বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাস সুপরিচিত। তিনি প্রথমে ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসেন। তিনি প্রথম জীবনে কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী প্রমুখ ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের প্রভাবে পড়েছিলেন। পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসার পর তিনি আধ্যাত্মিক নবজন্ম লাভ করেন। নিজের ব্যক্তিত্বের প্রচণ্ড তেজস্বিতা, স্বদেশের দুর্গতির জন্য প্রবল বেদনাবােধ, বিপুল কর্মোদ্দীপনা ও মানবপ্রীতি নিয়ে তিনি দেশের ধর্ম ও সমাজজীবনে নতুন প্রেরণা ও উদ্যম সঞ্চারিত করেছিলেন। বাঙলার বিপ্লববাদী তরুণেরা বিবেকানন্দের রচনাবলী থেকেই দেশাত্মবােধের প্রেরণা লাভ করেছিলেন।

স্বামীজী কখনও সচেতনভাবে সাহিত্য সাধনা করেন নি, তেমন অবসরও তার কর্মচঞ্চল জীবনে ছিল না। তার অধিকাংশ রচনাই ইংরেজি ভাষায় লিখিত। বিবেকানন্দের নামে প্রচলিত বাঙলা রচনাগুলির অধিকাংশই তার ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ, দুএকখানি মাত্র তাঁর নিজের লেখা। তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী, তার রচনাভঙ্গিতে বাগ্মিতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। রামকৃষ্ণদেবের সহজ সরল লৌকিক ভাষায় গৃঢ় অধ্যাত্মতত্ত্বকে সজীবভাবে প্রকাশ করার আশ্চর্য ক্ষমতায় তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাঙলা ভাষায় ভাবপ্রকাশ বিষয়ে তার সুনির্দিষ্ট চিন্তা ছিল। বিবেকানন্দ সাধু বা চলিতে যে ভাষায়ই রচনা করতেন না কেন, সর্বত্রই সর্বজনবােধ্য বাক-বন্ধই অনুসরণ করেছেন। ১৩০৪ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পঞ্চষষ্ঠিতম জন্মােৎসবের সময় প্রকাশিত ‘হিন্দুধর্ম কি? পুস্তিকাটিতে বিবেকানন্দ যে সাধু গদ্য ব্যবহার করেছিলেন, তার শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ তার সমালােচনা করলে স্বামীজীর শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন : “আমার মনে হয়, সকল জিনিষের মতাে ভাষা এবং ভাবও কালে একঘেয়ে হয়ে যায়। এদেশে এখন ঐরূপ হয়েছে বলে বােধ হয়। ঠাকুরের আগমনে ভাব ও ভাষায় আবার নােতুন স্রোত এসেছে। এখন সব নূতন ছাঁচে গড়তে হবে। নােতুন প্রতিভার ছাপ দিয়ে সকল বিষয় প্রচার করতে হবে।..এরপর বাঙলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখব মনে করছি। সাহিত্যসেবিগণ হয়তাে তা দেখে গালমন্দ করবে। করুক, তবু বাঙলা ভাষাটাকে নূতন ছাঁচে গড়তে চেষ্টা করব। এখনকার বাঙলা লেখকেরা লিখতে গেলেই বেশী verbs (ক্রিয়াপদ) use (ব্যবহার) করে। তাতে ভাষার জোর হয় না। বিশেষণ দিয়ে verb (ক্রিয়াপদ)-এর ভাব প্রকাশ করতে পারলে ভাষায় বেশী জোর হয়।…তােদের ডাল ভাত খেয়ে শরীর যেমন ভেতাে হয়ে গেছে, ভাষাও ঠিক সেইরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে; আবার চালচলন, ভাব, ভাষাতে তেজস্বিতা আনতে হবে, সবদিকে প্রাণের বিস্তার করতে হবে—সব ধমনীতে রক্তপ্রবাহ প্রেরণ করতে হবে, যাতে সকল বিষয়েই একটা প্রাণস্পন্দন অনুভূত হয়।” সংস্কৃতপ্রধান সাধু ভাষারীতির বিপরীতে কথ্যভাষার সমর্থনে তার এই বিখ্যাত উক্তিটিও স্মরণীয়- “স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালবাসা ইত্যাদি জানাই তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাব, সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার করে যেতে হবে। ও ভাষার যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যেদিকে ফেরাও সেদিকে ফেরে, তেমন কোন তৈয়ারি ভাষা কোনও কালে হবে না।..আমাদের ভাষা, সংস্কৃতের গদাই-লস্করি চালঐ একচাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।” (বাঙ্গালা ভাষা)

