গণতন্ত্রে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জনগণ সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করে অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করে, তার ভিত্তিতে গণতন্ত্র দু’ধরনের হয় :
-
(ক) বিশুদ্ধ বা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র (Pure or Direct Democracy) এবং
-
(খ) পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র (Indirect or Representative Democracy)।
(ক) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র:
প্রত্যক্ষভাবে গণতন্ত্রই হল বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। প্রত্যক্ষ জনগণ সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে। এ রকম শাসনব্যবস্থায় জনগণই সরকারী যাবতীয় কাজ নিজেরাই সম্পাদন করে। প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে (city-states) এ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নাগরিকগণ নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্ধারিত স্থানে মিলিত হয়ে আইন প্রণয়ন করত সরকারী কর্মচারী নিয়োগ করত, রাজস্ব ও ব্যয় নির্ধারণ করত, পররাষ্ট্র ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এমনকি তারা বিচারবিভাগীয় কার্যাদিও সম্পাদন করত। এইভাবে নাগরিকদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাই হল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সকল নাগরিক রাষ্ট্রকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। তাই এই শাসনব্যবস্থাকে অংশ গ্রহণকারী গণতন্ত্র (Participatory Democracy)-ও বলা হয়। নাগরিকরা আইন প্রণয়ন ও শাসন-সংক্রান্ত অন্যান্য কাজ করার জন্য যে জায়গায় মিলিত হত এথেন্সে তাকে বলা হত ‘এক্লেসিয়া’ (Ecclesia of Athens)। রোমে এই স্থানটির নাম ছিল ‘মিলিশিয়া’ (Militia of Rome)।
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষেও বিভিন্ন স্থানে বহু নগর-রাষ্ট্র ছিল। সেগুলিতেও প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল। অনেকের মতে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় সিন্ধুনদের উভয় তীরে নগর-রাষ্ট্র ছিল। প্রাচীন রোমেও এ রকম প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ছিল।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বর্তমানে বিরল:
একথা বলাই বাহুল্য যে, প্রাচীন গ্রীসীয়, রোমক বা ভারতীয় নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট এবং স্বল্প জনসংখ্যা সমন্বিত। তাই জনগণের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করার ব্যাপারে কোন অসুবিধা ছিল না। সেই সময়কার সমস্যাদি ছিল সংখ্যায় কম এবং সহজ সরল প্রকৃতির। এই কারণে স্বল্প সংখ্যক জনগণ সহজে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বিশেষ সময়ে সমবেত হয়ে সমস্যাদির সমাধান ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারত। কিন্তু বর্তমানকালে প্রতিটি রাষ্ট্রের আয়তন বিশাল এবং জনসংখ্যা বিপুল। তা ছাড়া, আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের সমস্যাগুলিও সংখ্যায় বেশি ও বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আইনের সংখ্যা হয়েছে বহু এবং প্রকৃতি হয়েছে অত্যন্ত জটিল। সাধারণ মানুষের পক্ষে দেশের প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করা আজ এক রকম অসম্ভব। এখন জনগণের দ্বারা সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনার কথা ভাবা যায় না। সেজন্য এরূপ শাসনব্যবস্থা বর্তমানে বিরল। তবে সুইজারল্যান্ডের ক্ষুদ্রাকৃতির চারটি ‘ক্যান্টন’ ও ‘অর্ধ-ক্যান্টনে’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্থানীয় সরকার পরিচালনায় এই ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত দেখা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের ২৬টি ক্যান্টনে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সুবিধা:
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কতকগুলি সুবিধার কথা বলা হয়। (১) গণতন্ত্র বলতে ‘জনগণের শাসনকে বোঝায়। এ দিক থেকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রই হল প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। (২) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। তার ফলে জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। (৩) জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের জন্য এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তার ফলে সরকার বিপ্লব-বিদ্রোহের আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকে। (৪) প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন হল সহজ ও সরল প্রকৃতির। কারণ এখানে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগীয় কাজকর্মের মধ্যে তেমন সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকে না। (৫) অনেকের মতে এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় শ্রেণীবিরোধের সম্ভাবনা বড় একটা থাকে না। (৬) স্বল্প জনসংখ্যা ও ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রের পক্ষে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হল আদর্শ শাসনব্যবস্থা। (৭) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়। (৮) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ব্যয়বাহুল্যের ত্রুটি থেকে মুক্ত।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অসুবিধা:
