জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়নের ব্যাপারে বৈপ্লবিক পন্থাপদ্ধতির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। পশ্চিম ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রের রূপায়ণের সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি ভাবনা চিন্তা করেছেন। সাধারণত আর্থনীতিক ও রাজনীতিক বিচারে পশ্চাদপদ দেশগুলিতেই বৈপ্লবিক নীতিসমূহ অব্যাহতভাবে সক্রিয় থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে রাশিয়ার কথা বলা যায়। অপরদিকে ‘জার্মান সামাজিক গণতান্ত্রিক দল’ (German Social Democratic Party ) – এর মত রাজনীতিক শক্তিসমূহ নির্বাচনী উপায়-পদ্ধতি ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহার করতে পারে। ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস নির্বাচনী পন্থা-পদ্ধতিকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দী যত সামনের দিকে অগ্রবর্তী হয়েছে গণ-বিপ্লবের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়েছে। বিশেষত পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহে এই ধারা পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শহুরে শ্রমিকশ্রেণী তাদের বিপ্লবী প্রকৃতি বহুলাংশে হারিয়ে ফেলে। শ্রমিক শ্রেণী সমগ্র সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পুঁজিবাদও যথেষ্ট পরিণতি লাভ করেছে। বিকশিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীর মজুরী বৃদ্ধি পায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। ১৮৭৫ সালের পরবর্তী কালে আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশের বিস্তার ঘটে। তার ফলেও শ্রমিক শ্রেণীর জীবনধারায় সদর্থক পরিবর্তন আসে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণমুলক বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শ্রমজীবীদের ক্লাব, শ্রমিক সংঘ, রাজনীতিক দল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার ফলে মেহনতী মানুষের স্বার্থসমূহ সংরক্ষিত হয়; শ্রমিকদের নিরাপত্তা বোধ জাগরিত হয় এবং শ্রমিকদের মধ্যে এই বোধের সৃষ্টি হয় যে, তারা শিল্প সমাজের অন্তর্ভুক্ত। এই সময় রাজনীতিক গণতন্ত্রেরও বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। ভোটাধিকারের পরিধি প্রসারিত হয়। শ্রমিক শ্রেণী ভোটাধিকার লাভ করে। অনেক দেশে নারী জাতির ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মেনে নেওয়া হয়। রাজনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশসাধনমূলক উপরিউক্ত বিধিব্যবস্থা সামগ্রিক বিচারে সমাজতন্ত্রের উপর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সমাজতন্ত্রীরা সহিংস ও সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ থেকে সরে আসে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে বিবর্তনমূলক গণতান্ত্রিক বা পার্লামেন্টীয় পথ অবলম্বনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের মূল বক্তব্য

বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের মূল বক্তব্য অনুযায়ী বিবর্তনমূলক পন্থা-পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিবর্তনমূলক উপায়-পদ্ধতি হিসাবে বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলা হয়ে থাকে। এগুলি হল : গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধন; সংসদীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ; নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিক ক্ষমতা দখল; প্রগতিমূলক আইন প্রণয়ন; প্রগতিশীল করব্যবস্থা; এবং জাতীয়করণ। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদে সমাজতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন বা বিবর্তনের কথা বলা হয়। এই মতবাদে বিশ্বাস করা হয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সামর্থ্য আছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের জন্য মার্কসবাদের মত বিপ্লবের ধারণাকে বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র স্বীকার বা সমর্থন করে না। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদে মার্কসবাদের কতকগুলি মূল বক্তব্যের বিরোধিতা করা হয়। এই বিষয়গুলি হল: শ্রেণীসংগ্রাম, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব, রাষ্ট্রের উবে যাওয়া এবং শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা।

বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ সাম্প্রতিককালের উদারনীতিবাদ বা সামাজিক উদারনীতিবাদ বা উদারনীতিক সমাজতন্ত্রবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। কারণ বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের সকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উদারনীতিক মতবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ উৎপাদকের সমবায়, ভোক্তাদের সমবায় এবং আবাসন সমবায়সমূহের ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। উদারনীতিবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ বা মূল্যবোধসমূহের ব্যাপারে বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ খুব বেশি বিরোধিতামূলক অবস্থান গ্রহণ করে না। উদারনীতিবাদ কতকগুলি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নীতিগুলির বিলোপ সাধনের কোন রকম উদ্দেশ্য আলোচ্য মতবাদের মধ্যে নেই। বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীরা বণ্টনব্যবস্থা ও বিনিময় ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সমাজতন্ত্রীদের কাছে উৎপাদন ব্যবস্থার থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল সমাজে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর বণ্টন ব্যবস্থা। মার্কসবাদে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এবং পুঁজিবাদী শোষণমূলক উৎপাদন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। এ প্রসঙ্গে বিদ্যাধর মহাজনের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “If Marxism is the evolutionary Philosophy of the working class, evolutionary socialism is the reformist and anti-revolutionary philosophy of the social democrats.”

