বিশ্বায়নের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্দেশ করা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন ধারণাটির প্রবর্তক রােল্যান্ড রবার্টসন বিশ্বের সংকুচিতকরণ ও একত্রীকরণকেই বিশ্বায়ন বলে চিহ্নিত করেছিলেন। বিশ্বায়ন ধারণাটির কেন্দ্রীয় বিষয় হল এক ও অবিভক্ত বিশ্ব গঠন। ওয়ালারস্টাইন, গিলপিন প্রমুখের মতে, বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কিছুটা হ্রাস পেলে তার সার্বভৌমিকতা অক্ষুন্ন থাকে যাবে। পৃথিবীব্যাপী জনগােষ্ঠীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও প্রভাব-প্রতিক্রিয়াই বিশ্বায়ন হিসেবে বিবেচিত হয়। জোসেফ স্টিগলিৎসে বলেছেন, বিশ্বায়ন হল প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগােষ্ঠীর মধ্যে একধরনের নিবিড় একাত্মতা বা ঘনিষ্ঠতার সংহতি। বিশ্বায়নের ফলে পরিবহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিকাশ ঘটছে। গণমাধ্যম সমূহের সুবাদে মানুষ এখন সহজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। বিশ্বায়নকে অনেকে ভুবনায়ন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। রসনু-র মতে, বিশ্বায়ন অনৈক্য সাধনকারী প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে উপজাতীয় বিরােধ ও নয়া মৌলবাদের প্রসার ঘটিয়ে চলেছে। তার মতে, বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রশাসনের প্রভাব হ্রাস পেতে চলেছে।

বিশ্বায়নের ফলে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আলিক সীমারেখা ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ভীতি এবং মুনাফা অর্জনের প্রলােভনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে পুঁজি, প্রযুক্তি, পণ্য পরিসেবা, তথ্যাদি ও জনসাধারণের চলাচলের ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্র সমূহের সীমা অতিক্রম যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের এক সংগঠন। বিশ্বায়ন হল একক এক বিশ্বব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। সমরূপীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত। এর ফলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রসমূহে বৈচিত্র্যের বিলোপসাধন ঘটে।

উপরোক্ত সংজ্ঞা ও তথ্যের নিরিখে এ কথা বলা যায় যে বিশ্বায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা পুঁজিবাদের আর্থসামাজিক বিকাশের একটি স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। এককথায় বিশ্বায়ন হল সমগ্র বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একক বিশ্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং নিবিড় সংযােগসাধনের একটি প্রক্রিয়া।

বিশ্বায়ন একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হলেও নিজেদের সুবিধার্থেই বিশ্বায়নের রূপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা一

(১) অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন : সামগ্রিক বিচারে বিশ্বায়নের ধারণা মূলত অর্থনৈতিক। বিশ্বায়নের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ব্যক্তির সম্পদকে বিনিময় মূল্যে রূপান্তর করেছে এবং অগণিত বিমূর্ত স্বাধীনতাকে একটি নির্দিষ্ট স্বাধীনতার তকমা দিয়েছে, যার নাম হল অবাধ বাণিজ্যের স্বাধীনতা। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল সমগ্র বিশ্ব জুড়ে সমজাতীয় বিশ্ব অর্থব্যবস্থা গড়ে তােলা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্রগুলির আইনের কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটল। একইসঙ্গে মূলধন ও প্রযুক্তির জোগান দিয়ে নতুন শিল্পজাত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি করল। ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তে পশ্চিমের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ও তাদের মুখ্য পৃষ্ঠপােষক সংস্থা যথা আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুঁজির জোগান দেওয়ার ফলে একটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করল। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল অনুন্নত রাষ্ট্রগুলি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি নীতি নির্ধারণে তাদের স্বার্থের বাহক হিসেবে কাজ করছে। এর ফলস্বরূপ আর্থিক বিশ্বায়নের স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে।

(২) রাজনৈতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা বাতিল করে রাষ্ট্রকে বাজারকেন্দ্রিক সংস্থায় পরিণত করতে চায়। রাজনৈতিক বিশ্বায়ন হল উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজার দখল করা। এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলস-এর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে, পণ্যের অনবরত প্রসারমান বাজারের প্রয়ােজনে ধনী বুর্জোয়াদের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা ন্যূনতম রাষ্ট্র (Minimal State)-এর ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আসলে বিশ্বায়নের মূল পরিচালক হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এর সহযােগী দোসর হল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স। এরা তাবেদারির ভূমিকা পালন করেছে। এই রাষ্ট্রগুলি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে এর ফলে জাতি-রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাকে পুরােপুরি অকেজো করে বিশ্বের রাষ্ট্র ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না। তাদের প্রধান লক্ষ্য হল অতীতের মতাে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির উপর নতুনভাবে ও নতুন রূপে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

(৩) সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন রূপকারদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ধ্রুপদি সংস্কৃতির জগৎকে তছনছ করে দেওয়া। একইসঙ্গে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিকে কাজে লাগিয়ে বিজাতীয় ভােগবাদী সমাজের পণ্যকে নতুন মােড়কে হাজির করা। ফলে ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারা আজ রাষ্ট্রের গণ্ডি অতিক্রম করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সারা বিশ্বে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠার রাস্তা সুগম হয়েছে। ইনটারনেট ও টিভির দৌলতে আজ সারা বিশ্বের মানুষ অল্প ব্যয়ে উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। একজন সমাজতত্ত্ববিদ বলেছেন যে, বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা সেকেলে করে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েদের পরনে জিন্স, পায়ে বাহারি জুতা, হাতে কোল্ড ড্রিঙ্ক, চোখে সানগ্লাস, মুখে ফাস্টফুড, কানে স্মার্ট মোবাইল ফোন পৃথিবীর যে-কোনাে দেশের যে-কোনাে জায়গার মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। ভারতের ক্রীড়া জগৎ, সংগীত ও চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত সামগ্রী বা পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। এইভাবে ভােগবাদী সংস্কৃতি উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, বিশ্বায়িত সংস্কৃতির সঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে জন্ম দিচ্ছে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতি বা Culture I Global থেকে Glo, Local থেকে Cal = Glo-Cal. Glo – Cal Culture এবং ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ’ এই সার তত্ত্ব আজ ধুলােয় লুন্ঠিত হয়েছে।

উপসংহার: বিশ্বায়ন হল একটি ধারণা যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে প্রভাব ফেলেছে। সারা বিশ্বে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এর কুফল দেখা দিতে শুরু করেছে। এর ফলে অতীতের মতােই ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। ফলে উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছে।