সমাজের প্রকৃতির উপর রাষ্ট্রের প্রকৃতি তথা রাষ্ট্রের কার্যাবলী নির্ভরশীল। এই কারণে বিভিন্ন যুগে সামাজিক ও আর্থনীতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কিত আলোচনা করা আবশ্যক। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন অনুসারে বিভিন্ন যুগে রাষ্ট্রের কার্যাবলী প্রসঙ্গে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রাচীন গ্রীক যুগ: প্রাচীন গ্রীসের ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি মানুষের সমগ্র জীবন জুড়ে বিস্তৃত ছিল। গ্রীক দার্শনিকগণ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য করেননি। প্রাচীন গ্রীসের নগরগুলিই ছিল রাষ্ট্র। নাগরিক জীবনের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধনই ছিল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নাগরিক জীবনের পৃথক অস্তিত্ব অস্বীকৃত ছিল। গ্রীক নগর-রাষ্ট্রের (city-state) মধ্যেই নাগরিক জীবনের পরিপূর্ণতা ছিল। এই সময় রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক, মানসিক, ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব গ্রীক নগর-রাষ্ট্রে অস্বীকৃত।
রোমক যুগ: রোমক যুগে রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কিত গ্রীক ধারণার আংশিক পরিবর্তন ঘটে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রোমান আইনে সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়। পারিবারিক স্বাধীনতা, প্রথা, ধর্ম প্রভৃতি কিছু কিছু বিষয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়। তারফলে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি কিছুটা সংকুচিত হয়। এতদ্সত্ত্বেও রাষ্ট্রের নির্দেশ ছিল চরম। তা সকলকে নির্দ্বিধায় মান্য করতে হত। রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করা যেত না। প্রকৃত প্রস্তাবে রোমক যুগে রাষ্ট্রের ইচ্ছা অনুসারে রাষ্ট্রের কার্যাবলীর সীমা নির্ধারিত হত।
মধ্যযুগ: মধ্যযুগে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সময় খ্রীষ্টধর্মের প্রসার এবং টিউটন জাতির অভ্যুত্থান ঘটে। চার্চ ও পোপ প্রচার করেন যে, সমাজজীবনের ধর্মীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অভিপ্রেত নয়। এইভাবে ব্যক্তিজীবনের উপর চার্চের প্রভাব পড়ে। তার ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই সময় আবার সামস্ততন্ত্র বর্তমান ছিল। সামন্তপ্রভুরা যে যার এলাকায় সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে পড়ে। সরকার ও সামন্তপ্রভুদের মধ্যে ক্ষমতা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতার এই বিভাজনের ফলে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অধিকারের ধারণা সৃষ্টি হয়। এইভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলী ক্রমশ সীমাবদ্ধ হয়।
ষোড়শ শতাব্দী: ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মসংস্কার আন্দোলন (Reformation) হয়। রাজার ক্ষমতা ঈশ্বরীয় ক্ষমতা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপে শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের (National Monarchies) উদ্ভব হয়। তারফলে চার্চের প্রভাব হ্রাস পায় এবং সামন্ত শক্তি হীনবল হয়। এই সময় আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে রাজা তথা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্প্রসারিত হয়।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী: সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজন্যবর্গের চরম ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৃদ্ধিকে প্রতিহত করার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। চুক্তিবাদী ইংরাজ দার্শনিক লক-এর রাজনীতিক তত্ত্ব এবং ইংল্যাণ্ডের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিধির উপর সীমা আরোপ করে। এই সময় ইংল্যাণ্ড ও হল্যাণ্ডে ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবী সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্যক্তি-স্বাধীনতার অনুকূলে তত্ত্বগত ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অবাধ বাণিজ্যের নীতি (Laissez Fair) ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দী: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে সংকুচিত করার কথা প্রচার করা হয়। বলা হয় যে, সম্পত্তির অধিকার, চুক্তির অধিকার ও ব্যক্তির নিরাপত্তা সংরক্ষণ এবং বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার মধ্যেই রাষ্ট্রের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ। ব্যক্তিজীবনের সাফল্যের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা বর্তমান থাকবে। এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটে এবং তারফলে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সংকুচিত হয়। এই সময় প্রচার করা হয় যে ব্যক্তি তার পরিপূর্ণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। জন স্টুয়ার্ট মিল (J.S. Mill) বলেছেন: “Over himself, over his own body and mind, the individual is sovereign.”
বিংশ শতাব্দী: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে তার অবাধ প্রতিযোগিতার ফলে দেশের যাবতীয় সম্পদ-সামগ্রী মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির কুক্ষিগত হয়। তারফলে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি সম্পদশালী হয়ে উঠে এবং শ্রমিক, কৃষক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী দুঃখ-দারিদ্র্য ও শোষণের শিকার হয়। এক সময় আপামর জনসাধারণের দারিদ্র্য ও বঞ্চনা প্রকট হয়ে পড়ে। এই অবস্থার অবসানের জন্য বিভিন্ন দেশে আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেক দেশে বিভিন্ন সংস্কারমূলক আইন প্রণীত হয়। তা ছাড়া রাজনীতিক ক্ষেত্রে ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ ঘটে। এইভাবে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটতে থাকে এবং রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অবসান এবং সমষ্টিবাদের অভ্যুত্থান এইভাবে সম্পন্ন হয়।
সমষ্টিবাদ: সমষ্টিবাদে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে সম্প্রসারণের কথা বলা হয়। সমষ্টিবাদকে পূর্ণ ও আংশিক এই দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। পূর্ণ সমষ্টিবাদ সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (socialism) হিসাবে পরিচিত। এই মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে সমষ্টিগত এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। অর্থাৎ পূর্ণ সমষ্টিবাদ সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সম্পূর্ণ অবসানের পক্ষপাতী। আংশিক সমষ্টিবাদকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্ব (Welfare state) বলা যেতে পারে। আংশিক সমষ্টিবাদী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সমাজকল্যাণকর ভূমিকা গ্রহণ করে ব্যক্তিজীবনের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন। এই মতবাদে জনকল্যাণ সাধনের স্বার্থে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধির বিস্তার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। আংশিক সমষ্টিবাদীরা জনকল্যাণের স্বার্থে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের হাতে জনকল্যাণের দায়িত্ব ন্যস্ত করার কথা বলেন। এঁরা আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সম্পূর্ণ অবসানের পক্ষপাতী নন। এঁরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সমন্বয় সাধনের পক্ষপাতী। এই তত্ত্বে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অবসানের কথা বলা হয় না। কিন্তু মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে, এ ধরনের জনকল্যাণকর রাষ্ট্র সকল মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করতে পারে না। এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব অস্বীকৃত। তাই সমাজ এখানে শ্রেণীবিভক্ত। এ রকম ধনবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্রশক্তি বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত থাকে। অর্থাৎ এই রাষ্ট্র পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। মার্কসবাদীদের মতানুসারে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রকৃত জনমুখী কার্য সম্পাদিত হওয়া সম্ভব।
উপসংহার: বর্তমান পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক পথের পথিক। এমনকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী পশ্চিমী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিও আপামর জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে। তারফলে সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি অস্বাভাবিকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
Leave a comment