বর্তমানে নাটক ও নাট্যশিল্প বলতে আমরা যা বুঝি, তার সঙ্গে আমাদের এদেশীয় প্রাচীন ও মধ্যযুগের নাট্যকলার রূপ ও রীতির বিশেষ কোন প্রত্যক্ষ যোগ আছে বলে মনে হয় না। বরং অষ্টাদশ শতকে ইংরেজি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্পর্শে আসার পর ইংরেজদের নির্মিত রঙ্গমঞ্চে ইংরেজি নাটকের অভিনয় দেখেই নূতন নাট্যরসপিপাসা জেগেছিল আমাদের। মধ্যযুগের মধ্য দিয়ে রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতির যে প্রগতির রূপ ও রীতি চলে আসছিল তা প্রায় সর্বাংশেই বর্জিত হয়েছিল উনিশ শতকের নাট্যশিল্পে, আর এর মূলে প্রত্যক্ষ প্রেরণা দিয়েছে ইংরেজদের রঙ্গমঞ্চে ইংরেজি নাটকের অভিনয়।

তবুও আমাদের এদেশীয় নাট্যকলার এবং রঙ্গমঞ্চের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রূপ ও রীতির বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারণা সংগ্রহ করা যেতে পারে। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত-সমৃদ্ধ সাহিত্যসম্ভার আমাদের সম্পদ। আর এই সাহিত্যের অংশ সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের ঐতিহ্যও গৌরবের। সংস্কৃত নাটকের গৌরবময় যুগ মূলতঃ ষষ্ট শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত। এই পাঁচ শতাব্দীর স্মরণীয় নাট্যকারদের মধ্যে অশ্বঘোষ, ভাস, শূদ্রক, কালিদাস, শ্রীহর্ষ, ভবভূতি, বিশাখদত্ত, মুরারী, রাজশেখর প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে।

কিন্তু এঁদেরও পূর্বের নাট্যকলার পরিবেশন তথ্য পাওয়া যায়। ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখ আছে— দেবরাজ মহেন্দ্রের বিজয়াৎসব’কে কেন্দ্র করে ‘দেবাসূর যুদ্ধ’ অভিনীত হয়েছিল। এই অভিনয়-অনুষ্ঠানের রীতি ও প্রয়োগ পদ্ধতি এবং নির্দেশনার জন্য দেবতাদের অনুরোধে ব্রহ্মা চারটি বেদ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে পঞ্চম বেদ ‘নাট্যবেদ’ সৃষ্টি করেন। প্রথম নাটক ‘দেবাসুর যুদ্ধ’ সম্ভবত মুক্ত প্রাঙ্গণেই অভিনীত হয়েছিল, কিন্তু অসুরদের অত্যাচারে নাটকটির অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে পারে নি। তাই ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে ‘নাট্যবেশ্ম’ নির্মাণের আদেশ দেন এবং এর ফলেই ‘নাট্যগৃহ’ নির্মিত হয়। এর পর থেকেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অভিনয়ের পরিবর্তে নাট্যগৃহের অভ্যন্তরে অভিনয় অনুষ্ঠান হতে সুরু করে। গ্রীসেও প্রাচীন যুগে দেবী ডায়োনিসাসের মন্দির সংলগ্ন উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অভিনয় অনুষ্ঠান হত এবং পরবর্তীকালে নাট্যগৃহের অভ্যন্তরে অভিনয় সুরু হয়।

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের নাট্যগৃহ বা রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের পরিচয় আছে। আকৃতি অনুসারে রঙ্গমঞ্চ তিনপ্রকার ছিল, বিকৃষ্ট (আয়তক্ষেত্রকার), চতুরাশ্র(বর্গাক্ষেত্রাকার) এবং ত্র্যস্র(ত্রিভূজাকার)। আবার প্রতিটি নাট্যগৃহের ছিল তিনটি অংশ দর্শকদের অংশ, অভিনয়ের মঞ্চ এবং নেপথ্য গৃহ (auditorium, stage and green room)। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত এই নাট্যগৃহের নির্মাণ কৌশল অত্যন্ত উন্নত মানের ছিল, সন্দেহ নাই। কালিদাস, ভবভূতি প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ সংস্কৃত নাট্যকারগণের নাটকগুলির অভিনয় ভরত-বর্ণিত রঙ্গমঞ্চে অথবা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হত, সে সম্পর্কে মোটেই জানা যায় না।

মধ্যযুগে মুসলমান নবাবী আমলেও রূপ গোস্বামী, কবিকর্ণপুর অথবা রামানন্দ রচিত সংস্কৃত নাটকগুলি সম্ভবতঃ মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রাচীন যাত্রা রীতিতেই অভিনীত হয়েছিল মনে হয়। অন্ততঃ ‘চৈতন্যভাগবত’ এবং ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে চন্দ্রশেখরের গৃহে চৈতন্যদেবের কৃষ্ণলীলা অভিনয়ের বর্ণনা থেকে এইরকমই অনুমান করা যায়।

প্রকৃতপক্ষে ভরত কথিত রঙ্গমঞ্চের উদ্ভবের পরও মুক্ত প্রাঙ্গণে যাত্রারীতির অনুষ্ঠানও চলত। এই যাত্রারীতি লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান মাধ্যমরূপেই প্রযুক্ত হত। রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা এবং লৌকিক মঙ্গল— দেব-দেবীর (শিব, চণ্ডী, মনসা প্রভৃতি) মাহাত্ম্যপ্রচারমূলক কাহিনীর নাট্যরূপ মুক্ত প্রাঙ্গণে বৃত্তাকার মঞ্চে যাত্রা রীতিতেই অনুষ্ঠিত হত। যাত্রাপালা রচিত হত জনপ্রিয় পয়ার ছন্দে এবং সংলাপের চেয়ে সঙ্গীতের বাহুল্য ছিল। বৃত্তাকার মঞ্চে এই যাত্রানুষ্ঠান উনিশ শতকে প্রথমার্ধে ‘নূতন যাত্রা’য় পরিণত হল। সমকালীন পাশ্চাত্ত্য পদ্ধতি অনুকরণে নির্মিত রঙ্গমঞ্চে অনুষ্ঠিত নাট্যানুষ্ঠানের প্রত্যক্ষভাবেই এই নূতন যাত্রা’র উদ্ভব হয়েছিল। এই নূতন যাত্রাই গীতাভিনয় বা অপেরা নামে পরিচিত হল। এই যাত্রায় সবকিছুই রঙ্গমঞ্চে অভিনীত নাটকের মতই, কিন্তু রঙ্গমঞ্চের পরিবর্তে বৃত্তাকার মঞ্চে অভিনীত হত, এর চারপাশেই দর্শক শ্রোতৃবৃন্দ বসত।