স্বাধীনতার প্রকৃতি সমাজের আর্থিক কাঠামোর উপর নির্ভরশীল:
সকল সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতার ধারণা ও প্রকৃতি একই রকমের হয় না। ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক আদর্শের অনুগামী অ-সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রচলিত স্বাধীনতার ধারণা এবং গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রচলিত স্বাধীনতার ধারণা অভিন্ন নয়। সমাজতান্ত্রিক দেশে স্বাধীনতার প্রকৃতি মার্কসীয় তত্ত্বের অনুগামী। মার্কসবাদ অনুসারে সমাজব্যবস্থার আর্থনীতিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী তাত্ত্বিকগণ নেতিবাচক স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী নন। কোন বিশেষ সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতার প্রকৃতি সেই সমাজব্যবস্থায় বর্তমান আর্থিক কাঠামোর উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ সমাজের আর্থিক কাঠামোই স্বাধীনতার প্রকৃতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার প্রকৃতির উপর মানুষের কর্তৃত্বের পর্যায় ও আর্থনীতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা সম্প্রসারিত হয়েছে।
আদিম সাম্যবাদী সমাজে স্বাধীনতা:
আদিম সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদনের সকল উপাদানের উপর সমগ্র সমাজের মালিকানা ছিল। সমাজে কোনো শ্রেণীবৈষম্য বা শ্রেণীশোষণ ছিল না। সমাজের নারী-পুরুষ সকলে সব রকম স্বাধীনতা সমানভাবে ভোগ করত। তবে এই আদিম সাম্যবাদী সমাজে প্রকৃতির উপর মানুষের কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা ছিল সীমিত। এ সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল না, তাই আইনের দ্বারা স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যাপারও ছিল না। মরিস কর্নফোর্থ বলেছেন: “In primitive societies, people’s freedom was restricted mainly by their lack of mastery over nature.”
দাস সমাজের স্বাধীনতার প্রকৃতি:
দাস সমাজে সর্বপ্রথম শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীশোষণের সূত্রপাত ঘটে। শ্রেণীবিভক্ত এই সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে এবং রাষ্ট্র দাস-মালিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণে নিযুক্ত হয়েছে। এখানে পরশ্রমভোগী মুষ্টিমেয় দাস-মালিকরাই সকল স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। সংখ্যাগরিষ্ঠ দাসদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। এমনকি জীবনের অধিকারও ছিল না। বস্তুত দাসরা দাস-মালিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত। লেনিন বলেছেন: “The slaves enjoyed no rights and constituted and oppressed class; they were not regarded as human beings.” দাস-সমাজে নারীর উপর পুরষের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমাজে নারীর কোনো রকম স্বাধীনতা ছিল না।
সামন্ত সমাজে স্বাধীনতার প্রকৃতি:
সামন্ত সমাজে উৎপাদনের উপাদানের উপর সামত্ত শ্রেণীর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় রাষ্ট্রযন্ত্র, আইন প্রভৃতি সামন্ত শ্রেণীর অধিকার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণে নিযুক্ত হয়। এই সমাজে সংখ্যালঘু সামন্ত প্রভুরাই সকল স্বাধীনতা ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। কৃষকদের কোন অধিকার বা স্বাধীনতা ছিল না। তবে তাদের বাঁচার স্বাধীনতা ছিল। দাস-মালিকদের মতো সামন্ত প্রভুরা তাদের খুশিমত হত্যা করতে পারত না। এই সময় কৃষকদের মত নারীও সবরকম স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল।
ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীশোষণ নতুন রূপ ধারণ করে। এই সমাজে মূলধনের মালিক মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণী বিত্তহীন সংখ্যাগুরু শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করে। এই সমাজব্যবস্থায় (১) উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধনতন্ত্রকে স্বাভাবিক অবস্থা বলে মনে করা হয়; (২) নেতিবাচক অর্থেই স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়; (৩) আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে রাজনীতিক অধিকার ও স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং (৪) স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর শাসনকে স্বাধীনতার অঙ্গ হিসাবে মনে করা হয়। এই সমাজে জনসাধারণের প্রকৃত স্বাধীনতা অসম্ভব।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার প্রকৃতি:
পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাগুলি স্বীকৃত ও কার্যকরী হয়। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে অবহেলা করা হয়। যে সকল স্বাধীনতা এইসব সমাজে গুরুত্ব পেয়ে থাকে সেগুলি হল: বাক্-স্বাধীনতা, নির্বাচন করার অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, যে-কোন বৃত্তি অবলম্বনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি। তা ছাড়া এই সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করার ব্যাপারে নাগরিকদের স্বাধীনতা থাকে। নাগরিক জীবনের স্বাধীনতা ব্যতীত বিচার-বিভাগের স্বাধীনতাও স্বীকার করা হয়। কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাসমূহের স্বীকৃতি আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অসাম্য-বৈষম্যের অস্তিত্বের দরুন মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অভাব হেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অধিকাংশ রাজনীতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার যথাযথভাবে ভোগ করার উপযুক্ত সুযোগ পায় না। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন-উপাদানগুলির ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদকের সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের স্বাধীনতা থাকে। বেসরকারী মালিকানায় উৎপাদন, শিল্প-বাণিজ্য পরিচালিত হয়। তাই মুষ্টিমেয় মালিকশ্রেণী সম্পদ বৃদ্ধির স্বাধীনতা ভোগ করে। এতে আয় ও ধনবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। স্বাভাবিকভাবে সর্বসাধারণের স্বাধীনতা শূন্যগর্ভ স্বাধীনতায় পরিণত হয়।
সমাজতন্ত্রে জনগণের স্বাধীনতা:
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক কাঠামো বদলে যায়। এই সমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা অস্বীকৃত। এখানে উৎপাদনের উপাদানের উপর সমগ্র সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষের শোষণের অবসান ঘটে। এই সময় জনগণের স্বাধীনতার যথার্থ প্রকাশ ঘটে। কর্নফোর্থ বলেছেন: “In socialist society, when there is no exploitation of man by man and when the means of production are common property….people begin less to struggle for freedom than to enjoy it and learn how to go forward to exercise it to the full.” শ্রেণীহীন, শোষণহীন মুক্ত সমাজব্যবস্থাই হল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার যথার্থ অবস্থা। এঙ্গেলসের মতানুসারে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আগে পর্যন্ত সামাজিক সংগঠন ছিল প্রকৃতি ও ইতিহাস থেকে চাপানো এক আবশ্যিকতা। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা হয়ে দাঁড়ায় মানুষের স্বাধীন কর্মের ফল। এ হল আবশ্যিকতার রাজ্য থেকে স্বাধীনতার রাজ্যে উত্তরণ। তিনি বলেছেন: “It is the ascent of man from the kingdom of necessity to the kingdom of freedom.”
সমাজতন্ত্রে স্বাধীনতার স্বরূপ:
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মার্কসীয় দর্শন অনুসারে আর্থনীতিক স্বাধীনতার তাৎপর্য হল কাজের অধিকার, সর্বপ্রকার আর্থনীতিক শোষণ থেকে মুক্তি, আয় ও সম্পত্তির অসাম্য দূরীকরণ প্রভৃতি। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অসাম্যের অবসান ঘটলে রাজনীতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ভোগের অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। মার্কসবাদী ধারণা অনুযায়ী সামাজিক, রাজনীতিক এবং আর্থনীতিক স্বাধীনতা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিচ্ছিন্নভাবে কোন স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। সমাজ-তান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদান ও সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সমাজে সকলের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণের স্বাধীনতার ধারণা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই কেবল বাস্তবে রূপায়িত হয়। তবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে স্বাধীনতা ভোগের কিছু তাৎপর্য আছে। এখানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্বাধীনতা স্বীকার ও ভোগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা কোনভাবেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধী হতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে একটি মাত্র রাজনীতিক দল থাকে। এই দলের কর্মসূচী মেনে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ভোগ করতে হয়। এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় না। এখানে স্বাধীনভাবে রাজনীতিক দল গঠন করার অধিকার থাকে না। আবার সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তিতে স্বাধীনতা ভোগের সঙ্গে নাগরিকদের কতকগুলি মৌলিক কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়।
Leave a comment