মার্কসীয় ও অমার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি : মানবসমাজের ইতিহাস হল অবিরাম পরিবর্তনের ইতিহাস। হার্বার্ট আপথেকার তাঁর Democracy, Freedom and Revolution শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The history of mankind is a remarkably dynamic one, change is one of its few constants, …” মানবসমাজের এই পরিবর্তনের প্রকৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে চিন্তাবিদদের মতপার্থক্য বর্তমান। এ ক্ষেত্রে চিন্তাবিদদের দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। চিন্তাবিদদের এই দুই শ্রেণী হল : মার্কসবাদী চিন্তাবিদ এবং অ-মার্কসবাদী চিন্তাবিদ্। অ-মার্কসবাদীরা সংস্কারমূলক বিবর্তনমুখী ধারার পরিপ্রেক্ষিতে মানবসমাজের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী। কিন্তু মার্কসবাদীরা বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানবসমাজের পরিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন। অপরদিকে অ-মার্কসবাদীদের অভিমত অনুসারে বিপ্লব হল এক অনভিপ্রেত ও অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বুর্জোয়া ধারণা ও তার সমালোচনা: বুর্জোয়া দার্শনিকদের অভিমত অনুসারে আভ্যন্তরীণ সংঘাতপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থার হিংসাত্মক ও আকস্মিক পরিবর্তনই হল বিপ্লব। এই ধারণা অনুসারে বিপ্লবকে হিংসাত্মক পরিবর্তনের সমার্থক বলে মনে করা হয়। বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা হিংসাকে বিপ্লবের জৈবিক সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করেন। এরা বিপ্লব ও প্রতি-বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য করেননি। বিপ্লব সম্পর্কিত বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের এই সংজ্ঞাকে হার্বার্ট আপথেকার বিপ্লবের হলিউড-মার্কা সংজ্ঞা বলে উপহাস করেছেন। মার্কসবাদীদের মতানুসারে বুর্জোয়া অত্ত্বিকগণ সমাজের মৌলিক দ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করেন এবং বিপ্লবকে একটি আকস্মিক ও হিংসাত্মক ঘটনা হিসাবে ব্যক্ত করেন। উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার মালিকানা, শাসক ও শাসিতের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব, ইতিহাসের গতিশীলতা প্রভৃতি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলিকে বুর্জোয়া দর্শনে বিশ্লেষণ করা হয়নি। এই কারণে বিপ্লব সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। এ হল মার্কসবাদী দার্শনিকদের বক্তব্য।
বিপ্লব কাকে বলে? মার্কসীয় দর্শনে একেবারে বিপরীত অর্থে ধারণাকে ব্যাখ্যা করা হয়। মার্কসবাদে বিপ্লবকে একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে একটি শাসক শ্রেণীর পতন ঘটে এবং নতুন এক শাসক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই নতুন শাসক শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাতন শাসক শ্রেণী অপেক্ষা প্রগতিশীল ও সম্ভাবনাময় শক্তি হিসাবে প্রতীয়মান হয়। মার্কসীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে যে-কোন শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীস্বার্থের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শ্রেণীর স্বার্থে সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনই হল বিপ্লব। অর্থাৎ সমাজব্যবস্থার এই পরিবর্তন মৌলিক বা মূলগত এবং প্রগতিশীল শ্রেণীর স্বার্থে হওয়া চাই। হার্বার্ট আপথেকার তাঁর Democracy. Freedom and Revolution শীর্ষক গ্রন্থে বিপ্লব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। আপৃথেকারের মতানুসারে বিপ্লব হল একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি। এর মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং একটি শাসকশ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন একটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়। আপথেকার বলেছেন: “I would rather define revolution as an historical process leading to and culminating in social transformation, wherein one ruling class is displaced by another, with the new class representing, as compared to the old, enhanced productive capacities and socially progressive potentialities.” এই নতুন শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রগতিশীল বিবেচিত হয়। সুতরাং বাস্তবে বিপ্লব বলতে পুরাতন একটি শ্রেণীর হাত থেকে নতুন একটি শ্রেণীর হাতে রাজনীতিক ক্ষমতার হস্তান্তরকে বোঝায়। অর্থাৎ প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের ধারক শাসকশ্রেণীকে উৎখাত করে নতুন প্রগতিশীল শ্রেণী কর্তৃক ক্ষমতা দখল এবং নতুন একটি উৎপাদন সম্পর্কের সৃষ্টিই হল বিপ্লব। শোষণকারী শাসকশ্রেণী সহজে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সম্মত হয় না। শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখল করতে হয়। তাই লেনিন বলেছেন: “The question of power is the fundamental question of every revolution.”
