দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পার্থক্য: বিবর্তনমূলক ও বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীরা তাঁদের মতাদর্শের উৎস হিসাবে মার্কসীয় দর্শনকে স্বীকার করেন। কিন্তু এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা মার্কসীয় মতবাদের মধ্যে নতুন ধ্যান-ধারণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেন। তারফলে মার্কসবাদ তার বৈপ্লবিক প্রকৃতি হারিয়ে ফেলে। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রীরা সর্বহারার একনায়কত্বে বিশ্বাস করেন এবং সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবকে অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনা করেন।

বিপরীতক্রমে বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ, শাসনতান্ত্রিক ও ধীরগতির পরিবর্তনের পক্ষপাতী। বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীরা উদারনীতিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী। তাঁরা ন্যায়, স্বাধীনতা ও অহিংস সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষপাতী। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা ধনতন্ত্রের থেকে উন্নততর ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু তাঁরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হওয়ার জন্য অহিংস পথে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হওয়ার পক্ষপাতী। বিবর্তনবাদী ও বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাষ্ট্র দার্শনিক এবেনস্টেইন মন্তব্য করেছেন: If the whole economic system be compared to a basket of eggs communism (true Marxian Socialism) burns the basket and scrambles all eggs at once-never to be uncrambled again. Democratic (or evolutionary) socialism keeps the basket and cooks only small orders of scrambled eggs at one time because it believes in Aristotles wise counsel that the guest will judge better of a feast than the cook.”

দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হেতু বিবর্তনবাদী ও বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত পার্থক্যের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এক: বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রকে উদারনীতিক সমাজতন্ত্র হিসাবে অভিহিত করা যায়। অপরদিকে বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রকে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়।

দুই: বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য হিসাবে শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়; বিশেষত আর্থনীতিক অধিকার আদায়কেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থকে অন্যান্য শ্রেণীসমূহের স্বার্থের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের সমাজতন্ত্রে সামাজিক সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি হিসাবে সামঞ্জস্য সাধন ও ভারসাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিপরীতক্রমে বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রে সমাজের বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন বা ভারসাম্য বিধানের বিষয়টিকেই বাতিল করা হয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রাধান্যকারী ও নির্ভরশীল শ্রেণীসমূহের অবস্থানকে বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রে একেবোরে উল্টে দেওয়ার, বিপরীতমুখী করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অবসান এবং সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা।

তিন: বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ সামাজিক ব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে রূপান্তরিত করতে চায়। এ ধরনের সমাজতন্ত্রীরা পিছিয়েপড়া দীন-দরিদ্র মানুষজনকে কিছু কিছু সুযোগ প্রদানের প্রক্রিয়াকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। অপরদিকে বিবর্তনবাদীরা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উপনীত হওয়ার জন্য ক্রমবিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া অনুসরণের পক্ষাপাতী। তাঁরা সহসা সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পক্ষাপাতী নন; ক্রমশ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হতে চান।

চার: বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করার কথা বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হল বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদের অবসান এবং উৎপাদানের উপাদানসমূহের এবং বণ্টন ব্যবস্থার সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করা। অপরদিকে বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সংসদীয় সংস্কার সাধন, আর্থনীতিক পরিকল্পনা প্রভৃতি উপায়-পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। এর উদ্দেশ্য হল অনগ্রসর-অবহেলিত শ্রেণীসমূহ, বিশেষত শ্রমিক শ্রেণীসমূহের সম্যক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা এবং এই সমস্ত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শ্রেণীসমূহের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

পাঁচ: বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ মার্কসীয় ঐতিহ্যযুক্ত। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন অসামঞ্জস্য ও সংঘাতের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদে এই বিষয়গুলিকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়। অপরদিকে বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে আপসমূলক সমঝোতা সম্পাদনের উপর জোর দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পুঁজিবাদকে অল্পবিস্তর পরিবর্তন করা এবং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদের অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখা।

গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “In Popular‌parlance, the term ‘socialism is usually applied to indicate ‘evolutionary socialism’, that is, the kind of socialism achieved by evolutionary process or by dergees, not by wholesale transformation of society in a single stroke.” সমাজতন্ত্রবাদের বিবিধ রূপ বর্তমান। এই সমস্ত রূপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 

  • (১) ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ’ (Utopian Socialism) 

  • (2) বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ (Evolutionary socialism), 

  • (৩) ‘ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র’ (Fabian Socialism), 

  • (৪) যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রবাদ (Syndicalism), 

  • (৫) সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ (Guild Socialism), 

  • (৬) নৈরাজ্যবাদ (Anarchism) প্রভৃতি। 

সমাজতন্ত্রের এই সমস্ত রূপের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বিবর্তনমূলক‌পরিবর্তনের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে সমাজতন্ত্রের এই সমস্ত ধরনকেই সাধারণভাবে বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্র বলা হয়। মহাজন (V. D. Mahajan) তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “All of them are known by the cover-term evolutionary socialism because the idea of evolutionary change is common to them all.”