বর্তমানে বিশ্বায়ন একটি বহু বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেবলমাত্র লেখাপড়ার জগতে তাত্ত্বিক বিষয় হিসাবে নয়। আর্থ-রাজনীতিক ক্ষেত্রেও এই বিতর্ক বহমান। এবং এই বিতর্কের প্রকৃতি বহুমাত্রিক। নতুন বিশ্বায়িত অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অনুকূল অবস্থান অধিকারের আশায় অধিকাংশ দেশের সরকার এবং প্রধান রাজনীতিক দলসমূহ উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করছে। অপরদিকে বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলনও উন্নত দেশগুলিতে শক্তিশালী হচ্ছে এবং কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশেও দানা বাঁধছে। কোন কোন রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের ভিত্তিতে চলে আসা মতাদর্শগত দ্বন্দ্বমূলক দক্ষিণপন্থী-বামপন্থী বিরোধ বর্তমানে ক্ষেত্রবিশেষে আড়ালে চলে গেছে; তার জায়গায় বিশ্বায়ন নিয়ে বিভাজন দেখা দিয়েছে। বিশ্বায়নের মূল কথা হল পারস্পরিক সংযোগ সম্পর্ক। এই সংযোগ-সম্পর্ক বাণিজ্যিক ক্রিয়াকর্ম এবং উন্মুক্ত বাজারের বিস্তারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কারণে অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “There is nevertheless, a sense in which the pro versus antiglobalization debate is nothing more than a reworking of the older and more familiar ideological divide.”

(১) বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া সত্যি সক্রিয় কিনা, বা বিশ্বায়নের সহায়ক শক্তিসমূহ সম্পর্কে চিন্তাবিদদের মধ্যে দুটি শ্রেণী বর্তমান। একদল সমাজবিজ্ঞানী বিশ্বায়নপন্থী, আর এক দল অবিশ্বাসী বা সন্দেহবাদী। 

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অস্তিত্বকে যাঁরা স্বীকার করেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্বায়নের সমর্থক বা বিশ্বায়নবাদী আছে এবং বিশ্বায়নবিরোধী আছে। এঁদের একযোগে অস্তিত্ববাদী হিসাবে অভিহিত করা যায়। অস্তিত্ববাদীরা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার আর্থনীতিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত গভীর ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনসমূহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সক্রিয়তার গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বিশ্ববাণিজ্যের উন্নততর পর্যায়ে উপনীত হওয়ার বিষয়টির কথা বলা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় টাকাকড়ি ও বৈত্তিক লেনদেনের ব্যাপক বৃদ্ধির কথা; নতুন যোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তির প্রবর্তন এবং তার ফলে বিশ্বব্যাপী বিবিধ ধ্যান-ধারণা, বক্তব্য ও সংবাদপত্রের তাৎক্ষণিক সম্প্রসারণ; বিশ্ব পণ্য হিসাবে কিছু দ্রব্যসামগ্রীর উদ্ভব এবং পৃথিবীব্যাপী সেগুলির সহজলভ্যতা প্রভৃতি। বিশ্বায়নের চূড়ান্ত ভাষ্য অনুযায়ী অতিবিশ্বায়নের কথা বলা হয়। অতি বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তিগত নিয়তিবাদের কথা বলা হয়। প্রযুক্তিগত নিয়তিবাদের অর্থ হল কমপিউটারাইজড বাণিজ্যিক লেনদেন, উপগ্রহ ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি ব্যাপকভাবে সহজলভ্য হয়ে গেলে বিশ্বায়িত অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ধরন-ধারা অপরিহার্য হয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার গতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতি এবং আন্তরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জঙ্গীহানায় মার্কিন মুলুকে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র ধ্বংসের ঘটনাটির প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে। তার ফলেও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া কতকাংশে শিথিল হয়ে পড়েছে।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবিশ্বাসী বা সন্দেহবাদীরা সাধারণত পুঁজিবাদের প্রচলিত বা পুরাতন বামপন্থী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর জোর দিয়ে থাকেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী, তথাকথিত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে তেমন বিশেষ কিছু নতুনত্ব নেই। রাজনীতিক কারণে বিশ্বায়নের প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখান হয়েছে। মার্কসীয় দর্শনে পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিক চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই লেনিন (V. I. Lenin) ও হবসন (J. A. Hobson) পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে গভীর সংযোগ সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে বিশ্ববাণিজ্যের অভাবিত উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু সন্দেহবাদীদের বক্তব্য হল আর্থনীতিক ক্রিয়াকর্মের সিংহভাগই সম্পাদিত হয় জাতীয় সীমারেখার মধ্যেই, তার বাইরে নয়। বিশ্বায়নবাদীদের বিরোধিতা করে এঁরা বলেন যে জাতীয় অর্থনীতিসমূহ অপ্রাসঙ্গিক নয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বায়নকে বৈপ্লবিক আর্থনীতিক বা প্রযুক্তিমূলক শক্তি হিসাবে না দেখে, মতাদর্শগত কৌশল হিসাবে দেখা হয়। একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিকরা এই কৌশলকে ব্যবহার করেন। এঁদের উদ্দেশ্য হল নয়া-উদারনীতিক অর্থনীতিকে সমর্থন করা। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদরা সংগঠিত যৌথ সংস্থাসমূহের স্বার্থসমূহ সংরক্ষণের পক্ষপাতী। এদিক থেকে বিচার করলে বিশ্বায়নের দুটি বড় সুবিধা বর্তমান। প্রথমতঃ, বিশ্বায়নের মাধ্যমে কতকগুলি প্রবণতার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। এগুলি হল: দুর্বল শ্রমিকসংঘ ও শ্রমের নমনীয়তা; সরকারী ব্যয় বিশেষতঃ জনকল্যাণমূলক বাজেটের উপর ব্যয় হ্রাস, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস প্রভৃতি। এগুলি অপরিহার্য তাই এদের আটকান যাবে না। দ্বিতীয়তঃ, এ ধরনের পরিবর্তন নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়ার অংশমাত্র, বড় কোন ব্যবসার মত এজেন্টের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে বিশ্বায়নের প্রবণতার দ্বারা এই সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়।