স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলীর মধ্যে ‘পরিব্রাজক’ (১৯০৩), ‘ভাববার কথা’ (১৯০৫), ‘বর্তমান ভারত’ (১৯০৫), ‘পত্রাবলী’ (১৯০৫), ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য’ (১৩৫৫) প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এই সমস্ত রচনায় তিনি ভারতবর্ষের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রামকৃষ্ণদেবের বাণী, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার পার্থক্য, ভারতীয়দের পক্ষে গ্রহণীয় জীবনাচরণের আদর্শ, সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রশক্তির বিবরণ, বাঙলা ভাষা প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করেছেন। স্বদেশবাসীরা যাতে তাদের ভীরুতা, দুর্বলতা, দাসত্বের মােহ দূর করে মনুষ্যত্বের ধর্মে জীবন গঠন করতে পারে, তার জন্য তাদের প্রতি স্বামীজীর উদাত্তকণ্ঠের আহ্বান এই রচনাগুলিতে মেঘমন্দ্রে ধ্বনিত হয়েছে। যুক্তির তীক্ষ্মতায় ও আবেগের তীব্রতায় শ্রোতাদের সামনে প্রত্যক্ষ ভাষণের মত তার উক্তিগুলি পাঠকদের হৃদয়মনকে গভীরভাবে আলােড়িত করে।

ডাঃ শশিভূষণ দাসগুপ্ত বিবেকানন্দের রচনাভঙ্গির বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে নির্দেশ করেছেন- “বিবেকানন্দের ভিতরে ছিল যে চরম শ্রেয়ােবােধে প্রতিষ্ঠিত কর্মচঞ্চল সন্ন্যাসী, যে মহানুভব মানবপ্রেমিক-যে মিথ্যাচার-বিরােধী সংস্কারক—তাহার লেখার ভিতরে তাহার জীবন্ত পরিচয় আছে। কথা বলা এবং লেখার বিরােধটাকে স্বামীজী অনেক স্থানে আশ্চর্যরকম মিটাইয়া লইয়াছেন, কথ্যভাষা এবং কথ্যরীতির উপরে তাহার একটা বিশেষ দখল ছিল; অনুরক্ত গােষ্ঠীর ভিতরে তিনি যেমন করিয়া অনুপ্রাণিতভাবে অনর্গল কথা বলিয়া যাইতেন, তেমন করিয়াই তিনি অনায়াসে লিখিয়া যাইতে পারিতেন। সাহিত্যে তিনি সর্বদাই কথ্যভাষা ও কথ্যরীতির পক্ষপাতী ছিলেন, কায়ক্লেশে ভাষাকে সাধু করিয়া সাজাইবার তিনি মােটেই পক্ষপাতী ছিলেন না, কথ্যভাষা ও রীতিকেই তিনি এমন করিয়া ভাঙ্গিয়া টিপিয়া গড়িয়া লইতে চাহিয়াছিলেন যেন সে সব জাতীয় মনােভাব প্রকাশেরই উপযােগী হয়। এই বিশিষ্ট ভঙ্গি গ্রহণ করার ফলে বিবেকানন্দের লেখার ভিতর দিয়া তাহাকে স্থানে স্থানে স্পষ্ট কথা বলিতে শােনা যায়। ভাষার উপরে অসাধারণ দখল না থাকিলে এই রীতিটিকে এইভাবে জমাইয়া তােলা সহজ হইত না।” মনে রাখতে হবে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ রবীন্দ্রনাথের অধিনায়কত্বে বাংলা ভাষার পুনর্গঠনে উদ্যোগী হবার কয়েক বৎসর পূর্বেই বিবেকানন্দ বাংলা গদ্যভঙ্গি সম্বন্ধে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।

বিবেকানন্দের রচনারীতি-বিষয়ে আর একটি মননশীল মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, “…তার চরিত্রের প্রচণ্ড পৌরুষ ও মনােরম সরসতা এই চলতি ভাষায় এমন এক অপূর্ব সৃষ্টি করেছে যে, বিশ শতকের চলতি ভাষায় কোন লেখকই তার সমকক্ষতা লাভ করতে পারবে না।…বিবেকানন্দের ভাষায় হুতােমের মতােই দুঃসাহস ছিল, কিন্তু অশালীনতার নামগন্ধও ছিল না; প্রমথ চৌধুরীর মতাে রসিকতা ছিল, কিন্তু বুদ্ধির মারপ্যাচ ছিল না। আবার কোথাও কোথাও তার চলিত ভাষায় অপূর্ব ধ্বনিগঞ্ভীর ক্লাসিক ঝঙ্কার সঞ্চারিত হয়েছে।”