মানুষের প্রধান অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ হল কৃষিকাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়ে থাকে। কৃষিকাজের এই বিভিন্নতা নির্ভর করে একটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক এবং আর্থসামাজিক পরিবেশের ওপর। কৃষিকাজের পদ্ধতিকে কৃষি প্রণালী বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বা অঞ্চলের কৃষি প্রণালীর শ্রেণিবিভাগ নীচে আলােচনা করা হল一
(১) শস্য-উৎপাদনের পরিমাণ ও বাজার ভিত্তিতে一
-
আদিম জীবিকাসত্তাভিত্তিক কৃষি
-
স্থানান্তর কৃষি,
-
স্থায়ী কৃষি
-
বাণিজ্যিক কৃষি,
-
বাগিচা কৃষি,
-
উদ্যান কৃষি,
-
মিশ্র কৃষি
(২) কৃষিজমির পরিমাণ এবং জনসংখ্যার তারতম্য ভিত্তিতে一
-
নিবিড় কৃষি,
-
ব্যাপক কৃষি
(৩) আর্দ্রতার তারতম্য ভিত্তিতে一
-
আর্দ্র কৃষি,
-
শুষ্ক কৃষি,
-
সেচ কৃষি
(৪) কৃষিজমি ব্যবহারের পৌনঃপৌনিকতা ভিত্তিতে一
-
এক-ফসলি কৃষি,
-
দো-ফসলি কৃষি,
-
বহু ফসলি কৃষি,
-
ইন্টারক্রপিং,
-
শস্যাবর্তন
(৫) ঋতুর তারতম্য ভিত্তিতে一
(৬) আঞ্চলিক বিশেষীকরণের তারতম্য ভিত্তিতে一
-
মৌসুমি কৃষি,
-
ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি
শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ও বাজারের ভিত্তিতে
(১) আদিম জীবিকাসত্তাভিত্তিক কৃষি : প্রধানত ভরণ-পােষণের তাগিদে গ্রাম্য পরিবেশে যে কৃষিকাজের দ্বারা কৃষক তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদ্যের সংস্থান করে তাকে আদিম জীবিকসত্তাভিত্তিক কৃষি বলে। এই কৃষি প্রণালীকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা一
-
স্থানান্তর কৃষি : যে অস্থায়ী কৃষিব্যবস্থায় অনুন্নত জনগােষ্ঠী প্রাচীন বা আদিম পদ্ধতিতে কেবল নিজেদের জীবিকার প্রয়ােজনে শস্য উৎপাদন করে তাকে স্থানান্তর কৃষি বলে। আফ্রিকায় (কঙ্গো প্রজাতন্ত্র), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (ভারত, শ্রীলঙ্কা) এই কৃষিব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়।
-
স্থায়ী কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় ক্রান্তীয় অঞ্চলের কোনাে কোনাে অংশের অনাবাদি জমিগুলিকে কর্ষণ করে উপজাতি গােষ্ঠীর অধিবাসীরা নিজেদের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য শস্য উৎপাদন করে তাকে স্থায়ী কৃষি বলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে (ভারত, পাকিস্তান), ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যে দেখতে পাওয়া যায়।
(২) বাণিজ্যিক কৃষি : বিরল বসতিযুক্ত অঞ্চলে অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি প্রয়ােগ করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যখন শস্য উৎপাদন করা হয় তখন তাকে বাণিজ্যিক কৃষি বলে। ইউরেশিয়ার স্তেপ তৃণভূমি, উত্তর আমেরিকার প্রেইরি, দক্ষিণ আমেরিকার পম্পাস-এ এই কৃষি পদ্ধতি দেখা যায়।
(৩) বাগিচা কৃষি : ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে প্রচুর মূলধন, স্থানীয় শ্রমিক, উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, উন্নত পরিকাঠামাে, সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার সাহায্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে রপ্তানি নির্ভর কৃষি প্রণালী গড়ে উঠেছে, তাকে বাগিচা কৃষি বলে। ভারতের চা চাষ, মালয়েশিয়ার রবার চাষ, ব্রাজিলের কফি চাষ প্রভৃতি বাগিচা কৃষির উদাহরণ।
(৪) উদ্যান কৃষি : যে বাজারভিত্তিক কৃষিব্যবস্থায় আধুনিক পদ্ধতিতে বৃহদায়তনে তরিতরকারি, ফল ও ফুলের চাষ করা হয় তাকে উদ্যান কৃষি বলে। উত্তর-পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলিতে (জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি) এই কৃষি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে।
(৫) মিশ্র কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় একসঙ্গে ফসল উৎপাদন ও পশুপালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমন্বয় ঘটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে অথচ অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিহীন কৃষিকাজ গড়ে ওঠে তাকে মিশ্র কৃষি বলে। ভারতে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও গুজরাতে মিশ্র কৃষি গড়ে উঠেছে।
কৃষি জমির পরিমাণ ও জনসংখ্যার তারতম্যের ভিত্তিতে
(১) নিবিড় কৃষি : জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বেশি থাকায় খাদ্যের চাহিদা মেটাতে যতটা সম্ভব বেশি শ্রম ও পুঁজি বিনিয়ােগ করে কম পরিমাণ জমি থেকে যে পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা হয় তাকে নিবিড় কৃষি বলে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনবহুল নদীগঠিত সমভূমিতে ধান চাষ, কিংবা উত্তর-পশ্চিম ইউরােপে গম, শালগম, বার্লি প্রভৃতি ফসল উৎপাদন এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন কৃষির মূল বৈশিষ্ট্য।
