বিশ্বায়ন হল মূলত একটি আর্থনীতিক প্রক্রিয়া। আর্থনীতিক ধারণা ও ব্যবস্থা হিসাবে এই প্রক্রিয়ার আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছে। এতদ্‌সত্ত্বেও বিশ্বায়নের মধ্যে সামাজিক এবং রাজনীতিক উপাদানও আছে। স্বভাবতই বিশ্বায়ন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার জন্য বিশ্বায়নের উপাদানসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

আবার বিশ্বায়নের মৌলিক উপাদানসমূহ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বায়নের সঠিক স্বরূপ অনুধাবন করা যাবে। বিশ্বায়নের সমর্থক ও প্রবক্তারা প্রতিপন্ন করতে চান যে, বিশ্বায়ন অপরিহার্য এবং অনিবার্য। এ বিষয়েও যথার্থ ধারণা লাভের জন্য বিশ্বায়নের উপাদানসমূহ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। বিশ্বায়ন হল মূলত একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি। এই বাণিজ্যনীতিকে জনকল্যাণমূলক অর্থনীতি হিসাবে প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ-আয়োজন অব্যাহত। এই‌ ধারণা সঠিক কিনা তা সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। এবং এই কারণেও বিশ্বায়নের উপাদানসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বিচার-বিবেচনা করা দরকার।

বিশ্বায়নের উপাদান বহু ও বিভিন্ন। অসংখ্য উপাদানের সমাহারের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিকাশ ও বিস্তার গরিলিক্ষিত হয়। বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতামূলক আলোচনার আলোকে বিশ্বায়নের কতকগুলি মূল উপাদান চিহ্নিত করা যায়। এই সমস্ত মূল উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) বিশ্বায়নের প্রথম ও প্রধান উপাদান হিসাবে মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলা হয়। বলা হয় যে আর্থনীতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে মুক্ত বাজার অর্থনীতিই হল অপরিহার্য। মুক্ত বাজার আর্থনীতিক ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে। অবাধ প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে সকল দেশেই অঢেল সম্পদ-সামগ্রীর সৃষ্টি হবে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির শর্ত হিসাবে কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা হয়।

  • (১) উন্নয়নশীল দেশগুলিকে মুক্ত বাজারের সামিল হতে হবে এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে হবে। এই উদ্দেশ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থনীতিক সংরক্ষণ নীতি পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে আগে প্রত্যাহার করতে হবে অন্তঃশুষ্ক। এইভাবে সকল দেশের বাজারে দেশী এবং বিদেশী পণ্যসামগ্রীর সহাবস্থানের সৃষ্টি হবে। সকল দেশে বিদেশী পণ্যসামগ্রীর জন্য বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। তারজন্য যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। নিতে হবে। অর্থাৎ আর্থনীতিক উদারীকরণের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে।

  • (২) প্রত্যেক দেশের ব্যাজরে বিদেশী পণ্যসামগ্রী যাতে সরাসরি প্রতিযোগিতার সামিল হতে পারে তার জন্য উন্মুক্ত সুযোগ থাকতে হবে। তারজন্য কৃষিকর্মে ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী এবং প্রাত্যহিক ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীর উপর থেকে যাবতীয় সহায়ক নিয়ম নীতি বা ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

  • (৩) সকল দেশে ‘বিরাষ্ট্রীয়করণ’-এর প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রিত হবে। দেশের বিভিন্ন শিল্পসংস্থা, যোগাযোগ সংস্থা, পরিষেবামূলক সংস্থা প্রভৃতির উপর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে হবে। তারফলে দেশী ও বিদেশী পুঁজির বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। দেশীয় শিল্পক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতে হবে। তাহলে সকল দেশের বাজারে পণ্য সামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিরও অবাধ চলাচলের সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হবে।

বিশ্বায়নের মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবে সঠিক অর্থে বিশ্ব বাজারের আবির্ভাব ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে। তারফলে বিভিন্ন জাতীয় আর্থনীতিক বাজারের সীমানাসমূহ ভেঙে পড়ে। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হয়েছে কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক সরকারসমূহের ভেঙ্গে পড়ার ঘটনা। অনেকে এই ঘটনাকে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী।

এ প্রসঙ্গে সুশীলা রামস্বামীর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। Political Theory— Ideas and Concepts শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “The emergence of global markets greater imports and multinational corporations has weakened its (state’s) economic supremacy. Though Aristotle taught us that a state ensures justice yet this is not entirely correct.”