(২) বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে নয়া-উদারনীতিবাদী প্রকৃতি পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ উদারনীতিবাদের মধ্যে উন্মুক্ত বাজার সম্পর্কিত মতাদর্শের বৈশিষ্ট্য বর্তমান। সংক্ষেপে বিচার্য বিষয় হিসাবে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্বায়নবাদীদের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদের মাধ্যমে সাধারণ উন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়। এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব পুঁজিবাদের সুবাদে এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা অধিকতর সংখ্যক দেশ ও মানুষ ভোগ করতে পারে।

অপরদিকে বিশ্বায়নের বিরোধীরা পুঁজিবাদের সঙ্গে অসাম্য ও শোষণকে সংযুক্ত করার পক্ষপাতী। এই শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে বিশ্ব পুঁজিবাদ নতুন ধরনের অন্যায়-অবিচার ও দুঃখ-দারিদ্র্যের সৃষ্টি করবে। তাঁরা মনে করেন এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

বিশ্বায়ন নিয়ে যে বিতর্ক তার অনেক কিছুই একেবারে নতুন এমন নয়। কিন্তু একটি বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত বিতর্ক একেবারে নতুন। উত্তর সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া সক্রিয়। এই পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে বাজার-কাঠামো ও পুঁজিবাদী সংগঠনসমূহের সম্ভাব্য বিকল্পের অস্তিত্বকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না। এই অবস্থায় দুটি বিকল্পের মধ্যে পছন্দের কথা বলা হয়। এই দুটি বিকল্প হল: ‘নয়া উদারনীতিক বিশ্বায়ন’ এবং ‘নিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়ন’; বিশ্বপুঁজিবাদের সঙ্গে সমগুণগত মানের পৃথক কোন বিকল্পের কথা বলা হয়নি।

