‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবির বক্তব্য তার কাব্যিক ভাষা ও ছন্দরূপ নিয়ে সুসংহতি লাভ করেছে কিনা বিচার করো।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কবির এক ভাবতন্ময় অবস্থায় রচনা। ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে তালতলায় এক বাসায় সারারাত আলো জ্বালিয়ে নজরুল এই দীর্ঘ কবিতাটি লেখেন এবং তারপরেই কবিতাটি বিভিন্ন কাগজে মুদ্রিত হয়। কবিতাটি লেখার পর, কবিতার যে পরিমার্জনা তা সম্ভবতঃ করা হয় নি। অবশ্য নজরুল প্রতিভায় সৃজনশক্তির সঙ্গে লালনী বা পালনী শক্তির শুভ সংযোগ বিশেষ ছিল না। নজরুলের প্রায় সব রচনাই তাৎক্ষণিক মুহূর্তের রচনা। রচনা শেষ এবং যেন নজরুলের দায়িত্বও শেষ। তাঁর সৃষ্ট সেই সম্পদ যেন আর তাঁর নয়, তা জনসাধারণের। এর ফলে প্রাণের আবেগতাড়িত তাঁর যে-কোন রচনাতেই ভাব-ভাষা ছন্দের দিক দিয়ে, আঙ্গিক ও অঙ্গসজ্জার দিক দিয়ে কমবেশী কিছু কিছু অমনস্কতার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে বন্যার প্রবল স্রোেত যেমন অমসৃণ চড়াই-উৎরাই ও পথ-বিপথকে মাড়িয়ে, বাধাবন্ধন ভাসিয়ে সবকিছুকে নিয়ে বয়ে চলে যায়, তেমনি নজরুলের কবিতায়ও ভাব-বন্যার অসামান্যতা আঙ্গিক ও ভাষার ছোটখাট ত্রুটির সামান্যতাকে ভাসিয়ে নিয়ে রসিক পাঠকের ভাবসমুদ্রে মিলিত হয়েছে। ফলে আপামর পাঠক সাধারণের সানন্দ অভিনন্দন নজরুল লাভ করেছেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির প্রকাশ লগ্নেই যেমন তৎকালীন বঙ্গভাষাভাষী মানুষ কবিতাটিকে সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছিলেন, তেমনি এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নিয়ে তৎকালীন কিছু কিছু সমালোচকের বিরূপ সমালোচনারও অন্ত ছিল না। পরবর্তীকালে নজরুলের গুণগ্রাহী হলেও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ‘শনিবারের চিঠি’ প্রথমদিকে দুমুখেরই ভূমিকা পালন করেছিল। কবি সমালোচক মোহিতলাল তো হয়ে উঠলেন দণ্ডপাণি। এইসব প্রতিবাদী সমালোচনা অঙ্গে বরণ করে নিয়েও কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যে একটি যুগান্তকারী কবিতা এবং সমকালীন মানসিকতার পরিচয়-লিপি নিয়েও চিরকালীন আবেদনের এক গভীরতর সুর কবিতাটিতে ধ্বনিত হয়েছে এ সম্বন্ধে মতভেদের অবকাশ নেই।
অবশ্য ভাবসম্বন্ধে কবিতাটি ঋদ্ধ হলেও বক্তব্য পরিবেশনে, আঙ্গিক রচনায়, ছন্দসৃষ্টিতে কবির অসাবধানী মানসিকতার ছাপ যে কিছু কিছু রয়েছে তা কবি ও কবিতাটির প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হয়েও উল্লেখ করাটা একেবারে অসঙ্গত বা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
ভাবতন্ময় অবস্থায় কবিতাটি রচনা করার ফলে এবং পরবর্তীকালে এর সংস্করণ ও পরিমার্জন না করার ফলে কবিতায় প্রথম থেকেই বক্তব্য পরিবেশনে কিছুটা গঠন-কৌশলগত অগোছালো ভাব রয়ে গেছে। কবিতাটিতে কবি বিদ্রোহী সত্ত্বার ধ্বংসাত্মক ও সৃষ্টিশীল শক্তি, তাঁর নিস্পৃহ ঔদাস্য, রোমান্টিক মানসিকতা এবং আপন খেয়ালীপনার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন স্তবকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে অন্বিত হয়ে এগুলি পরিবেশিত হয় নি। আপন বিদ্রোহী সত্তার এক একটা দিককে নিয়ে এক একটা স্তবক গড়ে উঠলে কবির ভাবনা আরো সংহত হয়ে ধাপে ধাপে পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা হয় নি।