নোবেল বিজয়ী সমাজবিজ্ঞানী যোশেফ স্টিগলিট (Joseph Stiglitz) তাঁর Globalization and its Discontent শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Opening up to international trade has helped many countries grow far more quickly than they would otherwise have done. International trade helps economic development when a country’s exports drive its economic growth. Exported growth was the centerpiece of the industrial policy….”

(খ) বিশ্বায়নের অন্যতম উপাদান হিসাবে নয়া উদারনীতিবাদী মতাদর্শের কথা বলা হয়। সাবেকি উদারনীতিক মতাদর্শে আর্থনীতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করা হয়েছে। নয়া উদারনীতিক ধারণায় বাজারকেন্দ্রিক সংস্কারের কথা বলা হয় এবং এই সংস্কারের পূর্বশর্ত হিসাবে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়। উদারনীতিক রাজনীতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়নের আর্থনীতিক প্রক্রিয়ায় কাঠামোগত ও সংস্কারমূলক পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীরা আরও বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাংকের মত অতিজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছে। এখন তারা নিজেদের গণতন্ত্রের অভিভাবক হিসাবে প্রতিপন্ন করছে। এবং তারা উদারনীতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেন প্রাণপাত করছে। তারা পুঁজি বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের পূর্বশর্ত হিসাবে নয়া উদারনীতিক মতাদর্শ অনুসরণের কথা বলছে।

(গ) বিশ্বায়নের আর একটি উপাদান হিসাবে লগ্নীপুঁজির কথা বলা হয়। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় লগ্নীপুঁজি অনেকসময় অনুৎপাদক পুঁজি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় লক্ষ্মীপুঁজি বিশেষ সত্তা ও মাত্রাযুক্ত হয়ে থাকে। এই পুঁজি দেশ-নিরপেক্ষ। এই পুঁজি উৎসারিত হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। আন্তর্জাতিক স্তরে এই পুঁজি অত্যন্ত বেশী। এই পুঁজির উচ্চগতিশীলতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় ফাটকা বাজারের মত লাভের ক্ষেত্রে। এই পুঁজিকে বিশেষ ধরনের আর্থিক সম্পদে লগ্নী করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই আর্থিক সম্পদ এমন হওয়া চাই তা যেন সহজেই নগদ টাকায় রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়। আবার এই আর্থিক সম্পদকে বস্তুগত সম্পদেও সহজে পরিণত করা সম্ভব।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার এই লগ্নী পুঁজি ক্ষেত্রবিশেষে অনুৎপাদক পুঁজি হিসাবে প্রতীয়মান হয়। লক্ষ্মীপুঁজিকে আর্থিক সম্পদ বা বস্তুগত সম্পদে রূপান্তরকরণের উদ্দেশ্য সবসময় উৎপাদনশীল নয়। অর্থাৎ উৎপাদনশীল সম্পদে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্য সবসময় থাকে না। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট বস্তুগত সম্পদসূত্রে অর্জিত মূলধনকে শেয়ার বাজারের মত ফাটকা কারবারে বিনিয়োগ করা হয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সামিল বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা ও সহায়ক সংস্থাসমূহ আগে উৎপাদনশীল সংস্থা হিসাবে পরিগণিত হত। অধুনা এই সমস্ত সংস্থাকে ফাটকা কারবারে বিনিয়োগ করতে দেখা যায়। ফাটকা কারবারে এই বিনিয়োগ অনুৎপাদক পুঁজির পরিচায়ক।