(৩) সাম্য ও দারিদ্র্য প্রসঙ্গে বিশ্বায়নের বক্তব্য বিষয় নিয়ে বিতর্কই সর্বাধিক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্য ও দারিদ্র্যের উপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বায়নের বিরোধীদের অভিমত অনুযায়ী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাবে নতুন ও গভীর প্রকৃতির অসাম্য-বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বায়নের সুবাদে ‘লাভবান’ ও ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ মানবসমাজ এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। লাভবান হিসাবে সাধারণভাবে চিহ্নিত করা হয় বিভিন্ন বহুজাতিক করপোরেশন এবং শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলিকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা হয়। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষসমূহ বিশ্বের উন্নয়নশীল অঞ্চলেই বর্তমান। পৃথিবীর উন্নয়নশীল অঞ্চলসমূহে মজুরী কম ও দারিদ্র্য বেশী; নিয়ন্ত্রণ শিথিল বা অনেক ক্ষেত্রে নেই। এই সমস্ত অঞ্চলে আভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় না; উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় বিশ্ব বাজারের দিকে তাকিয়ে। হেউড তার Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: ‘Global tensions have come to be seen less in terms of East versus West and more in terms of North-South divide.”

বিশ্বায়নপন্থীরা এ প্রসঙ্গে ভিন্ন কথা বলেন। বিশ্বায়নের সুবাদে বিত্তবানরা অধিকতর বিত্তবান হয়েছে। এ কথা ঠিক। অনুরূপভাবে অধুনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্রদের দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। উদারনীতিক বহুত্ববাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব অর্থনীতির উদ্ভবকে স্বাগত জানান দরকার। কারণ উন্মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার কল্যাণে প্রতিটি দেশ সুনির্দিষ্টভাবে বিশেষ কিছু দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও পরিষেবা প্রদানের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের বিচক্ষণতা ও নৈপুণ্য অর্জনের সুযোগ পায়। কারণ প্রতিটি দেশ তাদের স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা ও অবস্থানগত আনুকূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্ব স্ব উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনার সুযোগ পায়। তারফলে স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষীকরণ যেমন ঘটে, তেমি পারস্পরিক সুবিধা ও উপকার পাওয়া যায়। কোন ক্ষেত্রে উৎপাদন উন্নত দেশ থেকে অনুন্নত দেশে স্থানান্তরিত হলে উভয় পক্ষই উপকৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং তার ফলে উন্নত দেশগুলি কম দামে জিনিসপত্র পেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অনুন্নত দেশেরও উপকার হয়। কারণ এই সমস্ত দেশে মজুরীর স্তর এক নিম্নতর অবস্থান থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়। তারফলে উন্নতিশীল দেশের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত চাঙ্গা হয় এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে উদ্যোগ-আয়োজন বৃদ্ধি পায়। এ দিক থেকে বিচার করলে পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে, কেবল সেই সমস্ত দেশই বিশ্বায়নের সুযোগ-সুবিধা ও উপকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

(৪) গণতন্ত্রের উপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে রাজনীতিক বিতর্ক বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান রাজনীতিক বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রই হল সর্বজনস্বীকৃত ও ব্যাপকভাবে অনুসৃত ব্যবস্থা। স্বভাবতই গণতন্ত্রের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার আলোচনাটির রাজনীতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বিশ্বায়নবাদীদের অভিমত অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া গণতন্ত্রীকরণের ধারাকে অধিকতর শক্তিশালী করে। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ফুকুয়ামা (F. Fukuyama) তাঁর The End of History শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে বিশ্বায়ন হল ইতিহাসের সমাপ্তির দিকে অগ্রগতি। বিশ্বায়নের ফলে বাজার পুঁজিবাদের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে এবং তারফলে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কাঠামোসমূহ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত হবে। আর্থনীতিক স্বাধীনতা অনিবার্যভাবে রাজনীতিক স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করবে। কারণ বাজার অর্থনীতি জটিল প্রকৃতির বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে এবং এ ধরনের চাপ একমাত্র উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজেই ধারণা করা সম্ভব হবে।

বিশ্বায়নের বিরোধীরা বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্রের বিরোধী শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। বিশ্বায়ন দুভাবে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

