্রকাশ ও প্রচার পায়।অধ্যাপক ডেভিড হেল্ডের অভিমত অনুযায়ী তথ্যাদির বিশ্বায়ন সাধারণ কোন মানবিক উদ্দেশ্য সাধন করে না; বরং স্বাতন্যের গুরুত্বকেই তুলে ধরে। তারফলে নিজেদের রাষ্ট্র ছাড়াই মানুষ নতুন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়।
বিশ্বায়ন হল বিভিন্ন দিক থেকে পারস্পরিক সংযোগ সম্পর্কের এক জটিল ঢেউ। এর অর্থ হল মানুষের জীবনধারা ক্রমবর্ধমানভাবে দূরবর্তী ঘটনাসমূহের দ্বারা এবং দূরবর্তী জায়গায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের কেন্দ্রীয় বিষয় হল যে, ভৌগোলিক দূরত্বের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস পাচ্ছে। এবং জাতি-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক সীমারেখা ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে। বিশ্বায়ন বলতে একথা বোঝায় না যে, স্থানীয় ও জাতীয় বিষয় বিশ্বপর্যায়ের বিষয়ের অধীন। বরং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় রাজনীতিক প্রক্রিয়ার বিস্তার ও গভীরতার উপর জোর দেওয়া হয়। এর অর্থ হল স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও বিশ্ব-ঘটনাসমূহ অবিরত পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া (interaction)-র অধীন।
সমাজবিজ্ঞানীরা আর্থ-রাজনীতিক ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় বিশ্বায়নের ধারণাকে বিভিন্ন দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অনেকের অভিমত অনুযায়ী বিশ্বায়ন হল ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরবর্তী কালের সাম্রাজ্যবাদী অভিব্যক্তি। আবার অনেকের মতে এ হল ‘লগ্নী পুঁজির বিশ্বায়ন’। এডওয়ার্ড এস. হারম্যান-এর মতানুসারে বিশ্বায়ন হল একটি সংযুক্ত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া দেশীয় সীমানা ছাড়িয়ে শিল্প নিগম (Corporation)-এর সম্প্রসারণ এবং আন্তঃসীমামূলক আর্থনীতিক সুবিধা ও সম্পর্ক বিষয়ক। এই প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হচ্ছে এবং পরিণত হচ্ছে। অধ্যাপক ফ্রানসিস চেরুনিলম (Francis Cherunilam)-এর মতানুসারে বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিকাশের এক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সুসংহত আর্থনীতিক একক হিসাবে একটি মাত্র বিশ্বের বিকাশ সম্পর্কিত। অধ্যাপক চেরুনিলম তাঁর International Economics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
অনেকে এমন কথাও বলেন যে, সচেতনভাবে পরিকল্পিত ও অনুসৃত এক রণকৌশলের ফল হল বিশ্বায়নের প্রকল্প। এই প্রকল্প হল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুঁজিপতি শ্রেণীর রাজনীতিক প্রকল্প। আবার অনেকের অভিমত অনুযায়ী বিশ্বায়ন হল পরস্পর নির্ভরশীল প্রক্রিয়াসমূহের এক সমষ্টি। এই সমস্ত প্রক্রিয়া পৃথিবীব্যাপী বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী পদ্ধতিসমূহের উপর ভিত্তিশীল কাঠামোগুলির মধ্যে সক্রিয়।
পেত্রাস ও ভেল্টমেয়ার (James Petras and Henry Veltmeyer) তাঁদের Globalisation Unmarked শীর্ষক এক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বিশ্বায়ন হল একটি নির্দেশ এবং একটি রূপ। একটি নির্দেশ হিসাবে বিশ্বায়নের মধ্যে একটি বিশ্বাস র্তমান। এই বিশ্বাস অনুযায়ী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাজারের উদারীকরণের মাধ্যমে পুঁজি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও তথ্যাদির প্রবাহ অবাধ হবে এবং জনকল্যাণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সুফল পাওয়া যাবে। আবার রূপ হিসাবে বিশ্বায়ন হল একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি হল সুসংহত একটি মাত্র বিশ্ববাজারের পুঁজি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও তথ্যাদির পৃথিবীব্যাপী প্রবাহসমূহের সম্প্রসারণ ও গভীরতা বৃদ্ধি সম্পর্কিত।
বিশ্বায়ন হল একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মধ্যে মানুষজন আর বিচ্ছিন্ন জনসম্প্রদায়সমূহের সদস্য নয়। এই জনসম্প্রদাসমূহ কূটনীতিক বা বাণিজ্যিক সংকীর্ণ সম্পর্কের পথে সম্পর্কিত। সমগ্র মানবসমাজই এখন সরাসরি আন্তর্জাতিক বিষয়াদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক কালে মানুষের সাংগঠনিক এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বিশ্বায়ন এই পরিবর্তনকেই প্রকাশিত করে। বিবিধ প্রযুক্তিমূলক উন্নয়নের সুবাদে এই পরিবর্তন সম্পাদিত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিক ও ‘নীল (Patrick H. O ‘Nail) তাঁর Essentials of Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Globalization is a system in which human beings are no longer part of isolated communities that are themselves linked through narrow channels of diplomatic relations or trade. Entire societies are now directly “plugged in’ to global affairs. Thus globalization represents a change in human orgainzation and interconnection, but these are a function of those technological changes that make it possible.”