(ঘ) সমগ্র বিশ্ব বর্তমানে কতকগুলি আঞ্চলিক আর্থনীতিক জোটে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কতকগুলি দেশকে নিয়ে এই বিশ্বের এক একটি এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এক একটি অর্থনীতিক আঞ্চলিক জোট। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য এলাকা প্রভৃতি। এই সমস্ত আঞ্চলিক আর্থনীতিক জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহকে তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আরোপিত শর্তাদি ও বিধি-ব্যবস্থা অনুসরণ করে চলতে হয়। অর্থাৎ জাতি রাষ্ট্রসমূহের জাতীয় অর্থনীতি আজকাল আর জাতীয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। পৃথিবীর সকল দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা অধুনা সাধারণভাবে সত্য। বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের জাতীয় অর্থনীতির উপর আর্থনীতিক আঞ্চলিক জোটগুলির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চিন্তাবিদ নিনান কোশী (Ninan Koshy) তাঁর Political Dimensions of Globalisation শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন, “A new global constitutionalism has been brought in mainly through the WTO… There is no reference to governments or people here. The new constitutionalism is imposed through binding multilateral instruments of the GATT, TRIPS and TRIMS agreement that operate under the umbrella of the WTO with their own enforcement mechanisms.”

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সাধারণভাবে আর্থনীতিক বিচারে অপেক্ষাকৃত হীনবল। উন্নয়নশীল এই সমস্ত দেশকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সমস্ত আর্থনীতিক আঞ্চলিক জোটের সামিল হতে হয়। তারপর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সম্পত্তিবান দেশগুলির দ্বারা নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলি অনন্যোপায় হয়ে এই সমস্ত জোটে যোগ দেয়। কারণ তা না হলে জোটের অন্তর্ভুক্ত সম্পদশালী দেশগুলি তাদের ঋণ দেবে না বা আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করবে না। শুধু তাই নয়, জোটের সদস্যপদ গ্রহণ না করলে জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে অসদস্য রাষ্ট্রগুলি তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করার সুযোগ পাবে না। নোবেল বিজয়ী সমাজবিজ্ঞানী যোশেফ স্টিগ্‌লিট তাঁর Globalization and its Discontents শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Foreign aid, another aspect of globalized world for all its faults still has brought benefits to millions often in ways that have almost gone unnoticed’….”

(ঙ) বিশ্বায়নের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবাদে সৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা সাম্রাজ্যবাদের নয়ারূপ হিসাবে পরিচিত। অনেকে বিশ্বায়নকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন হিসাবে অভিহিত করার পক্ষপাতী। এই সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া অতিমাত্রায় ভয়াবহ। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিশেষ কোন অঞ্চলের উপর নির্দিষ্ট কোন ঔপনিবেশিক শক্তির দখলদারি ও কর্তৃত্ব কায়েম হয় না। সাম্রাজ্যবাদী সাবেকি ধারণা এখানে খাটে না। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন বা সাম্রাজ্যবাদের এই নয়া প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র বিশ্বব্যবস্থা অতিশক্তিধর একটি-দুটি রাষ্ট্রের কাছে অনন্যোপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে। এ রকম অতি শক্তিধর দু-একটি রাষ্ট্র আর্থনীতিক এবং সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থানের অধিকারী হয়ে থাকে। এ রকম রাষ্ট্র নিজের কায়েমি স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সামরিক অভিযানের মত চরম ব্যবস্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না।

