১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে যে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয় তা সাবেকি নাগরিকতার ধারণায় এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। নাগরিকতার ধারণা যা জাতি-রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিল তাতে এক সুদুরপ্রসারী পরিবর্তন দেখা যায়। এর দ্বারা এরকম বলা হচ্ছে না যে নাগরিকতার ভৌগলিক সীমারেখা উঠে গেছে বা সমস্ত মানুষ এক সীমারেখাহীন বিশ্বব্যবস্থার নাগরিকে পরিণত হয়েছে। যা বলতে চাওয়া হচ্ছে তা হল এই যে নাগরিকতার চিরাচরিত ধারণায় এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে বিশ্বায়নের প্রভাবে।
বিশ্বায়ন নাগরিকতার ধারণায় যে সব পরিবর্তন এনেছে তার মধ্যে অন্যতম হল এর ফলে এক বহুজাগতিক নাগরিকতা অনেক দেশেই অনুসরণ করা হচ্ছে। অনেক দেশই এখন পার্থক্যমূলক ও বহুনাগরিকতার ধারণাকে পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণ করেছে এবং বিশ্বের নানান দেশে দ্বৈত নাগরিকতা প্রচলন করা হয়েছে। R. Bouback তাঁর Transitional Citizenship (1994) গ্রন্থে দেখিয়েছেন বিশ্বের নানা দেশে আন্তঃরাষ্ট্রীয় (Inter State) নাগরিকত্ব প্রচলন করা হয়েছে। এই সমস্ত দেশে মানুষ জোট বেঁধে জাতিরাষ্ট্রের সীমারেখাকে অতিক্রম করেছে। সাম্প্রতিককালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই ধরনের প্রচেষ্টার এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। বর্তমানে ভূখণ্ডগত নাগরিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীণ হয়েছে। যোগাযোগ ও প্রযুক্তির অভাবনীয় ও বৈপ্লবিক উন্নতির ফলে বিশ্বের দেশগুলি পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ফলে জাতীয় সীমারেখা অনেক সময়ই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পরস্পর নির্ভরশীলতা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত, পরিবেশগত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত। আবার নারী অধিকার, মানবাধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিবাসীদের অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, কোন দেশের ক্ষুদ্র গণ্ডীতে আর সীমাবদ্ধ নেই। ফলে এইসব সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা আর্ন্তর্জাতিক স্তরে হয়ে থাকে, জাতীয় স্তরে নয়।
এলিজাবেথ কোহেন Semi Citizenship in Democratic Politics (2004) গ্রন্থে দেখিয়েছেন আধুনিক বিশ্বে অনেক ধরনের মানুষ আছে যারা পুরোপুরি নাগরিক নয়, আবার নাগরিকতার অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিতও নয়। তিনি এইসব নাগরিকদের আধা-নাগরিক (semi-citizen) বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সমাজে এই ধরনের আধা-নাগরিকের সন্ধান পাওয়া যায়। এরা পৌর ও সামাজিক অধিকার পেলেও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এইসব আধা-নাগরিকরা সর্বজনীন ভূখণ্ডগত নাগরিকতার ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এই বহুজাতিক নাগরিকতার ধারণা পৃথিবীর সম্পদসমূহের সম অংশীদারিত্বের কথা বলে। এছাড়াও বিশ্ব-নাগরিকত্বের ধারণা এক সাধারণ মানবিক পরিচয়ের (shared human identity) উপর জোর দেয়, যেখানে দেশের সীমারেখা কোন বাঁধা হবে না। একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে নাগরিকতার সাবেকী ধারণা (যা ভূখণ্ডগত জাতি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমার্থক ছিল) অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বাদ দেওয়াতেই অধিক বিশ্বাসী ছিল। আজকের বিশ্বায়নের ফলে যে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেখানে এই বহিষ্কৃতির ধারণা নাগরিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই বাদ দেবার প্রবণতা নাগরিকতার ক্ষেত্রে অ-নাগরিক বা খণ্ড নাগরিক সৃষ্টি করছে। বিশ্বজুড়ে অভিবাসী, আশ্রয়-প্রার্থী, উদ্বাস্তু, বাস্তুহারা অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি নাগরিকতার সাবেকী ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ জানান। তাই আজকাল citizenship শব্দটির পরিবর্তে denizenship শব্দটি অধিক জনপ্রিয় হয়েছে। অ-নাগরিক (denizens) হল সেইসব ব্যক্তিবর্গ যারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করে ও সেই জায়গায় পৌর-সামাজিক অধিকার ভোগ করতে পারলেও যাদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়। এই রকম অসংখ্য অ-নাগরিকের উপস্থিতি নাগরিকতার বিষয়টিকে এক বড়োসড়ো প্রশ্নের মুখে ফেলে। বহুজাতিক পরিচিতির অস্তিত্ব, গণ অভিবাসনের ঘটনা, বিশ্বায়িত অর্থনীতির খেলা প্রভৃতি জাতিরাষ্ট্রগত নাগরিকতাকে বিশ্বায়নের যুগে অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
বর্তমানে একক রাজনৈতিক পরিচিতি যুক্ত জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক নাগরিকতার ধারণার পরিবর্তে বহুনাগরিকতার ধারণা ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অ্যান্ড্রু লিনেকার (Andrew Linekar) তাঁর Cosmopolitan Citizenship নামক গ্রন্থে প্রস্তাব করেছেন বিশ্ব নাগরিকতার ধারণায় নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকবে।
-
(ক) বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন নাগরিক অধিকারের ব্যবস্থা।
-
(খ) জাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমগ্র বিশ্বের প্রতি কর্তব্য ও আনুগত্যবোধ এবং
-
(গ) আন্তর্জাতিক পৌর সমাজের উপস্থিতি।
তার মতে আন্তর্জাতিক স্তরে অবস্থিত ও ক্রিয়াশীল পৌর সমাজ জাতি রাষ্ট্রের থেকে নীতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ কারণ তা ওয়েস্টফেলিয়ান নাগরিকতার বর্জনের ব্যাধি থেকে মুক্ত। ডেভিড হেল্ড ও ম্যাকগ্রিয়উ মন্তব্য করেছেন বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রতিটি জাতি রাষ্ট্রের নাগরিককে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ভারতীয় তাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিখু পারেখ মত প্রকাশ করেছেন বিশ্ব নাগরিকতার ধারণাকে বর্জন করলেও বিশ্ব নাগরিকতার উপযোগী মানসিকতা গড়ে তোলা বর্তমানে খুবই প্রয়োজন। একথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় ইউরোপীয় ইউনিয়ান ইউরোপ মহাদেশের ক্ষেত্রে এক বহুস্তরীয় নাগরিকতার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। সবশেষে বলা যায় বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া পুরোপুরি সফল না হলেও মুক্ত বা অবাধ বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি প্রভৃতি এক নতুন ধরনের বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যেখানে জাতি রাষ্ট্রভিত্তিক নাগরিকতার ধারণা পুরোপুরি অচল না হয়ে গেলেও বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়েছে ও হচ্ছে।
Leave a comment