জাতিগোষ্ঠীর ধারণা

রাজনীতিক ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় কতকগুলি শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি বর্তমান। এই শব্দগুলি হল ‘এথনিক গ্রুপ (Ethnic Group), রেসিয়াল গ্রুপ (Racial Group), কাস্ট (Caste), সোস্যাল স্ট্রেটাম (Social stratum) প্রভৃতি। ইংরেজী এথনিক গ্রুপ (Ethnic Group) শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ প্রসঙ্গে মতপার্থক্য বর্তমান। অনেকে এক্ষেত্রে ‘বর্ণগোষ্ঠী’ কথাটি ব্যবহার করার পক্ষপাতী। আবার অনেকে নরগোষ্ঠী (Race) কথাটি ব্যবহার করতে চান। লিঙ্গ বা বয়সের মত মানুষের দ্বারা বর্ণগোষ্ঠীর সদস্যপদ নির্ধারিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কৃতকর্ম বা পছন্দ অপছন্দের কোন ভূমিকা নেই। বর্ণগোষ্ঠী অনেক সময় অভিন্ন নরগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত। আবার ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক নরগোষ্ঠীর সম্মিলনে বর্ণগোষ্ঠীর সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে। তার ফলে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

তবে ‘জাতিগোষ্ঠী’ কথাটি এ ক্ষেত্রে সম্যকভাবে অর্থবহ বলে পরিগণিত হয়। আবার রাজনীতিক প্রেক্ষিতে বর্ণগোষ্ঠী জাতি (nationality) হিসাবে পরিগণিত হতে পারে; আবার তা নাও হতে পারে। কারণ সকল বর্ণগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচিতি অভিন্ন; কিন্তু রাজনীতিক পরিচিতি অভিন্ন হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে না। ‘এথনিসিটি’ জাতীয় বিচ্ছিন্নতা বা রাজনীতিক অধীনতার ভিত্তি হিসাবেও বিবেচিত হতে পারে। সমাজে গোষ্ঠীপদ সম্পর্কিত রাজনীতিক সংগ্রামেরই কারণে ‘এথনিক গ্রুপের সংজ্ঞা নিয়ে দ্ব্যর্থব্যঞ্জনা বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

‘এথনিসিটি’র পরিচায়ক হিসাবে ‘জাতি’ এবং ‘জাতীয়তা’র সাদৃশ্যমূলক বৈশিষ্ট্যসমূহের কথা বলা হয়। জাতি ও জাতীয়তার সাধারণ সূত্রাদির সঙ্গে সঙ্গে এই গোষ্ঠী আবদ্ধ থাকে সংস্কৃতি, প্রথা প্রভৃতি সূত্রাদির সুবাদে। এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় আপেক্ষিকভাবে বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতিতে। এই গোষ্ঠীর উদ্ভব মানবসমাজের বিবর্তনের এক সাধারণ পর্যায় হিসাবে পরিগণিত হয়। জাতিগোষ্ঠী প্রত্যয়টি সাধারণত নৃতাত্ত্বিক পঠন পাঠনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। অধুনা পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। আর্থনীতিক উন্নয়ন, সামাজিক-রাজনীতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় সংহতির পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়টি বর্তমানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিগোষ্ঠী হল বিশেষ পরিচিতির অধিকারী এক জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা যায় অভিন্ন সংস্কৃতির অস্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে। জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও ধর্ম অভিন্ন হয় এবং তারা অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী হয়। অন্তত মানবসভ্যতার ইতিহাসের কোন এক পর্যায়ে তারা অভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচিতির ভিত্তি হিসাবে অভিন্ন ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, খাদ্যাভাস, পোশাক পরিচ্ছদ, লোকাচার প্রভৃতির কথা বলা হয়। জাতিগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহ পুরুষানুক্রমে সামাজিকভাবে সঞ্চারিত হয়। এই সমস্ত উপাদান শারীরিক বা অর্জিত নয়। বৃহত্তর কোন সংস্কৃতির আওতার মধ্যে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচয়বাহী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করতে পারে।

জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা সংস্কৃতিগতভাবেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য গোষ্ঠীর থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে। অন্যান্য মানুষও জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের স্বতন্ত্র মনে করে। পারস্পরিক এই স্বাতন্ত্র্য্যমূলক ধারণার ভিত্তিগত উপাদান হিসাবে ভাষা, বেশভূষা, ধর্ম, বংশানুক্রম, ইতিহাস প্রভৃতির কথা বলা হয়। সাংস্কৃতিক কিছু রীতিনীতি ও ভাবধারার দ্বারা একটি জাতিগোষ্ঠী পরিচালিত হয়। তার ফলে অন্যান্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্যের সৃষ্টি হয়। অভিন্ন ভাষা-ধর্ম এবং একই ভূখণ্ডে বসবাসের কারণে জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে সমজাতীয় মানসিকতার সৃষ্টি হয়। এই মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিগোষ্ঠীর বাইরের ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে স্বাতন্ত্র্যের ধারণার সৃষ্টি হয়। এ হল জাতিগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। একে বলে জাতিগোষ্ঠীগত সচেতনতা। এই সচেতনতার সুবাদে জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে আমরা বোধ এবং অন্যান্যদের সম্পর্কে ‘ওরা বোধ’-এর সৃষ্টি করে।