(চ) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে পণ্যসংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে। পণ্যসংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের জীবনধারায় ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ভোগবাদী মতাদর্শের প্রচারে জোয়ার এসেছে। সাবেকি জীবনধারার পরিবর্তে মানুষ বিদেশী জীবনধারা এবং বিশেষভাবে মার্কিন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি অন্ধভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। কারণ প্রাধান্যকারী গণমাধ্যমসমূহের সাহায্যে মার্কিন সভ্যতা-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বকে প্রবলভাবে প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ-আয়োজন চলছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নতিশীল দেশগুলির মানুষজন এই প্রক্রিয়ার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের হাত ধরে বিদেশী, বিশেষতঃ মার্কিন সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়া আর্থনীতিক এবং রাজনীতিক আধিপত্যের অনুপূরক হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল পৃথিবীব্যাপী অভিন্ন প্রকৃতির পণ্যের বাজার গড়ে তোলা। পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যসামগ্রী, দৈনন্দিন জীবনের আনুষঙ্গিক অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর জন্য আন্তর্জাতিক বাজার গড়ে তোলার জন্য বহুজাতিক সংস্থাসমূহ গণমাধ্যমগুলিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের মানুষজন বিজ্ঞাপিত পণ্যসামগ্রীর জন্য কৃত্রিম চাহিদার সৃষ্টি করছে। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর জায়গায় বিজ্ঞাপিত বিদেশী ভোগ্য পণ্যসামগ্রীর জন্য চাহিদার পারদ ক্রমশ চড়ছে। পশ্চিমী ভোগ্য পণ্য ও বস্তুবাদী জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোজগতে ও চিন্তা-চেতনায় পশ্চিমী, বিশেষত মার্কিনী জীবনধারা সঞ্চারিত হচ্ছে।

(ছ) বিশ্বায়নের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসাবে অতিজাতিক (Trans-national) সংস্থাসমূহের কথা বলা হয়। অতিজাতিক সংস্থাসমূহ হল বিশ্বায়নের সুবাদে সৃষ্ট আর্থনীতিক ব্যবস্থার সাংগঠনিক ভিত্তি। আবার অতিজাতিক সংস্থাসমূহ নিজেদের স্বার্থে বিশেষ ধরনের এক আন্তর্জাতিক আর্থিক সম্প্রদায় গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে অতিজাতিক সংস্থাসমূহ বৃহত্তর এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যে এদের বিনিয়োগ ব্যাপক। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী অতিজাতিক সংস্থাসমূহ বিশ্ববাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশকে নিয়ন্ত্রণ করে।

অতিজাতিক সংস্থাসমূহ বিশ্ব-অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব-রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়। পৃথিবীব্যাপী পুঁজির স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে অতিজাতিক সংস্থাসমূহ সতত সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং অনুরূপ আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কথা বলা যায়। এই সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ পুঁজিই মার্কিন পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ সূত্রে প্রাপ্ত। স্বভাবতই এই সমস্ত সংস্থাসমূহের মাধ্যমে দুনিয়া জুড়ে মার্কিন কর্তৃত্ব কায়েম হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়।

(জ) বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার অনুসঙ্গ হিসাবে বেসরকারী সংগঠন (Non-Government Organisations) সমূহের আবির্ভাব ও ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়। এই সমস্ত বেসরকারী সংস্থা বাজারি পুঁজিবাদ, স্বৈরতান্ত্রিক অচলাবস্থা প্রভৃতির পরিবর্তে পৃথক কোন পথে বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে ভূমিকা পালন করে। এই সমস্ত সংগঠন ‘নাগরিক সমাজ’ (Civil society), বিশ্ব অর্থনীতি, বিকল্প উন্নয়ন প্রভৃতির কথা বলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এই ধরনের বেসরকারী সংগঠন বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব কায়েম করার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ প্রতিপন্ন করে পৃথিবীর পীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনতার উপর প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত বেসরকারী সামাজিক সংগঠনের সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ ঘটে। এই সমস্ত বেসরকারী সংগঠনের তহবিল কোটি কোটি টাকায় সমৃদ্ধ। এই টাকা আসে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছ থেকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এই সমস্ত সংগঠন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সুশিলা রামস্বামী তাঁর Political Theory-Ideas and Concepts শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “More recently, a fact has come to prominence that some groups, aided and abetted by the state power indulge in ethnic cleansing. Besides there are international organizations, human rights groups and self appointed spokesperson for democracy. All these undermine the claim that the state is the moral arbiter of citizen’s lives.”