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দীপক নায়ার আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বায়নের ধারণাকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এই অর্থনীতিবিদের মতানুসারে বিশ্বায়ন বলতে একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এই প্রক্রিয়াটি হল আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত দেশসূমহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক আর্থনীতিক নির্ভরশীলতা এবং আর্থনীতিক সংহতি সম্পর্কিত। নায়ার বলেছেন, “…it (globalization) refers to a process of increasing economic integration and growing economic interdepen-dence between countries in the world economy.” অর্থাৎ বিশ্বায়ন হল জাতিরাষ্ট্রসমূহের রাজনীতিক সীমানাকে ছাড়িয়ে আর্থনীতিক কার্যকলাপের সম্প্রসারণ। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ভীতি এবং মুনাফা অর্জনের প্রলোভনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে পুঁজি, প্রযুক্তি, পণ্য পরিষেবা, তথ্যাদি ও জনসাধারণের চলাচলের ক্ষেত্রে জাতিরাষ্ট্রসমূহের সীমানা অতিক্রমণ যেমন আছে, তেমনি আছে আর্থনীতিক কার্যকলাপের এক সংগঠন। এই সংগঠনটি জাতীয় সীমানাসমূহকে অতিক্রম করে যায়। অধ্যাপক নায়ার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ- বিহীনতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এবং বিশ্বায়নের তিনটি মাত্রার কথা বলেছেন। এই তিনটি মাত্রা হল: আন্তর্জাতিক পুঁজি, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। তাঁর আরও অভিমত হল যে, বিশ্বায়নের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণবিহীনতা আন্তর্জাতিক পুঁজি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রসমূহকে অতিক্রম করে তথ্য প্রযুক্তি, পরিষেবা, ধ্যানধারণা এবং ব্যক্তি মানুষের জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে এই প্রবাহ প্রসারিত হয়েছে।
বিশ্বায়নের প্রকৃতি
বিশ্বায়নের সুবাদে সৃষ্ট পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক বহুমাত্রিক। সাধারণভাবে বিশ্বায়ন বলতে যে প্রক্রিয়াকে বোঝায় তা শীর্ষদেশ থেকে অধোমুখী এক প্রক্রিয়া। একক এক বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হল বিশ্বায়ন। পৃথিবীর সকল অঞ্চলে এই বিশ্ব-ব্যবস্থার ছাপ পড়ে। সমরূপীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রসমূহে বৈচিত্র্যের বিলোপ সাধিত হয়। জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিন্নতার আমদানি হয়। মানুষের কেনাকাটা, খেলাধূলা, খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-প্রমোদ অল্পবিস্তর অভিন্ন প্রকৃতির হয়। এতদ্সত্ত্বেও বলা হয় যে, বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়করণ, আঞ্চলিকীকরণ এবং বহু সংস্কৃতিবাদ প্রভৃতিও চলতে থাকে। সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী এই ধারার পিছনে বিবিধ কারণ বর্তমান। এই কারণগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক।
এক : সাধারণভাবে বিশ্বব্যাপী একটি একত্ববাদী বিশ্ব সংস্কৃতি সৃষ্টি করার পরিবর্তে বিশ্বায়ন কোন-না কোনভাবে অধিকতর জটিল প্রকৃতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ধারা সৃষ্টি করেছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রেই এই প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে স্বদেশীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমী ভোগ্য পণ্যসমূহ ও ধারণাসমূহ অধিকতর ঐতিহ্যপূর্ণ জীবনধারাগত আচরণসমূহের অঙ্গীভূত হয়েছে। উন্নত দেশগুলিও সাংস্কৃতিক লেনদেনের ব্যাপকতর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। এবং প্রতিদানমূলক প্রক্রিয়ায় কোকা-কোলা, MTV, ম্যাকডোনাল্ড মার্কা চটজলদি খাবার (McDonald’s) প্রভৃতি ক্রমবর্ধমান হারে প্রভাবিত হচ্ছে অ-পশ্চিমী ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, ঔষধপত্র, চিকিৎসাব্যবস্থা প্রভৃতির দ্বারা।
দুই: আর্থনীতিক ও রাজনীতিক জীবনকে অর্থবহভাবে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের সামর্থ্য হ্রাস পাচ্ছে। তারফলে উপর দিক থেকে ক্ষমতাকে নিংড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং নীচের দিক থেকে চুষে নেওয়া হচ্ছে। তারফলে জাতি ও রাজনীতিক জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক আনুগত্য শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় স্থানীয় জনসম্প্রদায় বা আঞ্চলিক বা ধর্মীয় এবং জাতিগত বা বর্ণগত পরিচয়ের আনুগত্য প্রাধান্য পাচ্ছে। চিন্তাবিদদের মতানুসারে বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ধর্মীয় মৌলবাদের কথা বলা যেতে পারে।
তিন: সমরূপীকরণের ভয়-ভীতি, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক প্রতিরোধের জন্ম দেয়। বিশেষতঃ সমরূপীকরণের প্রক্রিয়াকে যখন সাম্রাজ্যবাদের একটি ধরন হিসাবে দেখা হয় তখনই প্রতিরোধমূলক প্রবণতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষয়িষ্ণু ভাষা ও সংখ্যালঘু সংস্কৃতিসমূহের ব্যাপারে আগ্রহ ও আন্তরিকতার পুনরুত্থান ঘটে এবং বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সাধারণত নতুন করে পুঁজিবাদ বিরোধী ও মুক্ত বাণিজ্য বিরোধী সামাজিক আন্দোলনসমূহের সৃষ্টি হয়।
Leave a comment