অথবা, বিবর্তনবাদ যান্ত্রিক না উদ্দেশ্যমূলক? ব্যাখ্যা দাও।
ভূমিকাঃ পৃথিবীর বুকে পা ফেলেই মানবশিশু সর্বপ্রথম অপরিচিত পরিবেশের মুখােমুখি হয়ে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই রূপময় এই পৃথিবীর সুষমাদর্শনে তার সব ভয় বিস্ময়ে পরিণত হয়। অবাক চোখে সে তার চারপাশ অবলােকন করতে থাকে দিনের পর দিন। তার এই বিস্ময় ক্রমে কৌতূহলে পরিণত হয়। ফলে তার মনে জাগে এক অনন্ত জিজ্ঞাসা- সুন্দর এই বিশ্বের আদি কোথায়? এটা কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে, না এর পিছনে কোন স্রষ্টার উপস্থিতি রয়েছে। সুন্দর এই জগতে বিচরণকারী জীবজগৎই বা এল কোথা থেকে? তাই দর্শনের ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায়, চিরন্তন সমস্যার সমাধানে ভাবুক দার্শনিকগণ দু’টো মত ব্যক্ত করেছেন; এ দুটি মতবাদ হচ্ছে- সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ।
বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি প্রায়ই করা হয় তা হলাে- বিবর্তন কি যান্ত্রিক না উদ্দেশ্যমূলক? আবার কারাে প্রশ্ন, বিবর্তন সৃষ্টিশীল নাকি উন্মেষমূলক? তাই বিবর্তনবাদ যান্ত্রিক নাকি উদ্দেশ্যমূলক সেটাই আমাদের আলােচ্য বিষয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-
যান্ত্রিক বিবর্তন কীঃ এ মতবাদ অনুসারে যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এ জগৎ বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তার পেছনে কোনাে উদ্দেশ্য নেই। জড়, গতি ও শক্তি হচ্ছে জগতের আদিম উপাদান। পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল জড় এবং তার গতি ও শক্তির প্রক্রিয়ার ফলে সম্পূর্ণ যান্ত্রিকভাবে ধীরগতিতে এ জগৎ ও তার যাবতীয় বস্তুর বিবর্তন ঘটেছে। অর্থাৎ জগতের সবকিছুই জড় থেকে বিবর্তনের ফলে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ জড়বাদ ও নিসর্গবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। জড়বাদ শক্তির সাহায্যে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করে। জড়ই জগতের মূল উপাদান। নিসর্গবাদ শক্তি, গতি, প্রকৃতির নিয়ম ও কার্যকারণ সম্পর্কের সাহায্যেই জগৎ ও জাগতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করাতে সচেষ্ট হয়।
যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের মতে, জড়, শক্তি, কাল, দেশ, মাধ্যাকর্ষণ প্রভৃতির সাহায্যেই জগতের বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করা যায়। এর অতিরিক্ত কোনাে মন, চেতনা বা বুদ্ধিময় কর্তা এ জগতের ক্রমবিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। অসংখ্য জড় পরমাণুর পারস্পরিক আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলে জগৎ ও জাগতিক বস্তুগুলাের সৃষ্টি হয়েছে।
যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের মতে, কোনাে সৃজনমূলক ধারণা বা চিন্তন বিবর্তনপ্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে না। প্রকৃতপক্ষে অচেতন জড় ও জড়শক্তি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিবর্তনপ্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রিক দার্শনিক এম্পিকসেস, ডেমােক্রিটাস এবং আধুনিক যুগের টিল্ডল, হাক্সলি, ল্যাপলাস, স্পেন্সার প্রমুখ লেখক যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের সমর্থক। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের দু’টি রূপ আছে; যথা-১. জড় জগৎসম্পর্কীয় বিবর্তনবাদ ও ২. জীবজগৎসম্পর্কীয় বিবর্তনবাদ। আবার জড়জগৎ সম্পর্কীয় বিবর্তনবাদের দুটি রূপ আছে; যথা- ক. ল্যাপলাসের নীহারিকাবাদ ও খ. হার্বার্ট স্পেন্সরের যান্ত্রিক বিশ্ববাদ।
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদঃ উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ অনুযায়ী, বিবর্তনপ্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে কোনাে বদ্ধিমান সত্তার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। ভাববাদী দার্শনিকগণ এ মতবাদের সমর্থক। তাদের মতে, জড়শক্তি মূল তত্ত্ব নয়। এ জড়শক্তি এক পরম শক্তির বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। এ মতবাদ অনুসারে, শুধুমাত্র ভৌতিক ও যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে জগতের উৎপত্তি ও বিভিন্ন বস্তুর ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যা করা যায় না। এ জগতের বিবর্তন বুদ্ধি, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং আদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ জাতের সর্বক্ষেত্রে ঐক্য, সামঞ্জস্য, শৃঙখলা এবং উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে উপযােগিতা দেখা যায়। এসব নিদর্শন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এক পরম বুদ্ধিময় চেতনসত্তা জগতের নানা শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে কোন এক লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ জগতের বিবর্তন কোনাে আধ্যাত্মিক সত্তার আত্মপ্রকাশ ব্যতীত কিছুই নয়।
একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের লক্ষণগুলাে জগৎ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের পরিবেশের অনুকূলে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। যদিও প্রাণ প্রাণহীন বস্তুর ওপর এবং চেতনা প্রাণের ওপর অস্তিত্বের জন্য নির্ভর করে, তথাপি বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় এদের গুণগত তারতম্য পরিলক্ষিত বলে বিবর্তনপ্রক্রিয়া যান্ত্রিক নয় বরং উদ্দেশ্যমূলক।
বিবর্তন যান্ত্রিক না উদ্দেশ্যবাদীঃ বিবর্তন কি উদ্দেশ্যমূলক না যান্ত্রিক, এটা এক কঠিন বিতর্কিত বিষয়। যারা অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী তারা বলেন, বিবর্তন উদ্দেশ্যমূলক। আর যারা নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী তারা বলেন, বিবর্তন যান্ত্রিক। তবে আমার মতে, পৃথিবীর সবকিছুই উদ্দেশ্যবাদী। একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছাড়া এটি চলতে পারে না। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের পক্ষে। নিম্নে এ মতবাদের সমর্থনে যুক্তি দেওয়া হলাে-
প্রথমত, মানুষের কর্মপদ্ধতি উদ্দেশ্যমূলক। মানুষ যান্ত্রিক নিয়মে কাজ করে না। অন্ধভাবেও কাজ করে না। কোনাে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য স্থির করে মানুষ কাজ করে। এটি মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। সুতরাং মানুষের কর্মপদ্ধতি উদ্দেশ্যমূলক। আর এটাই প্রমাণ করে যে জগৎব্যাপী এক উদ্দেশ্যের স্থান রয়েছে। তা না হলে মানুষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করবে কেন?
দ্বিতীয়ত, জগতে অবিরত নিয়মের ভিতর দিয়ে পরিবর্তন চলছে। পরিবর্তন বলতে, এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থাপ্রাপ্তি বুঝায়। সুতরাং এক নতুন অবস্থাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যই পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই বিবর্তন যে উদ্দেশ্যমূলক এটা তার একটা বড় প্রমাণ।
তৃতীয়ত, পৃথিবীর বর্তমান রূপ একটা সুস্পষ্ট ক্রমপরিবর্তনের ফল। আর এই ক্রমপরিবর্তনের পেছনে রয়েছেন একজন বুদ্ধিমান কর্তা, যিনি তার কোনাে উদ্দেশ্যসাধনের জন্য জগৎকে বিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
চতুর্থত, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর ভাষায়, এ জগতে এক নিয়মের রাজত্ব চলছে। এখানে উঠতেও নিয়ম, পড়তেও নিয়ম স্থির থাকতেও নিয়ম। এ নিয়মের কোনাে ব্যতিক্রম নেই। সর্বত্রই নিয়ম। সমস্ত জগৎ নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জগতের বিভিন্ন অংশের মধ্যেও আছে আন্তঃসম্পর্ক। এ সম্পর্ক আকস্মিক নয়। জগতের বিভিন্ন অংশের এ সম্পর্ক নিশ্চয়ই কোন বুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আর এ বুদ্ধি হলাে, উদ্দেশ্যবাদী।
পঞ্চমত, হেন্ডারসনের মতে, জগৎপ্রকৃতির মধ্যে উদ্দেশ্য রয়েছে। জগতে প্রাণের আবির্ভাবকে স্বাগতম জানানাের জন্য ছিল চারদিকের পরিবেশ। সুতরাং এ প্রস্তুতি উদ্দেশ্যমূলক।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিবর্তন শুধু যান্ত্রিকও নয়, আবার শুধু উদ্দেশ্যমূলকও নয়। উপায় এবং উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের এ পৃথিবী। সুতরাং জগতের উৎপত্তিবিষয়ক যতগুলাে মতবাদ আছে তার মধ্যে পরিণতিমূলক বা উদ্দেশ্যমূলক মতবাদই শ্রেষ্ঠ। কারণ এই মতবাদ জগৎ সৃষ্টির মূলে একটি নিরপেক্ষ উদ্দেশ্য খোজে। এই উদ্দেশ্য হলাে ঈশ্বর। তাই ভাববাদী দার্শনিকগণই মূলত উদ্দেশ্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী। বাস্তববাদীরা এই মতবাদ বিশ্বাস করেন না। কারণ তারা স্বয়ং ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন না। আর বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যায় যান্ত্রিকতাবাদের তুলনায় উদ্দেশ্যবাদ অধিকতর উপযােগী।
Leave a comment