(ঝ) বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে জাতিরাষ্ট্রসমূহের ভূমিকায় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে পুঁজি বিশ্বায়িত হয়েছে। বিশ্বায়িত পুঁজি অধুনা রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। সমাজবিজ্ঞানী নিনান কোশী তাঁর Political Dimensions of Globalization শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন। রচনাটি ‘Economic and Political Weekly (May 5, 2001) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিনান মন্তব্য করেছেন: “Under global capitalism the mobility of capital has grown in scope, speed and volume. The result is everywhere an increment in the social, economic and political power of capital in relation to labour and states. The new political setting demands a broad-scale review of contemporary nature of capitalism and in particular the relation of state institutions to global and national structures, সাবেকি উদারনীতিবাদের পর রাষ্ট্রসমূহ অধুনা নয়া-উদারনীতিবাদী পথে হাঁটছিল। সাম্প্রতিককালে বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতিরাষ্ট্রসমূহের নয়া-উদারনীতিবাদী কার্যাবলীরও পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রগুলি এখন বিশ্বায়িত পুঁজির প্রভাবাধীন। এই সমস্ত রাষ্ট্র এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অনুপন্থী ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র এখন পৃথিবীব্যাপী পুঁজির পুঞ্জীভবনে সাহায্য করে ও শ্রমশক্তির অবক্ষয় ঘটায়। অধ্যাপক পেত্রাস ও ভেল্টমেয়ার (James Petras and Henry Veltmeyer) তাঁদের Globalisation Unmarked শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই দুইঅধ্যাপক বিশ্বায়িত পুঁজির প্রভাবাধীন রাষ্ট্রসমূহের বিবিধ কাজের উল্লেখ করেছেন। 

  • (এক) অতিজাতিক সংস্থাসমূহের প্রভাবাধীন আর্থনীতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে আর্থিক ও বাণিজ্যিক নীতিসমূহ নির্ধারণ; 

  • (দুই) দুনিয়া জুড়ে আর্থনীতিক ক্রিয়াকর্ম পরিচালনার লক্ষ্যে সহায়ক ও সুসংহত মৌলিক প্রকৃতির শিল্পব্যবস্থা গড়ে তোলা; এবং 

  • (তিন) সমাজব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ ও স্থায়িত্ব সংরক্ষণ। 

এই সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদনের স্বার্থে সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকায় কতকগুলি প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এগুলি হল: বিকেন্দ্রীকরণ, সরকারী ক্রিয়াকর্মের সংকোচন, আধুনিকীকরণের জন্য আধুনিক উপকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা প্রভৃতি। রাষ্ট্রের ভূমিকাগত পরিবর্তনের কারণে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ শক্তিশালী হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা হীনবল হচ্ছে। নিনান কোশী তাঁর Political Dimension of Globalisation শীর্ষক রচনায় এ বিষয়ে বলেছেন: “With the transition from monopoly capitalism, the emergence of global capitalism shifts the balance of class forces towards capital and the result is the decline in the relative autonomy of the state. The logical implication is that important changes in the state will occur when the underlying relations between and among the classes are transformed….. Under global capitalism political change is influenced by a new strategic aspect of the political system within the capitalist class.” সুশিলা রামস্বামী তাঁর Political Theory – Ideas and Concepts শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “In the context of globalization of national politics, hi-tech and emergence of the world economy ‘the national state has become too small for big problems and too big for small problems.”