এডয়ার্ড বার্নস্টাইন: জার্মান দার্শনিক এওয়ার্ড বার্নস্টেইন [Edward Bernstein (1850-1932) বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের মুখ্য প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। এ বিষয়ে বার্নস্টেইনের বইটির নামই হল Evolutionary Socialism, অর্থাৎ আলোচ্য মতবাদটির নামকরণের ক্ষেত্রেও বার্নস্টেইনের অবদান অনস্বীকার্য। বার্নস্টেইন ১৮৭৫ সালের গোথা প্রোগ্রাম (Gotha Programme 1875) এবং ১৮৯১ সালের এরফুট প্রোগ্রাম (Erfurt Programme, 1891)-এর বিরূপ সমালোচনা করেন। বস্তুত এ ক্ষেত্রে তিনি বেবেল (Bebel), লিবক্লেট (Liebknecht), সিঙ্গার (Singer) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীর সমালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছন: “The begining of this trend can be seen in the ideas of Ferdinand Lassalle, Bebel and Liebknecht and other leading lights of the German social democratic movement who drew their programmes first at Gotha in 1875 and then in Erfurt in 1891” গোথা প্রোগ্রাম ও এরফুট প্রোগ্রাম মার্কসীয় বৈপ্লবিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের ব্যাখা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বার্নস্টাইন কতকগুলি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান আসন্ন, এমন ধারণা ভ্রান্ত। পুঁজিবাদের প্রকৃতির পরিবর্তন করা যেতে পারে এবং পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে সংস্কারমূলক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে পরিবর্তন সাধন সম্ভব। বিবর্তনমূলক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদের বিলোপসাধন সম্ভব। তেমনি শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থারও উন্নতি সাধন সম্ভব। তারজন্য দরকার হল সুসংগঠিত শ্রমিক সংগঠন এবং শ্রমিক সাধারণের আর্থনীতিক ও আনুষঙ্গিক দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলন।

বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা: বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রে পরিণত হয়। এ ধরনের সমাজতন্ত্রে আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়। বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীরা রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা বলেন না। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র-যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা আছে। সংসদীয় ব্যবস্থাদির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবকে সম্ভব করা যায়। তারজন্য সর্বহারাদের একনায়কত্ব অপরিহার্য নয়। শ্রেণী সংগ্রামও তেমন কোন মৌলিক বিষয় নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপ্লবের কোন প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্র শ্রেণীস্বার্থের হাতিয়ার নয়। রাষ্ট্রের মাধ্যমে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলের স্বার্থের সমন্বয় সাধন সম্ভব। এবং এই পথে ধনী ও দরিদ্ররা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে। জন কল্যাণমূলক বিবিধ কর্মসূচীর মাধ্যমে রাষ্ট্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থসমূহের পরিপোষণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শ্রমিকশ্রেণী সমেত সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

পিটার মার্কক্ল (Pater H. Merkl) তাঁর Political Continuity and Change শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Bernstein’s revisionism became known as ‘evolutionary socialism’ in contrast to the revolutionary character of orthodox Marxism. Bernstein dismissed the idea of an imminent proletarian revolution as folly and called the ‘dictatorship of the proletariat’ a ‘political atovism’…. It is unrealistic, in his opinion, to speak of only two battling, clearly defined classes, the proletariat and the bourgeoisie, in the face of the great variety of classes that exist. Nor did the concentration of the means of production in just a few hands take place as predicted” an An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Bernstein, therefore, insisted that socialism should be treated more as a movement than an ultimate goal.”

গাউবা আরও বলেছেন: “Bernstein rejected Marx’s materialist interpretation of history which implies the inevitability class conflict as the road to socialism.”

জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Bernstein rejects Marxism at so many places, he accepts it at very few ponts and even their he makes some qualifying interpretations. The net result of all his exercise is that he accepts Marxism in a very low measure.”