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটিও আছে। (ক) বৃহদায়তনবিশিষ্ট ও জনবহুল রাষ্ট্রের পক্ষে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা অনুপযোগী। (খ) রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি সাধারণ নাগরিকদের থাকে না। (গ) এ ধরনের শাসনব্যবস্থা বিশৃঙ্খলার ত্রুটিযুক্ত। তার ফলে জনস্বার্থের হানি ঘটার আশঙ্কা থাকে। (ঘ) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে কার্যত অল্পসংখ্যক লোকই শাসনকার্য পরিচালনায় যোগ দেয়। তার ফলে গোষ্ঠী স্বার্থে শাসনকার্য পরিচালিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। (ঙ) সাধারণ মানুষ অশিক্ষিত ও অজ্ঞ হলে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র নিকৃষ্ট শ্রেণীর শাসনে পরিণত হয়। (চ) এ ধরনের শাসনব্যবস্থা জরুরী অবস্থার উপযোগী নয়। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে দেশের সকল মানুষ মিলিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে এভাবে দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। (ছ) সাধারণত জনগণ কোন বিষয়ে সহজে একমত হতে পারে না। এই মতানৈক্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়া শাসনকার্যে পরিলক্ষিত হয়। (জ) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে আইন, শাসন ও বিচার-বিভাগীয় কাজকর্মের মধ্যে তেমন সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকে না। তার ফলে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত না হওয়ায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। (ঝ) আজকের দিনের জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের কর্মমুখর শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র উপযুক্ত বিবেচিত হয় না।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অসুবিধাগুলি অস্বীকার করা যায় না। এতদ্সত্ত্বেও যথার্থ গণতন্ত্র হিসাবে এর উপযোগিতা অনস্বীকার্য। এই কারণে এখনকার পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুবিধাগুলি সংরক্ষণের জন্য গণ-ভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়।
(খ) পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র:
বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে এই প্রতিনিধিমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্রকেই বোঝায়। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে জনগণ নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচনের দ্বারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপরই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। জনগণ এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। একেই পরোক্ষ গণতন্ত্র বলে। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতানুসারে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র হল এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণের সমগ্র অংশ বা অধিকাংশ নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা ব্যবহার করে (It is a form of Government where “….the whole people or some numerous portion of them exercise the governing power through deputies, periodically elected by themselves.”)। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় সরকারের আইন ও শাসন-বিভাগ সব সময় জনমতের অনুকূলে কাজ করে। পরোক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাই হল জনসাধারণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রধান যোগসূত্র। বৃহৎ এবং জনবহুল রাষ্ট্রের পক্ষে এই পরোক্ষ গণতন্ত্রই কাম্য।
পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিরা আইনসভায় মিলিত হয়ে আইন প্রণয়ন করেন। তাঁরা শাসনবিভাগকে অল্পবিস্তর নিয়ন্ত্রণ করেন। শাসনবিভাগের প্রধান প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন (মার্কিন রাষ্ট্রপতি); আবার আইনসভায় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাও মনোনীত হন (ভারতের প্রধানমন্ত্রী)। জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অসন্তোষজনক হলে, জনগণ তাদের পুনর্নির্বাচিত নাও করতে পারে। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণ দেশের শাসনকার্য পরোক্ষভাবে পরিচালনা করে। এই কারণে এ ধরনের শাসনব্যবৱা পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত। এই শাসনব্যবৱায় জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রযু হয়।
পরোক্ষ গণতন্ত্রের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বর্তমান: (ক) নাগরিকরা আইনপ্রণেতা ও শাসকগোষ্ঠীকে নির্বাচিত করে; (খ) প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃত থাকে; (গ) জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের কার্যকালে নির্বাচকদের অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করে; (ঘ) নির্ধারিত কার্যকালের পরে জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়ী থাকেন।
অনেক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান নাগরিকদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন না। মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে একটি নির্বাচকমণ্ডলী। ভারতের ক্ষেত্রেও একথা অল্পবিস্তর প্রযোজ্য। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যববায় রাষ্ট্রপ্রধান রাজা বা রানী উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতাসীন হন। তবে ভারত বা ব্রিটেনের প্রকৃত প্রশাসনিক প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই প্রধানমন্ত্রী হন।
আধুনিককালের বৃহদাকৃতির ও সমস্যাবহুল দেশে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবৱাই বিশেষভাবে উপযোগী। তবে এই শাসনব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত নয়। জনপ্রতিনিধিরা সব সময় জনমতের অনুগামী ভূমিকা নাও পালন করতে পারেন। এ রকম ক্ষেত্রে জনসাধারণকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তখন নির্বাচকরা জনবিরোধী প্রতিনিধিকে পুনর্নির্বাচিত না করার সুযোগ পান।
Leave a comment