(ঞ) তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ এবং চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হিসাবে পরিগণিত হয়। পৃথিবীব্যাপী অভিন্ন প্রকৃতির তথ্যাদির সরবরাহকে সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে বিশ্বের উন্নত দেশগুলি যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। এই সমস্ত দেশ বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথ্যাদির কেন্দ্রীকরণের উপর জোর দেয়। আধুনিককালে নিমেষে বিশ্বব্যাপী ইনটারনেটে ও কমপিউটারের মাধ্যমে তথ্যাদির আদান-প্রদান সহজেই সম্পাদিত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে তথ্যাদির কেন্দ্রীকরণের উপরও উন্নত দেশগুলি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। আবার এ ক্ষেত্রেও উন্নত দেশসমূহ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান বর্তমান। কারণ পৃথিবীর প্রধান সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থার সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকটি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে এ. পি., রয়টার প্রভৃতির কথা বলা যায়। এবং এই সমস্ত সংস্থার মালিকানা গুটিকয়েক উন্নত দেশের হাতে ন্যস্ত আছে। এই সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশসমূহ এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। অনেকে একে ‘গণ-মাধ্যম সাম্রাজ্যবাদ’ (Media Imperialism) হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী। এ বিষয়ে সুশিলা রামস্বামী বলেছেন: “Inventions like telephone, internet, radio, television, satellite television and jet planes have resulted in a situation, where the state no longer wields monopoly over information and communications and controls the access of its citizens to information.” নোবেল বিজয়ী সমাজবিজ্ঞানী যোশেফ স্টিগলিট তাঁর Globalisation and its Discontent শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Globalization has reduced the sense of isolation felt in much of the developing world and has given many people in the developing countries access to knowledge will beyond the reach of even the wealthiest in any country a century ago.”

বিশ্বায়নের উপাদানসমূহের মূল্যায়ন

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার উপাদানসমূহ বহু ও বিভিন্ন। উপরিউক্ত উপাদানসমূহ সব নয়। আরও আনুষঙ্গিক অনেক উপাদান আছে। যাইহোক বিশ্বায়নের উপাদানসমূহের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা করা দরকার।

(১) বিশ্বায়ন সমাজ-সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশের ধারায় সৃষ্টি হয়নি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বায়ন অপরিহার্য বা স্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া হীনবল হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদী কার্যকলাপকে সম্প্রসারিত করে। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে পুঁজিবাদী শক্তিসমূহ উৎপাদনের উপকরণে বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধন করে। বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। এ রকম পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের বিকাশশীল দেশসমূহের উপর পুঁজিবাদী শক্তিসমূহের কর্তৃত্ব কায়েম করার জন্য বিশ্বায়নের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

(২) বিশ্বায়নের উপাদানসমূহের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে উল্লিখিত উপাদানসমূহের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য উপাদানসমূহের কথা উল্লেখ করা দরকার। এই বিষয়গুলি হল বিশ্বব্যবস্থায় এক মেরুপ্রবণতা; উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি; মানবাধিকার বিরোধী কার্যকলাপ; কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন; সামাজিক ক্ষেত্রসমূহে মূল্যবোধের নিদারুণ অবক্ষয়; বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তার; সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ভূমিকার অবক্ষয়; সাধারণ মানুষের জীবনধারায় অনিশ্চয়তা ও হতাশার সৃষ্টি প্রভৃতি। বিশ্বায়নের কারণে সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী প্রতিকূল পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশ্বায়নের নতুন নতুন উপাদানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।

(৩) বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান উপাদান হল মুক্তবাজার অর্থনীতি। মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসৃত হওয়ার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং আর্থনীতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের কৃষিনির্ভর দেশগুলির উপর প্রতিকূল পরিস্থিতির মাত্রাতিরিক্ত চাপ পরিলক্ষিত হয়। তার ফলে দরিদ্র দেশসমূহের কৃষকদের দুর্ভাবনা বাড়ছে এবং কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কানকুন সম্মেলনে এই সমস্ত বিষয়াদি নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। 

(৪) নয়া উদারনীতিবাদ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে পরিগণিত হয়। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নয়া উদারনীতিবাদ স্বতন্ত্রভাবে অর্থবহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালে নয়া উদারনীতিবাদের অর্থ কার্যত যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন সহকারে দেশের শাসনকার্য চালান।