প্রথম স্তবকে কবি বীররূপী সবাইকে আহ্বান করে, সবাইকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। দ্বিতীয় স্তবকে তুলে ধরেছেন বিদ্রোহী সত্তার ধ্বংসাত্মক রূপকে। তৃতীয় স্তবকের প্রথমদিকে ‘নৃত্য-পাগল ছন্দে’ নেচে ওঠা বিদ্রোহী মনের খেয়ালীপনার পরিচয় কবি দিয়েছেন। এতে অসঙ্গতির কিছু নেই। কিন্তু ঐ স্তবকেরই শেষ পাঁচটি ছত্রে আবার হঠাৎ তিনি বিদ্রোহের ধ্বংসাত্মক রূপটিকে তুলে ধরেছেন। এর ফলে একই স্তবকে দুটি ভাবনার মিশ্রণ ঘটে গেছে। চতুর্থ স্তবকে বিদ্রোহী সত্তার যে দুটি দিক, তার সৃষ্টি ও ধ্বংস, শুভ ও অশুভ শক্তির পরিচয়কেই বিভিন্ন উপমা, উদাহরণ যোগে বিস্তৃত করে তুলে ধরেছেন। কিন্তু পঞ্চম স্তবকে কবির ভাব-তাড়িত মন বেশ কয়েকটি ভাবনাকে একত্র গ্রথিত করে ভাব-শৃঙ্খলার কিছুটা অপহ্নব ঘটিয়েছে, স্তবকের প্রথমদিকে কবির বিদ্রোহী সত্তা নিঃস্বার্থ সন্ন্যাসীর মতো, গৈরিক বস্ত্র পরিহিত যুবরাজের মতো বলে তিনি আরম্ভ করেছেন।
কিন্তু তারপরেই তার প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রকাশ কবিতাটিতেই বর্ণিত। তারপরেই ১৩ সংখ্যক ছত্রে বলেছেন, ‘আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত, দারুণ স্বেচ্ছাচারী’। এই স্বেচ্ছাচারী খেয়ালীপনার কথা বলেই কবি তাঁর রোমান্টিক খেয়ালীপনায় ফিরে গেছেন। তিনি শুধু ‘উজ্জ্বল’ ও ‘প্রোজ্জ্বলই নন, তিনি ‘উচ্ছল-জল-ছল-ছল, চল-উর্মির হিন্দোল দোল’। ফলে এই স্তবকে তিনি নানা ভাবনার প্রান্ত ছুঁয়ে গেছেন, কিন্তু কোনো ভাবনাই এককভাবে সংহত হয়ে দানা বাঁধতে পারেনি।
ষষ্ঠ স্তবকটিতে কবি রোমান্টিক-বিদ্রোহী। এখানে বিষয়গতভাবে বিদ্রোহী চিন্তার সঙ্গে এই রোমান্টিক প্রেমভাবনা সঙ্গত কিনা, এ নিয়ে সমালোচকগণ প্রশ্ন তুললেও ভাবনাগত ঐক্য এই স্তবকের প্রথম অর্ধে বজায় আছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের আটটি ছত্রে কবি আবার ভুবনে ত্রাস সঞ্চারক বিদ্রোহী। এখানে দুটি ভাবনার পরিচয় থাকলেও তা দুটি অর্ধে বিন্যস্ত হয়েছে। সপ্তম স্তবকে ‘অর্ফিয়াস’ ও ‘শ্যামের হাতের বাঁশরী’ নিয়েই স্তবকের শেষাংশে তিনি রুষে উঠেছেন।
অষ্টম স্তবকে বিবৃত হয়েছে বিদ্রোহী শক্তির প্লাবনী বেগ। অবশ্য এর পর থেকে কবির বর্ণিত প্রসঙ্গকে নিয়েই এক একটি স্তবক মোটামুটি গড়ে উঠেছে। প্রলয়োচ্ছ্বাসী ভাবনায় প্রথম বেগ যেন অনেকটা সংহত হয়েছে। তাই গঠন-কৌশলের দিক দিয়ে পরবর্তী স্তবকগুলিতে ভাবনার বিমিশ্রিণগত ত্রুটি নজরে পড়ে না।
কবিকল্পনার আর একটা ত্রুটির উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কবিতার একাদশ স্তবক প্রসঙ্গে বলা যায় সর্ববন্ধনমুক্ত বিদ্রোহীর মহনীয়তা এখানে ঠিক বজায় থাকেনি। বিদ্রোহীর প্রধান গৌরব এই যে বিদ্রোহী কখনো ক্লান্ত শ্রান্ত হবে না। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ বিদ্রোহীর যাত্রাপথে ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই। কিন্তু সেই বিদ্রোহী যখন বলেন—
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শাস্ত!
