‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সমকালীন ভারত তথা বাংলাদেশের যে অশান্ত অবস্থা এবং সহসা নিজেকে চিনতে পারার ফলে কবির মধ্যে যে আত্মজাগরণ ও সেই জাগরণজনিত উচ্ছ্বাস, তার পরিচয় কবিতাটির সর্বাঙ্গে অঙ্কিত। কবির সেই নব-জাগরিত স্বরূপ চেতনা ধ্বংসের কাজ বা নতুন সৃষ্টির কাজ বা রোমান্টিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ যাই করুক না কেন, সবকিছুর মধ্যেই অহংবোধের প্রবলতা প্রবলভাবেই উপস্থিত। সেই প্রবল অহংবোধ এবং ভাবের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ নিয়ে বিদ্রোহী কবি উন্নতশিরে দণ্ডায়মান। এই মানসিক অবস্থাকে প্রকাশ করতে গিয়ে কবি যে সব পৌরাণিক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছেন ও পৌরাণিক চরিত্রসমূহের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন তা কবির ভাবনা বিস্তারে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বর্গ-মর্ত-পাতাল জুড়ে সংগৃহীত এই পুরাণ প্রসঙ্গ কবির কাব্যকল্পনাতেও এক মহিময়তা যুক্ত করেছে। কবি কল্পনা যেমন একদিকে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল পরিভ্রমণ করেছে, তেমনি পুরাণ প্রসঙ্গের এইসব উল্লেখের মধ্য দিয়ে কবি বর্তমান থেকে অতীত ও দূর অতীতেরও যাত্রী হয়েছেন, কবি কল্পনা হয়েছে কালাতিক্রমী।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ব্যবহৃত এই বিবিধ পুরাণ কথা কবির ব্যাপক পুরাণ জ্ঞানেরই পরিচায়ক। মুসলিম ধর্ম ও বাইবেল-কথিত পুরাণ কথার সঙ্গে কবি ব্যাপকভাবে হিন্দু পুরাণ থেকে ঘটনা ও চরিত্রের উল্লেখ প্রচুরভাবেই করেছেন। এইসব উল্লেখের মধ্যে দিয়ে কবির গভীর পুরাণজ্ঞান ছাড়াও তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও উদার মনোভাব কবিতাটিতে বিধৃত হয়েছে।
প্রথম স্তবকে মহাবিশ্বের মহাকাশকে ভেদ করে দণ্ডায়মান বিদ্রোহীর চির-উন্নত শিরের কথা বলতে গিয়ে কবি একই সঙ্গে বিহ্বলোক ‘গোলোক’ এবং খোদার সিংহাসন ‘আরশ’-এর কথা বলেছেন।
দ্বিতীয় স্তবকে নটরাজের প্রলয়ঙ্করী নৃত্যের কথা আছে। রয়েছে ধূর্জটীরূপী শিবের কথা। চতুর্থ স্তবকে উল্লেখিত রয়েছে মহর্ষি জমদগ্নির কথা। বৈদিক দেবতা অগ্নিরও উল্লেখ রয়েছে। অগ্নি যে দেবতাদের পুরোহিত তাও কবির অজানা ছিল না। শিব প্রসঙ্গ এই কবিতায় নানাভাবেই এসেছে। একরূপে তিনি কৃয়-কণ্ঠ বা নীলকণ্ঠ। সমুদ্রমন্থনজাত বিষটুকু নিজে নিয়ে সবাইকে অমৃত দান করেন এবং তিনি ব্যোমকেশ, অনও ব্যোমে কেশজাল ছড়িয়ে সৃষ্টির অনুকূলে প্রলয়ঙ্করী গঙ্গার ধারাবেগকে ধারণ করেন—যোগ্যভাবেই আপন মানসিকতার সঙ্গে সাঙ্গীকৃত করে পুরাণ ভাবনাকে কবি প্রকাশ করেছেন।
পঞ্চম স্তবক যেন কবির অস্ত্রলাভ পর্ব। নিজের বিধ্বংসী শক্তির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি দেবতাদের ভয়ঙ্কর সব অস্ত্রের সঙ্গে নিজেকে তুলিত করেছেন। এই অস্ত্রের মধ্যে আছে ‘বজ্ৰ’, ‘বিষাণ’, ‘শিঙ্গা’, ‘পিনাক-পানির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, চক্র, মহাশঙ্খ। এ ভিন্ন হিন্দু পুরাণের ‘মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহুগ্রাস’ প্রসঙ্গও এখানে এসেছে। পৌরাণিক চরিত্র ক্রোধী ও তেজস্বী ঋষি দুর্বাসা ও বিশ্বামিত্রেরও উল্লেখও এই স্তবকে পাই। কবি দুর্বাসাকে বিশ্বামিত্র-শিষ্যরূপে যে বর্ণনা করেছেন তা অবশ্য পুরাণসম্মত নয়।