(৫) বিশ্বায়নের অন্যতম উপাদান হিসাবে অনুৎপাদক পুঁজির কথা বলা হয়। আগেকার দিনে যে সব পুঁজি উন্নয়নমূলক কর্মসূচীতে বা সরকারী কাজকর্মে ব্যবহার করা হত বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে তার প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। এই সমস্ত পুঁজি কালক্রমে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগে রূপান্তরিত হয়। এই বিদেশী বিনিয়োগ হল প্রকৃতিগত বিচারে অনুৎপাদক পুঁজি। এই পুঁজি বিপুল পরিমাণে ঋণ হিসাবে আসে। সাময়িকভাবে এই পুঁজি উন্নয়নে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে বিশাল ঋণের বোঝা উন্নয়নশীল দেশের আর্থিক মেরুদণ্ডকে পঙ্গু করে দেয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আসা মোট পুঁজির ষাট শতাংশই এ রকম অনুৎপাদক পুঁজি।

(৬) বিশ্বায়নের উপাদান হিসাবে আঞ্চলিক জোট এবং বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির কথা বলা হয়। এসবের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া আছে। এসবের ফলে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সম্পদশালী উন্নত পুঁজিবাদী শক্তিসমূহ অবাধ লুঠতরাজ কায়েম করেছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের কৃষিব্যবস্থা সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বিশ্ববাণিজ্যের নিয়ন্তা হিসাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মত সংস্থাসমূহ নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাণিজ্যিক বিষয়াদিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তিনটি বিষয়ের উপর জোর দেয়। এই তিনটি বিষয় হল: 

  • (১) রপ্তানি বাণিজ্যে ভর্তুকি প্রদান, 

  • (২) দেশের বাজারে সহায়তা প্রদান এবং 

  • (৩) বাজারে সকলের সহজে প্রবেশের পথ প্রদান। 

বিকাশশীল দেশগুলি কিন্তু এই তিনটি ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক অবস্থায় অবস্থিত। এর কারণগুলি ব্যাখ্যা করা দরকার। 

  • রপ্তানি বাণিজ্যে কৃষিক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদান করে। সে সামর্থ্য আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার মত দেশের আছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলি এ ক্ষেত্রে অসমর্থ ও অসহায়। 

  • মুক্ত বাণিজ্য বাজারের জন্য দরকার উপযুক্ত পরিকাঠামো। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহে সে রকম পরিকাঠামো এখনও গড়ে তোলা যায়নি। 

  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ধনী দেশগুলি ঋণপ্রদানের রাজনীতি করে। ঋণের রাজনীতির মাধ্যমে এই সমস্ত সম্পদশালী দেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের আভ্যন্তরীণ বাজারের উপর নিজেদের দখলদারী কায়েম করে। অথচ তাদের নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশের ব্যাপারে বিবিধ প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলতে দ্বিধা করে না। স্বভাবতই উন্নয়নশীল দেশসমূহ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকে।

(৭) বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া কালক্রমে সাম্রাজ্যবাদের এক নয়া অভিব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ নানা অছিলায় বিভিন্ন দেশের উপর নয়া সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। রাসায়নিক বা জৈব গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুত করার অভিযোগের ভিত্তিতে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনী ইরাকের উপর নগ্ন সামরিক অভিযান চালিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ দমনের দোহাই দিয়ে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্থানের উপর অবাধভাবে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে এবং মার্কিন শক্তির বশংবদ একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতাসীন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়ায় জাতি-স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে এবং সেখানে অনুগত শাসককে ক্ষমতায় বসিয়েছে। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন শক্তি তাঁবেদার পুঁজিবাদী শক্তির মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছে এবং স্বাধীন মানুষের গণপ্রতিরোধকে মুড়িয়ে দিয়েছে। এ হল বিশ্বায়নের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের নবতম অভিব্যক্তি। রাজনীতিক চিন্তাবিদ নিনান কোশী তাঁর Political Dimensions of Globalisation শীর্ষক রচনায় এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন। রচনাটি প্রকাশিত হয়েছে Economic and Political Weekly (May 5,2001) পত্রিকায়। তিনি বলেছেন: “The project of global capitalism is an imperialist project, …..Imperialism today is taking place within the context of globalization of capital. It is not a matter of controlling particular territories. It is a matter of controlling a whole world economy and global markets everywhere and all the time. If today’s imperialism does not typically express itself in direct military domination of colonies, this does not mean that. it is very less militaristic than the old variety.”