  • বিশ্বায়নের মাধ্যমে আর্থনীতিক ক্ষমতাসমূহ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। আর্থনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে রাজনীতিক ক্ষমতাও স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীভূত হয়। আর্থ-রাজনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী। আর্থনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে বহুজাতিক করপোরেশনসমূহ (MNC – Multinational Corporations)- এর মাধ্যমে। এ রকম বিশিষ্ট বহুজাতিক করপোরেশনের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল ICBM, General Motors, Shell, McDonald’s News Corporations প্রভৃতি। আর্থনীতিক ক্ষমতার সুবাদে বহুজাতিক কোম্পানীগুলি ভোক্তাদের বা মানুষের রুচি বা পছন্দের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আবার বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বিকাশ ও বিস্তারের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানীগুলি মানুষের জাগতিক মূল্যবোধসমূহের পরিবর্তন সাধন করতে পারে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলি গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এবং জাতীয় সরকারসমূহের ঊর্ধ্বে গিয়ে বাড়তি ও সিদ্ধান্তমূলক সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য মূলধন ও উৎপাদনকে পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশে স্থানান্তরিত করতে পারে। উন্নয়নশীল বিশ্বের জাতীয় সরকারগুলি বহুজাতিক সংস্থাসমূহকে সস্তায় শ্রম সরবরাহ করে; এবং উৎপাদন ব্যয় কম রাখার জন্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জাতীয় রাষ্ট্র বিদেশী কোম্পানীর হাতে দিতে পারে।

  • আর একটি বিষয় গণতন্ত্রের পথে প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে। রাজনীতিক বিশ্বায়নের গতিকে আর্থনীতিক বিশ্বায়নের গতি ছাড়িয়ে যায়। আর্থনীতিক কাজকর্মসমূহ ক্রমান্বয়ে জাতীয় সীমারেখার প্রতি কম গুরুত্ব আরোপ করে। এ সবের মধ্যেই রাজনীতিক সক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ অতিমাত্রায় দুর্বল বলে বিশ্ব পুঁজিবাদী শক্তিসমূহের কাছ থেকে কোন রকম কৈফিয়ৎ তলব করতে পারে না। অতঃপর গণতন্ত্র সম্পর্কিত বিশ্বজনীন ধারণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।

বিশ্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য জাতীয় সীমারেখাকে অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক সংগঠন ও প্রক্রিয়াসমূহের ধারণাকে সম্প্রসারিত করতে হবে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনসমূহকে অধিকতর শক্তিশালী করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিদ্যমান সীমাবদ্ধতাসমূহকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে অধিকতর স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য্যযুক্ত করতে হবে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, জি-৭ (G-7) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানসমূহকে বহুজাতিক করপোরেশনসমূহের স্বার্থের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থেকে যথাসম্ভব মুক্ত করতে হবে। এই সমস্ত আন্তর্জাতিক আর্থনীতিক সংগঠনসমূহকে আর্থনীতিক ন্যায়, মানবাধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে অধিকতর দৃষ্টি দিতে হবে।

(৫) ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও অস্থায়িত্বের কারণেও বিশ্বায়নের বিরূপ সমালোচনা করা হয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রদর্শিত এই সমস্ত যুক্তিগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক। বিশ্বায়নবাদীরা স্বীকার করেন যে, কোন প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অন্যতম অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হল গতিশীলতা। কিন্তু ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতির নিয়ম অনুসরণ করে তাঁরা বলেন যে, দীর্ঘকালীন ক্ষেত্রে বাজারে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবণতা থাকে। দীর্ঘকালীন বিচারে চাহিদার সঙ্গে যোগানের সামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ দিক থেকে বিচার করলে এইভাবে আর্থনীতির কার্যকলাপের ক্ষেত্রে অধিকতর স্থায়ী প্রকৃতির অবস্থার সৃষ্টি হবে। অতএব বিশ্বায়নের সঙ্গে সংযুক্ত অস্থায়িত্ব ও অনিশ্চয়তা কালক্রমে হ্রাস পাবে। এতদ্সত্ত্বেও এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বিপদ কাটেনি।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধিক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা সংযুক্ত। তিন দিক থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।

  • অধুনা আর্থনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিশ্বের আর্থনীতিক বাজারের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। এই আন্তর্জাতিক আর্থনীতিক বাজার অতিমাত্রায় অস্থির প্রকৃতির। কারণ স্বল্পমেয়াদী আর্থনীতিক বিচার-বিবেচনার দ্বারা এই বাজার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। তা ছাড়া এই বাজারের কাজকর্ম অনেকাংশে ফাটকা প্রকৃতির। এই সমস্ত কারণে বিভিন্ন শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের, জাতীয় অর্থনীতির এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আর্থনীতিক স্বার্থ আর্থনীতিক বাজারের খামখেয়ালীপনার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রুহেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “George Soros (1998) argued that such crises threatened the open society, and can be prevented only by far greater regulation, aimed at bringing speculative financial flows under control.”