সমাজবিজ্ঞানী পল ব্রাসের অভিমত অনুযায়ী কোন জনগোষ্ঠীকে জাতিগোষ্ঠী হিসাবে সনাক্ত করার ব্যাপারে দুটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া দরকার। এই দুটি বিষয় হল সমাজের অপর কোন গোষ্ঠীর থেকে বস্তুগত পার্থক্য সম্পর্কে সমষ্টিগত সচেতনতা এবং সংশ্লিষ্ট সচেতনতার রাজনীতিক প্রাসঙ্গিকতা। বস্তুত ব্রাস জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগত উপাদানসমূহকে বস্তুগত এবং মনস্তাত্ত্বিক— মূলত এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। তবে বস্তুগত ভিত্তি ব্যতিরেকে জাতিগোষ্ঠীর সচেতনতা সৃষ্টি অসম্ভব—এ কথা আজকাল অনেকেই স্বীকার করতে সম্মত নন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে বস্তুগত ভিত্তির অভাববোধের কারণেও অনেক সময় জাতিগোষ্ঠীগত সচেতনতার সৃষ্টি হতে পারে।

সমাজবিজ্ঞানী সামনার (N. G. Sumner) তাঁর Folkways শীর্ষক রচনায় সর্বপ্রথম ‘এথনোসেনট্রিজিম’ (Ethnocentrism) কথাটি ব্যবহার করেন। এ হল একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যক্তিমানুষ নিজের গোষ্ঠী বা সংস্কৃতিকেই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গণ্য করে। এই কেন্দ্রবিন্দুর সঙ্গে তুলনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি বাকি সবকিছুর মূল্যায়ন করে থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের ধ্যানধারণা ও লোকাচারকে বিশেষভাবে বড় করে দেখে থাকে। সামনার এই প্রবণতা প্রসঙ্গে বলেছেন: “… to exaggerate and intensify everything in their own flokways which is peculiar and which differentiates them from others.”

জাতিগোষ্ঠী ও রাজনীতি

কোন মানবগোষ্ঠী জাতিগোষ্ঠী হিসাবে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। তবে দু-তিন প্রজন্মের মধ্যে এই সমস্ত স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অনেকাংশে হারিয়ে ফেলে এবং বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। তবে সংশ্লিষ্ট সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এরকম একাত্মতা অর্জনের প্রক্রিয়ার জন্য সচেতন উদ্যোগের অস্তিত্ব আবশ্যক। আবার ব্যক্তিমানুষ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে একাত্মবোধ করতে পারে। এতদ্‌সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীসমূহ পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যবোধ জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তি হিসাবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে তুলে ধরার ব্যাপারে সাধারণত প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ কিছু প্রতীক, চিহ্ন, রূপক বা উপকথার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এসবের মাধ্যমে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী নিজস্ব পরিচয় প্রকাশ করে এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে পার্থক্য প্রতিপন্ন করে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, রাজনীতিক কারণে জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এই পারস্পরিক পার্থক্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রাজনীতিক সমাজতাত্ত্বিকদের অভিমত অনুযায়ী কোন মানবগোষ্ঠীর জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি হল একটি রাজনীতিক প্রক্রিয়া। রাজনীতিক প্রক্রিয়াতেই জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হয় বা সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বা জাতীয় রাজনীতিতে জাতিগোষ্ঠীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সকল দেশের জাতীয় রাজনীতিতে জাতিগোষ্ঠীসমূহের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের বিকাশশীল দেশগুলিতে জাতীয় রাজনীতিতে জাতিগোষ্ঠীসমূহ কার্যকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই সমস্ত দেশের নির্বাচনী রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় জাতিগোষ্ঠীসমূহের ভূমিকা বিশেষভাবে অর্থবহ। বিভিন্ন রাজনীতিক দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়সমূহের স্বার্থ ও চাপের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক টানাপোড়েনের সম্পর্কও জাতীয় রাজনীতির প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। সরকারী ক্ষমতা দখল, মন্ত্রিসভা গঠন ও পুনর্গঠন, দপ্তর বণ্টন ও পুনর্বণ্টন, মন্ত্রিসভার ক্ষমতাসীন থাকা বা অপসারিত হওয়া প্রভৃতি বিষয়ে দেশের জাতিগোষ্ঠীসমূহের রাজনীতির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী প্রভৃতি পদাধিকারীদের বাছাই করার ব্যাপারেও অনেক সময় জাতিগোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িক বিচার-বিবেচনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