ষষ্ঠ স্তবকের শেষদিকে ইসলাম পুরাণের ‘তাজী বোররাক’ (স্বর্গের পক্ষীরাজ ঘোড়া) এবং ইন্দ্রের বাহন ‘উচ্চৈঃশ্রবা’র উল্লেখ করেছেন। এই দুই পুরাণের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুন-পাখা। পুরাণ কাহিনীতে ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে বাসুকি ও বাসুকির ফণার কথা বলা হয়েছে, তারও উল্লেখ এখানে কবি করেছেন।
সপ্তম স্তবকে গ্রীক পুরাণের অর্ফিয়াসের বাঁশরীর মোহিনী সুরের সঙ্গে কবি মিলিয়ে দিয়েছেন জগমোহন কৃয়ের হাতের বাঁশরী। আগের স্তবকে উল্লেখিত হয়েছে হিন্দু পুরাণের ‘পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথারের’ কথা, এখানে বলেছেন মুসলিম পুরাণের সপ্ত নরক এবং ‘হাবিয়া দোজখে’র ভয়ঙ্কর আগুনের কথা।
অষ্টম স্তবকে এসেছেন ভয়ঙ্করী রূপ নিয়ে দশমহাবিদ্যার অন্যতমা ছিন্নমস্তা, তাঁর রণদামূর্তিতে। আবার এসেছে জাহান্নামের বিধ্বংসী আগুনের কথা। নবম স্তবকে জগদীশ্বর-ঈশ্বর পুরুষোত্তম বিষুর উল্লেখ পাওয়া যায়। দশম স্তবকে অত্যাচারী শাসক ক্ষত্রিয়দের আতঙ্ক পৌরাণিক চরিত্র পরশুরাম ও তাঁর কুঠারের উল্লেখ রয়েছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে অবতার বলরামও তাঁর হলস্কন্ধে উপস্থিত হয়েছেন।
দশম স্তবকে এসেছে মহর্ষি ভৃগুর কথা। অবশ্য তাঁর ভগবান-বিদ্রোহী রূপ পুরাণসম্মত নয়। তবু মহর্ষি ভৃগুর তেজস্বিতা এবং পরীক্ষার্থে হলেও তাঁর দুঃসাহসী কাজ ভগবান বুকে পদাঘাতের পৌরাণিক কাহিনীকে কবি ভিন্নার্থে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
হিন্দু পুরাণ থেকে ঘটনা ও চরিত্রের অজস্র উল্লেখ এবং সেই সঙ্গে মুসলিম, খ্রিস্টীয় ও গ্রিক পুরাণকথা থেকে সংগৃহীত উপাদান নিয়ে কবি তাঁর কাব্যদেহ নির্মাণ করেছেন। এই সুবিপুল সং এবং কাব্যদেহে তাঁর প্রয়োগ কবির পল্লব গ্রহিতার প্রমাণস্বরূপ হয়ে কাব্যদেহকে ভারাক্রান্ত করেনি, এই দৃষ্টান্তগুলি কবির নিছক পৌরাণিক জ্ঞানের প্রমাণমাত্রই হয়ে থাকেনি। এই পৌরাণিক প্রসঙ্গকথা যেন স্বতঃস্ফূরিত ধারায় কবি-মনে উৎসারিত হয়েছে এবং বিদ্রোহী কবির প্রবল ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই কাব্যদেহে স্থান করে নিয়েছে। কবির কাব্য-ভাবনার সঙ্গে পুরাণ প্রসঙ্গ অদ্বয় বোধে মিলে গেছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার অঙ্গে এই পুরাণ কোথাও উপমারূপে, কোথাও বা চিত্রকল্প রূপে এসেছে। হিন্দু ও গ্রীক পুরাণের উল্লেখ নজরুলের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় বহন করে। হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে মুসলিম ধর্মকেন্দ্রিক শব্দের সংমিশ্রণ এবং সমান্তরালভাবে গ্রীক পুরাণের ব্যবহার ভাবগত দিক দিয়ে কবিমানসের ঐক্যবাহিতার পরিচয় দেয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মনোভাবও যে এখানে ক্রিয়াশীল ছিল তার স্বাক্ষরও এইসব বিরুদ্ধ ধর্মাদর্শের পুরাণ-প্রয়োগে প্রমাণিত হয়। যে বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী মানসিকতা থেকে এই কবিতাটির জন্ম, সেই মানসিকতাই কবিকে পুরাণের এই অপক্ষপাত প্রয়োগে সাহায্য করেছে। কবির এই পুরাণ কথার ব্যবহার শুধু সুপ্রযুক্তই নয়, কাব্য কল্পনাতেও বিশালতা ও মহিময়তার মাত্রা সংযুক্ত করেছে। এইখানেই কবির সার্থকতা।
Leave a comment