রাজনৈতিক বিপ্লব: বিপ্লবের অর্থ আলোচনার ক্ষেত্রে রাজনীতিক বিপ্লব ও সামাজিক বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক। অনেকে প্রশাসন ক্ষমতার হস্তান্তরকে বিপ্লব হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বিপ্লব সম্পর্কিত এই ধারণা অস্পষ্ট। শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর মানে সরকার পরিচালনাকারীর পরিবর্তন। এর দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকদলের পরিবর্তন যেমন বোঝায়, তেমনি আবার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে নাৎসীবাদী বা ফ্যাসীবাদী শাসনের প্রতিষ্ঠাকেও বোঝায়। শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর সাংবিধানিক উপায়, হিংসাত্মক পদ্ধতি, দুর্নীতিমূলক নির্বাচন প্রভৃতি বিভিন্ন উপায় পদ্ধতিতে হতে পারে। এ রকম পরিবর্তনের ফলে সরকারের নেতৃত্ব, চেহারা-চরিত্রে, উপরিকাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। এই রকম পরিবর্তনকে রাজনীতিক বিপ্লব বলে। সাধারণভাবে বিপ্লব হল এক ধরনের রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ। রাজনীতিক বিপ্লব পুরাতন রাষ্ট্র-ক্ষমতার ধ্বংস সাধন করে। কার্ল মার্কস The Eighteenth Brumaire-এ ফরাসী বিপ্লবকে রাজনীতিক বিপ্লব হিসাবে অভিহিত করেছেন। ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটেছে এবং রাজনীতিক ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। কিন্তু এই বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
সামাজিক বিপ্লব: মার্কসবাদী দার্শনিকগণ বিপ্লবের তত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে রাজনীতিক বিপ্লবকে বড় করে দেখেন না। তাঁরা সামাজিক বিপ্লবের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। সামাজিক বিপ্লব হল সামগ্রিকভাবে সমাজব্যবস্থার এক রূপান্তর। এ হল সমাজ-বিকাশের এক গুণগত উল্লম্ফন। এর ফলে পুরাতন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের অবসান ঘটে এবং একটি নতুন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের আবির্ভাব হয়। সুতরাং সামাজিক বিপ্লব হল এক ধরনের অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের ফলে ঐতিহাসিক বিচারে পুরাতন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের উচ্ছেদ ঘটে এবং অধিকতর প্রগতিশীল এক আর্থসামাজিক বিন্যাসে সমাজব্যবস্থার উত্তরণ ঘটে। বস্তুত বিপ্লব হল এক সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের রক্ষক শাসকশ্রেণীর পতন ঘটে এবং নতুন একটি শ্রেণী রাষ্ট্রীয় বা রাজনীতিক ক্ষমতা দখল করে। এই নতুন ক্ষমতাসীন শ্রেণীটি এক নতুন উৎপাদন-সম্পর্ক কায়েম করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মার্কসবাদীদের মতানুসারে সামাজিক বিপ্লবের মূল ভিত্তি হল উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বৈরিতা। তা ছাড়া ক্ষমতার বিষয়টিও একটি মৌলিক বিষয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা রাজনীতিক ক্ষমতা একটি শ্রেণীর কাছ থেকে অন্য একটি শ্রেণীর কাছে হস্তান্তরিত হয়। সামাজিক বিপ্লবের আর্থনীতিক লক্ষ্য হল আগেকার উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে বিকাশমান উৎপাদন শক্তির বিরোধের অবসান ঘটান। এর জন্য প্রয়োজন হল উৎপাদন-উপাদানের মালিকানার পরিবর্তন। আবার সামাজিক বিপ্লবের রাজনীতিক উদ্দেশ্য হল এক নতুন রাজনীতিক ও আইনগত উপরি কাঠামো গড়ে তোলা। এই উপরি-কাঠামো নতুন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসকে বিকশিত ও দৃঢ়ভিত্তিক করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিফলন: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে বিপ্লব হল একটি সামাজিক ব্যবস্থা। বিপ্লব সমাজজীবনেরই অংশ। এর ফলেই পুরাতন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয় এবং নতুন প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রেণী-সম্পর্ক বদলায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস-বিশ্বাস প্রভৃতিরও পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন সাধিত হয়। সুতরাং সামাজিক বিপ্লব হল একটি সুনির্দিষ্ট সামাজিক প্রগতির বিধি। এ হল একটি সচেতন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। প্রকৃত প্রস্তাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতেই মার্কসবাদীরা সামাজিক বিপ্লবের প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন। এই ঐতিহাসিক পদ্ধতিতেই আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে মানবসমাজ দাসসমাজে, তারপর সামস্ততান্ত্রিক সমাজে, তারপর পুঁজিবাদী সমাজে এবং তারপর সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে। বিপ্লব সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিফলন হিসাবে পরিগণিত হয়।
রাজনীতিক ও সামাজিক বিপ্লব: রাজনীতিক বিপ্লব ও সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য আছে। মার্কস ও এঙ্গেলস্ রাজনীতিক ও সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেছেন। এঁদের মতানুসারে সামাজিক বিপ্লব ব্যতিরেকে রাজনীতিক বিপ্লব অর্থবহ হয়ে উঠে না। সামাজিক বিপ্লবের ফলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় বা রাজনীতিক ক্ষমতার হস্তান্তরের মধ্যেই সামাজিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য সীমাবদ্ধ নয়। সামাজিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য হল আর্থ-রাজনীতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন। যাইহোক পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবের পথে রাজনীতিক বিপ্লব প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। তেমনি আবার এই দু’ধরনের বিপ্লব পৃথকভাবে আসবে তাও নয়।
Leave a comment