(৮) অতিজাতিক (Trans-national) সংস্থাসমূহ বিশ্ববাণিজ্যের একটি বড় অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই সমস্ত সংস্থা বিশ্বায়নের বড় উপাদান হিসাবে পরিগণিত হয়। এই সমস্ত সংস্থা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে। এবং এই সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের বাজারকে অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করে। নিজেদের আর্থনীতিক স্বার্থে দরিদ্র দেশের সস্তা শ্রমের উৎসসমূহকে নিগড়ে নেয়। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহে শ্রমমূল্য হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।

(৯) বিশ্বায়নের অন্যতম উপাদান হিসাবে তথ্যের কেন্দ্রিকরণের কথা বলা হয়। তথ্য সাম্রাজ্যবাদ হল বিশ্বায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ। তথ্যের কেন্দ্রীকরণই তথ্য-সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উন্নত পশ্চিমী দেশগুলি নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী একপেশে সংবাদ ও তথ্যাদি পরিবেশনের বিষয়টি পরিচালনার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে। এই পথে পৃথিবীব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত পশ্চিমী দেশসমূহের আধিপত্য কায়েম হয়। সুশিলা রামস্বামী এ বিষয়ে বলেছেন: “Held (1995) pointed out that globalization of information far from creating a common human purpose established the significance of identity and difference.”

বিশ্বায়নের উপাদানসমূহের উপসংহার

বিশ্বায়নের বিকাশ ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে মূল দায়িত্ব হল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার সঙ্গে বিশ্বসমাজব্যবস্থার সামঞ্জস্য সাধন। সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ সাধারণত ক্ষমতার অপব্যবহার করে। স্বভাবতই শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। অবশ্য নিজেদের এ রকম অবস্থান ব্যাখ্যার ব্যাপারে একটি শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ একটি যুতসই যুক্তি দেখায়। তারা বলে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ কোনরকম ন্যায়-নীতি অনুসরণ করে না, নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারেই তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ পায়।

উপরিউক্ত সীমাবদ্ধতা ছাড়াও আর একটি ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা যায়। জাতীয় স্তরে আমলাতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা আন্তর্জাতিক স্তরে অধিকতর শক্তিশালী কলেবরে অভিব্যক্তি লাভ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে আমলাতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মানবাধিকারের মত সার্বজনীন নীতিসমূহের বিকাশ ও বিস্তারে এবং সম্যক সংরক্ষণে সফল হয়নি।

বিশ্বায়নের সাফল্যের স্বার্থে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে অধিকতর সক্রিয় ও সন্তোষজনক ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা সম্ভব করে তোলার জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য হল একটি সক্রিয় আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজ (Civil society) গড়ে তোলা। জাতীয় সীমারেখার মধ্যে নাগরিক সমাজের শক্তিসমূহের দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়। নাগরিক সমাজই সাফল্যের সঙ্গে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে সীমায়িত করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের দিক থেকে একটি সদর্থক ভূমিকা পালন আবশ্যক। শুধুমাত্র স্বার্থের সংরক্ষণ নয়, ন্যায়-নীতি রক্ষার ব্যাপারেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। নাগরিক সমাজের সক্রিয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এটা সম্ভব হতে পারে। পরিশেষে নোবেল বিজয়ী সমাজবিজ্ঞানী যোশেফ স্টিগলিটের একটি অভিমত প্রণিধানযোগ্য। Globalization and its Discontent শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন: “Those who vilify globalization too often overlook its benefits. But the proponents of globalization have been, if anything, even more unbalanced. To them, globalization (which typically is associated with accepting triumphant capitalism, American style) is progress, developing countries must accept it, if they are to grow and to fight poverty effectively. But to many in the developing world, globalization has not brought the promised economic benefits.”