উন্নত দেশগুলির মধ্যেও কোন কোনটির জাতীয় রাজনীতিতে জাতিগোষ্ঠীসমূহের ভূমিকাগত তাৎপর্য পরিলক্ষিত হয়। গ্রেট ব্রিটেনের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় জাতিগোষ্ঠীসমূহের আবেদন এবং তার কার্যকারিতা অস্বীকার করা যায় না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নেও সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার অস্তিত্ব সত্ত্বেও জাতিগোষ্ঠীসমূহের স্বাতন্ত্র্যমূলক রাজনীতিক চেতনার অস্তিত্ব ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার পর কতকগুলি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বর্তমান। এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মত এই সমস্ত রাষ্ট্রেও জাতিগোষ্ঠীগত বিরোধ অল্পবিস্তর অব্যাহত।

আন্তর্জাতিক স্তরেও রাজনীতি জাতিগোষ্ঠীগত প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও জাতিগোষ্ঠীগত আবেগ-আবেদন অল্পবিস্তর বর্তমান। আধুনিককালে এই আবেদন-নিবেদন বৃদ্ধি পাওয়ার সহায়ক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। তারফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আশাতীতভাবে উন্নতি সাধিত হয়েছে। বিশ্ববাসীর মধ্যে সংযোগ সম্পর্কের পরিধি প্রসারিত হয়েছে এবং গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর কোন প্রাপ্তে কোন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উপর সংখ্যাগুরু কোন জাতিগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারের ঘটনা ঘটলে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমজাতীয় জনগোষ্ঠীসমূহ প্রত্যাঘাত সংগঠিত করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে এই পরিবর্তন বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিকাশ ও বিস্তারের সুবাদে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সংযোগ সম্পর্কের প্রকৃতি পরিধির পরিবর্তন ঘটেছে।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিগোষ্ঠীসমূহ

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের পতন এবং ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীতে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার প্রকাশ ও প্রসার ঘটেছে। এই বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া হল সাম্রাজ্যবাদী ক্রিয়াকলাপের আধুনিক অভিব্যক্তি। এ হল নয়া সাম্রাজ্যবাদ বা লগ্নীপুঁজির সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের দর্শনের সুবাদে পুঁজিবাদী শক্তিসমূহের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বায়নের দর্শন পুঁজিবাদী দর্শনকে পরিপুষ্ট এবং পরিব্যাপ্ত করছে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার প্রভাব পুঁজিবাদী প্রভাব। এই প্রভাব পৃথিবীব্যাপী উৎপাদন ব্যবস্থা, অর্থশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বহুজাতিক বা অতিজাতিক সংস্থাসমূহের অর্থব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ, প্রাণিজগতের কোন কোন প্রজাতির জৈবিক অস্তিত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রসারিত হচ্ছে।

বিশ্বায়ন ব্যবস্থার অনুসঙ্গ হিসাবে মুক্তবাণিজ্য ও পণ্যসামগ্রীর বিশ্বব্যাপী বাজারের বিস্তার ঘটেছে। এই পথ ধরে পশ্চিমী উন্নত দেশসমূহের এবং বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটছে। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী ক্রিয়াকলাপ সমানে চলছে। এর সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিতে বেকারত্ব, অভাব-অনটন, হতাশা বাড়ছে। শিল্পোন্নত সকল দেশ এ ধরনের সংকট থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এমন দাবি করা যায় না। তারফলে বিভিন্ন দেশের জাতিগোষ্ঠীসমূহের বা জনসম্প্রদায়সমূহের মধ্যে ক্ষোভ বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতিগোষ্ঠীসমূহ সুদীর্ঘকাল ধরে যে যার জীবনধারা ও জীবনদর্শনের অনুগামী। আবহমানকাল ধরে অনুসৃত সেই জীবনধারার উপর আক্রমণ অনেক জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে সাবেকি সাধারণ প্রবণতাকে আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে তারা আন্তরিক। তারা তাদের বস্তুগত স্বাতন্ত্র্য এবং সে বিষয়ে সচেতনতাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী থাবা চতুর্দিকে সম্প্রসারিত। এরকম অবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জাতিগোষ্ঠীসমূহের স্ব স্ব স্বাতন্ত্র্যকে সরিয়ে রেখে বিশ্বায়নের সমীকরণ প্রক্রিয়ার সামিল হয়ে পড়ার কথা। এবং এ রকম সমীকরণ প্রক্রিয়ার সুবাদে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠবে এক জাতি— সমজাতীয় এক মানবগোষ্ঠী। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর পৃথক পৃথক জাতিগোষ্ঠী থাকবে না। বাস্তবে তা কিন্তু হয়নি।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিণামে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক পার্থক্যসমূহ অপসারিত হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। বরং বিপরীত প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ বাড়ছে। বিশ্বায়নের পুঁজিবাদী আগ্রাসনের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিজস্ব সংকটকে নতুন নতুন পথে বিশ্বব্যাপী সঞ্চারিত করার ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করা হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর রাজনীতিক ভারসাম্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা করা দরকার।