লাসালে: জার্মান শোধনবাদী ধ্যান-ধারণার সূত্রপাত প্রথম পরিলক্ষিত হয় ফারদিনান্দ লাসালে (Ferdinand Lassalle)-র মধ্যে। প্রকৃত প্রস্তাবে লাসালে জার্মান শোধনবাদের পথিকৃত হিসাবে পরিচিত। লাসালে ইতিহাসের মার্কসীয় ব্যাখ্যাকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি রাজনীতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সর্বহারাদের ক্ষমতা দখলের ধারণাকে স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। তিনি অনতিবিলম্বে উৎপাদকদের সমবায় গড়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন। লাসালে এও বলেছেন যে, এই উদ্দেশ্যে শ্রমিকশ্রেণীকে একটি রাজনীতিক দল গড়ে তুলতে হবে। এই রাজনীতিক দলের উদ্দেশ্য হবে আইনসভায় মেহনতী মানুষের স্বার্থসমূহকে প্রতিফলিত করা।

গোথা প্রোগ্রাম: লাসালের মৃত্যু হয় ১৮৬৪ সালে। অতঃপর বেবেল, লিবক্লেট প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিক শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে মৌলিক সংস্কারমূলক পথে পরিচালিত করার কথা বলেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদগণ সমাজবাদী গণতন্ত্রী হিসাবে পরিচিত। তাঁরা ১৮৭৫ সালে গোথা (Gotha) নামক একটি শহরে সমবেত হন। এবং লাসালের মতাদর্শের অনুসরণে একটি কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। একেই বলা হয় ‘গোথা প্রোগ্রাম’ (Gotha Programme)। কার্ল মার্কস গোথা প্রোগ্রামের তীব্র বিরোধিতা করেন।

এরফুর্ট প্রোগ্রাম: ১৮৯১ সালে এরফুর্ট (Erfurt) শহরে গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের আর একটি সম্মেলন সংগঠিত হয়। এ সম্মেলনটি ‘এরফুর্ট কংগ্রেস’ (Erfurt Congress) নামে পরিচিত। এরফুর্ট কংগ্রেসে বিভিন্ন উদারনীতিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এই সমস্ত কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সার্বজনীন, প্রত্যক্ষ ও সমান ভোটাধিকার; জনসংখ্যা অনুসারে প্রতিনিধিদের ব্যবস্থা; গণ-ভোট ও গণ-উদ্যোগের ব্যবস্থার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ; সরকারী সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে ‘মিলিশিয়া’ (militia) বা জনসাধারণের স্থানিক বাহিনী গঠন করা; সামাজিক বীমা ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা; আট ঘণ্টার কাজের দিন; শিশু শ্রমিক ও রাত্রিকালীন কাজকর্ম নিষিদ্ধকরণ; ক্রমবর্ধমান আয়কর; নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা; নিখরচায় আইনী পরিষেবা; মৃত্যুদন্ডের অবসান; জনসাধারণের দ্বারা বিচারক নির্বাচনের ব্যবস্থা; ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা; ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সরকারী অর্থের ব্যয় নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি।

বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা ও মূল্যায়ন

বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ বিরূপ সমালোচনার হাত এড়িয়ে যেতে পারেনি। সমালোচকরা বিভিন্ন দিক থেকে বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীদের ধ্যান-ধারণার সমালোচনা করেছেন। মূলত মার্কসবাদীরাই বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীদের সমালোচক হিসাবে পরিচিত। তবে গোঁড়া উদারনীতিবাদীরাও বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রের সমালোচনা করেন।

(ক) মার্কসবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকরা বিভিন্ন দিক থেকে বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা করেন।

  • বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ শ্রমিক শ্রেণীর সব থেকে বড় শত্রু। প্রকৃত প্রস্তাবে আলোচ্য মতবাদটি হল একটি বিপ্লব-বিরোধী মতবাদ। এই মতবাদে বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে বৈধতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদে পুঁজিবাদের পুরোপুরি বিলোপ সাধনের কথা বলা হয় না। এই মতবাদে মেহনতী মানুষ ও পুঁজিপতিদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার সম্পর্কের কথা বলা হয়। এই মতবাদে বুর্জোয়া আর্থ সামাজিক ও রাজনীতিক অবস্থাকে অব্যাহত রাখার উপর জোর দেওয়া হয়।

  • বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদের সমর্থক এবং এই সুবাদে এই মতবাদ ফ্যাসীবাদের বনিয়াদ প্রস্তুত করে। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদে রাষ্ট্রকে সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই মতবাদে বৃহৎ রাষ্ট্রকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদানের কথা বলা হয়। তারফলে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের পরিণামে আমলাতন্ত্রীকরণের আশঙ্কা থাকে, সামাজিকীকরণের সম্ভাবনা থাকে না।

  • বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ হল অবৈজ্ঞানিক, অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিমূলক। এই মতবাদে মেহনতী মানুষের মুক্তির কথা বলা হয় না; তাদের বিপথে চালিত করা হয়। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ সংসদীয় উপায় পদ্ধতির অনুগামী। এই মতবাদে ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা ও শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বকে অস্বীকার করা হয়।

  • মার্কসবাদী সমালোচকদের অভিমত অনুসারে বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্র হল বস্তুত ‘অক্ষম সমাজতন্ত্র, ‘দালালদের সমাজতন্ত্র, এ ধরনের সমাজতন্ত্র শোধনবাদী। লেনিন ঘোষণা করেছেন যে, বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র হল শোধনবাদী, সুবিধাবাদী ও সংস্কারবাদী।

(খ) উদারনীতিক মতবাদের গোঁড়া প্রবক্তারাও বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের বিরূপ সমালোচনা করেন।

  • এই শ্রেণীর রাষ্ট্রদার্শনিকদের মতানুসারে বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রে জাতীয়করণের কথা বলা হয়। কিন্তু জাতীয়করণ মুক্ত প্রতিযোগিতা ও শিল্পোন্নয়নের পরিপন্থী। জাতীয়করণের পরিণামে বিদ্যমান আর্থনীতিক ব্যবস্থার উৎপাদন ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার কারণে বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রে উৎপাদন হ্রাস পায়।

  • বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্র সামগ্রিকতাবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপোষক। সামগ্রিকতাবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। সামগ্রিকতাবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র সমাজের সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। তারফলে সমাজব্যবস্থা আর উন্মুক্ত থাকে না, আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ রকম পরিস্থিতি-পরিমন্ডলের মধ্যে ব্যক্তি মানুষের বিকাশের সুযোগ সম্ভাবনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

(গ) বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রের কোন সুসংহত মতাদর্শ নেই। এই ধরনের সমাজতন্ত্রের পরিচয়সূচক মৌলিক উপাদানসমূহ চিহ্নিত করা দুরূহ ব্যাপার। কারণ বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র বিভিন্ন রকমের হতে দেখা যায়। এ ধরনের সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে সাধারণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মতাদর্শ ও কর্মপরিকল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হয়।

(ঘ) বিভিন্ন ধরনের বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রে শ্রেণীসংগ্রামের পরিবর্তে শ্রেণী-সহযোগিতা, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের পরিবর্তে গণতন্ত্র এবং বৈপ্লবিক পদ্ধতির পরিবর্তে বিবর্তনমূলক পদ্ধতির কথা বলা হয়। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রের বিবিধ সীমাবদ্ধতা বর্তমান। এ কথা অস্বীকরা করা যাবে না। এতদ্‌সত্ত্বেও এই মতবাদের গুরুত্ব ও সদর্থক অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না।

  • পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ব্যবস্থায় বিবিধ সমস্যা-সংকট পরিলক্ষিত হয়। সমস্যা-সংকটে কাহিল পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ব্যবস্থা বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রবাদের মাধ্যমে শক্তি-সামর্থ্য লাভ করে। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের বিরোধিতা করে এবং পুঁজিবাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করে। সাবেকি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তুলনায় বিবর্তনবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল অধিকতর অভিপ্রেত।

  • বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ শ্রমজীবী জনতার সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি সাধন করেছে। তারফলে শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক মানসিকতা বহুলাংশে প্রশমিত হয়েছে এবং পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অস্তিত্ব অনেকাংশে নিরাপদ হয়েছে।

  • পশ্চিমী দেশগুলির উদারনীতিক গণতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহ পুঁজিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ এই সমস্ত রাজনীতিক ব্যবস্থাকে নিরাপদ করেছে।

  • বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ ও উদারনীতিবাদের মধ্যে সংমিশ্রণের সুবাদে উদারনৈতিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার তত্ত্ব গড়ে উঠেছে।

  • উদারনীতিবাদ বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের কর্মসূচীসমূহ, নীতি ও স্লোগানসমূহ এবং চাহিদাসমূহ স্বীকার ও গ্রহণ করেছে। এবং এইভাবে উদারনীতিবাদ নিজেকে পরিবর্তন করেছে।