  • অনিশ্চয়তার দ্বিতীয় প্রকার প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী বেক (Ulrich Beck) তাঁর Risk Soci ety: Towards New Modernity (1992) শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। বেক ঝুঁকিবহুল সমাজ (risk society) বলতে এমন এক সমাজের কথা বলেছেন যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী প্রবণতা ক্রমবর্ধমান এবং ঐতিহ্য, জনসম্প্রদায়মূলক চেতনা ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের হীনবল হয়ে পড়ার প্রবণতা অধিক। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে অনিশ্চয়তা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং আর্থনীতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্বাভাসের সুযোগ-সম্ভাবনা হ্রাস পেতে থাকে। এই অবস্থার ব্যক্তিগত ও মনস্তাত্ত্বিক ফলশ্রুতি আছে। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রহেউড বলেছেন: “… When all fixed points are undermined, people’s basic values and even sense of identity are called into question.”

  • বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে আর এক ধরনের অস্থায়িত্বের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। বিশ্বায়নের মধ্যে পরিবেশের ক্ষতি সাধনের ও পরিবেশের মধ্যে সংকট সৃষ্টির এক ধরনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী পুঁজিবাদ মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে একেবারে অন্ধ। মুনাফার লক্ষ্যে পুঁজিবাদ পরিবেশের ব্যাপারেও নিষ্ঠুর। মূলাভিমুখী পরিবেশবাদীদের মতানুসারে শিল্পায়নে সম্প্রসারণই হল বিশ্বায়ন; এ হল এমন এক আর্থনীতিক ব্যবস্থা যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ হল মূলধনের কেন্দ্রীভবন, বৃহদায়তন বিশিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা, অবিরাম উন্নয়ন প্রভৃতি। শিল্পায়নবাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর চূড়ান্তভাবে আস্থাশীল। শিল্পায়নবাদ বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণাকে বিকশিত ও বিস্তারিত করে। তারফলে মানবিক মূল্যবোধসমূহের অবক্ষয় ঘটে এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের উপর অমানবিক আঘাত আসে। সংস্কারবাদী পরিবেশবিদরা বিশ্বজনীনভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের উপর জোর দেন। অ্যান্ড্রু হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন। “…as the faltering process of implementing the 1997 Kyoto Protocol on climate change demonstrates, concerted state action in this area is difficult to achieve because of the economic sacrifices involved.”

এ প্রসঙ্গে হেল্ডের পর্যালোচনা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর অভিমত অনুযায়ী আইনানুগ (dejure) সার্বভৌমিকতার ধারণার বাধ্যবাধকতা অব্যাহত আছে। কারণ রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে। তবে অধুনা অধিকতর জটিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রকে কাজ করতে হয়। তারফলে রাষ্ট্রের স্বাধিকার সীমাবদ্ধ হয় এবং সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়। এবং সার্বভৌমিকতার সাবেকি ধারণা হীনবল হয়ে পড়ে; হবস্-রুশোর আলোচনায় সার্বভৌমিকতা বলতে অবাধ-অসীম ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে, তা আর থাকে না। আধুনিককালের পরিবর্তিত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতাকে বেশ কিছু সংস্থার মধ্যে বিভক্ত বলে ধরে নিতে হবে। এবং এই বহুত্ববাদী প্রকৃতির জন্যই সার্বভৌমিকতা সীমাবদ্ধ। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত এই ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় লকের রাজনীতিক জনসম্প্রদায়ের ধারণার মধ্যে। পরিশেষে নোবেল বিজয়ী সমাজবিজ্ঞানী যোশেফ স্টিগুলিটের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। Globilization and its Discontents শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন: “Globalization today is not working for many of the world’s poor. It is not working for much of the environment. It is not working for the stability of the global economy. The transition from communism to a market economy. has been so badly managed that, with the exception of China, Vietnam and a few East European countries, poverty has scored as incomes have plummeted.

To some, there is an easy answer: Abandon globalization. That is neither feasible nor desirable….globilization has also brought huge benefits ….The problem is not with globalization, but with how it has been managed.