(ক) বিশ্বায়নের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে পৃথিবীর প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে বা ঘটছে। মানুষের আত্মপরিচিতির একটা আলাদা দুনিয়া আছে। মানুষের আত্মপরিচিতির এই জগতটির উপর রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে আসছে চিরকাল। বিশ্বায়ন-ব্যবস্থার কারণে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে হীনবল হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত জাতিগোষ্ঠীসমূহ, বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলি নতুন তাগিদে ও উদ্যমে রাজনীতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছে। এবং জাতিগোষ্ঠীসমূহের এই সমস্ত সংগঠন যে যার জাতিরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছে বা জাতিরাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

(খ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। অধুনা নিমেষের মধ্যে উপগ্রহ-যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে সংযোগ সম্পর্ক স্থাপন, মতামতের আদান-প্রদান বা খবরা-খবর প্রেরণ সম্ভব। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবী এখন মানুষের কাছে ছোট হয়ে এসেছে। এ রকম অবস্থায় পৃথিবীর জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক বস্তুগত পার্থক্য এবং সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, হ্রাস পায়নি।

(গ) বিশ্বায়নের অনুষঙ্গ হিসাবে মুক্তবাজার এবং পৃথিবীব্যাপী পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে অভিন্ন প্রকৃতির জীবনধারা ও সংস্কৃতি সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। একে বলে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাপ্তের জাতিগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে প্রতিবাদী উদ্যোগ-আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীসমূহ নিজেদের পার্থক্যসূচক উপাদান বা বৈশিষ্ট্যগুলিকে গুরুত্ব সহকারে প্রতিপন্ন করছে। বিশেষতঃ ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এ রকম প্রতিবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।

(ঘ) বিশ্বায়ন-ব্যবস্থার সুফলসমূহ ভোগ করছে পশ্চিমী উন্নত দেশগুলির মানুষ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় মানুষ। অর্থাৎ বিশ্বায়নের সুযোগ-সুবিধাসমূহ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ত্রুটিবিচ্যুতিসমূহের কারণে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশের ভাগ্যাকাশে সংকট ও দুর্ভাবনার কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। স্বভাবতই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিক্ষোভ-বিদ্রোহের সামিল হচ্ছে।

(ঙ) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবাদে বিশ্বব্যাপী পণ্যসামগ্রীর চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যোগাযোগের সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে। এরকম পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীসমূহ নিজেদের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে অধিকতর সতর্ক ও সচেতন হচ্ছে।

(চ) বিশ্বায়নের বিকাশ ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলবাদী প্রবণতা শক্তিশালী হয়েছে। রাজনীতিক সমজাতীয়তা সুনিশ্চিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিশ্বায়ন নাগরিক বা পৌর জাতীয়তাবাদকে হীনবল করার চেষ্টা করেছে। কোন দেশের মানুষের সমষ্টিগত পরিচয়ের বরাবরের ভিত্তি হল জাতি। বিশ্বায়নের মাধ্যমে এই জাতিগত স্বাতন্ত্র্য্যসূচক বৈশিষ্ট্য বা উপাদানসমূহকে অপসারিত করার জন্য উদ্যোগ-আয়োজন গৃহীত হয়। এই অবস্থায় জাতির ভূমিকায় ধর্ম অবতীর্ণ হয়। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…fundamentalism has emerged as a sub-variety of ethnic nationalism. This has been particularly significant in parts of the world where national identity has been challenged or threatened. Fundamentalism as ethnic mobilization can, for instance, be seen in the militant Buddhism of the Sinhalese in Sri Lanka, in the Jewish settler movement is Israel, in Hindu and Sikh extremism in India, and in the resistance of Ulster Protestants to a United Ireland.” হেউড আরও বলেছেন: “forms of cultural, ethnic and religious nationalism may be strengthened by the fact that the state is losing its capacity to generate political allegiance and civic loyalty.”