(২) ব্যাপক কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় কম কায়িক শ্রম অথচ কৃষি যন্ত্রপাতি ও জড় শক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে একসঙ্গে বিশাল আয়তনের জমি চাষ করা হয়, তাকে ব্যাপক কৃষি বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ব্যাপক কৃষি পদ্ধতিতে গম চাষ করা হয়।
আর্দ্রতার তারতম্যের ভিত্তিতে
(১) আর্দ্র কৃষি : জলসেচের সাহায্য ছাড়া নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাতের (150 সেমির বেশি) ওপর নির্ভর করে যে কৃষিকাজ করা হয়, তাকে আর্দ্র কৃষি বলে। মধ্য আমেরিকা ও ব্রাজিলেও আদ্র কৃষির প্রচলন আছে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৌসুমি বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে আর্দ্র কৃষি পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ হয়।
(২) শুষ্ক কৃষি : যেসব অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম সাধারণত 50 সেমির নীচে এবং জলসেচের সুবিধা নেই সেইসব অঞ্চলে খরা সহ্যকারী শস্যের চাষকে শুষ্ক কৃষি বলে। জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, সালগম প্রভৃতি দানাশস্য এই কৃষির প্রধান ফসল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে (রাজস্থান, পাঞ্জাব, গুজরাত রাজ্যে) এই কৃষি পদ্ধতি প্রচলন আছে।
(৩) সেচ কৃষি : শস্যের জন্য প্রয়ােজনীয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলে অথবা বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হলে কেবল জলসেচের ওপর নির্ভর করে ফসল ফলানােকে সেচ কৃষি বলে। নিম্ন নীলনদ অববাহিকায় ধান, ইক্ষু, ভুট্টা, তুলাে প্রভৃতির চাষ হয়। ভারতে আউশ ও বােরাে ধান এবং রবিশস্যের চাষ সেচের জলে হয়ে থাকে।
কৃষি জমি ব্যবহারের পৌনঃপৌনিকতার ভিত্তিতে
(১) এক-ফসলি কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় একটি জমিতে বছরে কেবল একটিমাত্র ফসল উৎপাদন করা হয় তাকে এক-ফসলি কৃষি বলে। যাযাবরী কৃষি বা আর্দ্র কৃষিতে এই কৃষিব্যবস্থা দেখা যায়।
(২) দো-ফসলি কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে সামান্য জলসেচের সুবিধাযুক্ত স্থানে বছরে দুবার ফসল ফলানাে হয় তাকে দোফসলি কৃষি বলে। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশায় খরিফ মরশুমে ধান ও পাট দো-ফসলি কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে চাষ করা হয়।
(৩) বহু ফসলি কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় একই জমিতে বছরে দুটির বেশি ফসল উৎপাদন করা হয়, তাকে বহু-ফসলি কৃষি বলে। মৌসুমি জলবায়ুর অর্ন্তগত দেশসমূহে এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়।
(৪) ইন্টারক্রপিং বা আন্তঃকৃষি : বহু-ফসলি কৃষিব্যবস্থায় প্রগাঢ় পদ্ধতিতে জমিতে একই সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়। এক এক ফসল এক এক সময়ে। পাকে। তাই, সারাবছর ধরে ফসল ফলানাে ও ফসল তােলা চালতে থাকে। এধরনের কৃষিকাজকে ইন্টারক্রপিং বা আন্তঃকৃষি বলে। ইয়াংসি-কিয়াং নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে এধরনের কৃষিকাজ দেখা যায়।
(৫) শস্যাবর্তন : যে কৃষি পদ্ধতিতে একই জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করে জমির উর্বরতা বজায় রাখা হয় তাকে শস্যাবর্তন বলে। যেমন—প্রথম বছর যদি কোনাে জমিতে ধান চাষ করা হয় তবে তার পরের বছর আবার ধান চাষ না করে ডাল চাষ করা হয়, আবার তার পরবর্তী বছর ধান চাষ করা হয় এভাবে শস্যাবর্তন কৃষি পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করা হয়ে থাকে।
ঋতুর তারতম্যের ভিত্তিতে
(১) খরিফ কৃষি : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে বর্ষাকালে দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে যে কৃষি প্রণালী গড়ে ওঠে তাকে খরিফ কৃষি বা বর্ষাকালীন চাষ বলে। আমন ধান, পাট, আখ, তুলো প্রভৃতি খরিফ কৃষির মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।
(২) রবি কৃষি : মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত অঞ্চলে বৃষ্টিহীন শুষ্ক ও শীতল জলবায়ুতে জলসেচের সাহায্যে যে কৃষি প্রণালী গড়ে ওঠে, তাকে রবি কৃষি বা শীতকালীন চাষ বলে। গম, বােরাে ধান, ছােলা, আলু প্রভৃতি এই কৃষির মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।
আঞ্চলিক বিশেষীকরণের তারতম্যের ভিত্তিতে
(১) মৌসুমি কৃষি : মৌসুমি জলবায়ু প্রভাবিত দেশগুলিতে যে জীবিকাসত্তাভিত্তিক, শ্রমপ্রগাঢ়, জলবায়ু নির্ভর কৃষিব্যবস্থা দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে, তাকে মৌসুমি কৃষি বলে। সমগ্র পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ লােক এ জাতীয় কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ইত্যাদি দেশে এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়।
(২) ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের দেশগুলিতে যে বৈচিত্র্যময় কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি বলা হয়। পশ্চিম ও মধ্য ইউরােপের দেশগুলিতে, মধ্য চিন, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ হয়।
Leave a comment