—তখন সেই মহান বিপ্লবের মহনীয়তা ব্যাহত হয় না কি?
কবিতার ভাষা নির্মাণে কিন্তু কবির দক্ষতার পরিচয়ই ছড়িয়ে আছে। শব্দব্যবহারে কবি তৎসম শব্দের সঙ্গে তদ্ভব, দেশী শব্দ এবং তার সঙ্গে হিন্দী, আরবি ও ফারসী শব্দের সহজ মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ‘দুর্দম’-এর সঙ্গে ‘হর্দম হ্যায় হর্দমে’র একেবারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ঘটিয়েছেন। ‘অরুণে’র সঙ্গে ‘খুন’ মিলে অরুণখুন হয়ে গেছে। ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রেও কবি নির্বাচিত শব্দাবলি তাঁর ভাবনার অনুগামী হয়ে উঠেছে। কবি যখন রুদ্রবিপ্লবী হয়ে ভাঙ্গার নেশায় মেতে উঠেছেন তখন কবিতায় তাঁর শব্দ প্রয়োগ হয়েছে সেই ভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, ‘আমি মহামারী’, ‘আমি ভীত এ ধরিত্রীর। আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার, আমি উষু চির-অধির।’ অথবা, ‘আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড। আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব নাদ প্রচণ্ড।’ অথচ কবি যখন রোমান্টিক তখন কবি ব্যবহৃত শব্দগুলিও আশ্চর্যভাবে লঘুচপল। যেমন, ‘আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!’ অথবা ‘আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাকন চুড়ির কন-কন্।’ অবশ্য এই সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় কবি ব্যবহৃত কিছু কিছু অসতর্ক শব্দ প্রয়োগের কথাও উল্লেখ করতে হয়। যেমন ষষ্ঠ স্তবকে ব্যবহৃত—
‘আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।”
এবং
‘আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ জ্বালা, প্রিয়লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!
এই পংক্তি দুটিতে ‘ধন্যি’ এবং ‘গতি ফের’ শব্দপ্রয়োগ খুব সতর্ক প্রয়োগ নয়। এ ছাড়া একই শব্দের বারবার প্রয়োগও দেখা যায়। ‘উন্মাদ’, ‘ঝঞ্ঝা’, ‘ঘূর্ণি’, ‘বাঁধ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এরকম ঘটেছে।
কবিতাটি ধ্বনিপ্রধান ছন্দে রচিত। কিন্তু দীর্ঘ পংক্তি ও হ্রস্ব পংক্তিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দ কবিতার ভাবনার মতোই উচ্ছ্বসিত। অবশ্য এই উচ্ছ্বাস কিছু কিছু স্থানে মাত্রার বাঁধ অতিক্রম করায় ছন্দ নির্মাণও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যেমন, ‘আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ!’
কবিতার সর্বাঙ্গীণ বিচারে কবিতায় ত্রুটি হিসেবে এইসব কথা বলার পরেও বলতে হয় এই বিচারেও কবিতার সঠিক মূল্য কমে না। কবির ভাবতন্ময় অবস্থায় রচিত এই দীর্ঘ কবিতায় এইরকম ত্রুটি অস্বাভাবিক নয়। এভাবে বিচার করলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বা বিশ্ববন্দিত নাট্যকার শেকস্পীয়রের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনাতেও ত্রুটি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। তাই আমরা এই ছোটখাট ত্রুটির উল্লেখ করেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে একটি প্রথম শ্রেণির কবিতা এবং নজরুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করতে পারি। শুকনো পাতা ও ভাঙ্গা ডাল নিয়েও বনস্পতি যেমন বনস্পতিই, তেমনি এইসব সামান্য দোষ-ত্রুটি নিয়েও সমগ্র নজরুল সাহিত্যে তথা বাংলা সাহিত্যেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বনস্পতিই হয়ে উঠেছে তার ব্যাপকতা, বিশালতা ও মহিময়তা নিয়ে।
Leave a comment