বিদ্রোহী কবিতাটি রচনাকালে নজরুল ইসলামের মানসভূমি যে নিতান্ত অশান্ত ছিল, কবিতার সচেতন পাঠেই-সে কথা বোঝা যায়। কবির শব্দ প্রয়োগ কোথাও অমার্জিত এবং উচ্ছ্বসিত, ছন্দও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসংযমী—কিন্তু এই উচ্ছ্বসিত মানসিক অবস্থাতেও যোগ্যস্থানে কবি যেসব পৌরাণিক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছেন বা পৌরাণিক চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে চেয়েছেন সেগুলি অত্যন্ত উপযোগী হয়েছে। এ থেকেই কবির পুরাণ জ্ঞানের গভীরতার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এই পুরাণ-জ্ঞান কেবল মুসলিম ধর্মের মধ্যেই আবদ্ধ নয়—হিন্দু পুরাণ ও বাইবেল থেকেও কবি প্রচুর দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছেন। এতে পুরাণ জ্ঞানের পরিচয় ছাড়াও তাঁর উদার এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

প্রথম স্তবকেই কবি বিষ্ণুর আবাস গোলকের সঙ্গে একইভাবে উচ্চারণ করেছেন খোদার সিংহাসন ‘আরশ’-এর কথা। চতুর্থ স্তবকে কবি অগ্নিদেবতার উল্লেখ করেছেন যেভাবে তাতে মনে হয় এই দেবতাকে যে দেবতাদেরও পুরোহিত বলা হয় সে কথা তাঁর জানা ছিল। তিনি লিখেছেন—

“আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।”

এই স্তবকেই কবি মহাদেবের দুটি পৌরাণিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন—দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনে অমৃতের সঙ্গে বিষের উদ্ভব ঘটলে মহাদেবের তা কণ্ঠে ধারণ এবং ভগীরথের আহ্বানে গঙ্গাকে মস্তকে ধারণ। দুটি ক্ষেত্রেই মহাদেবের প্রাসঙ্গিক নামান্তর তিনি ব্যবহার করেছেন।

পঞ্চম স্তবকে কবি ধ্বংসের চরম কিছু প্রতীক ব্যবহার করতে গিয়ে দেবতাদের প্রধান অস্ত্রের নাম করেছেন। এর মধ্যে আছে ‘বজ্র’’, ‘পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল’, ‘ধর্মরাজের ‘দণ্ড’, ‘চক্র’ এবং ‘মহাশঙ্খ’। কবি যে শুধু হিন্দু পুরাণের সঙ্গেই পরিচিত নন, তার পরিচয়ও এখানে রেখেছেন—

“আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,”

কবি এই স্তবকেই আর একটি ধ্বংসময় পৌরাণিক প্রসঙ্গ ব্যবহার করেছেন— 

“আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস।”

কবির বিভিন্ন দেশীয় পুরাণে পাণ্ডিত্যের ভালো প্রমাণ পাওয়া যায় অষ্টম স্তবকে। কবির ইসলাম এবং হিন্দু পুরাণের জ্ঞানের পরিচয় পাই স্বর্গের পথ্বীরাজ ঘোড়া ও ইন্দ্রের বাহনের পাশাপাশি উল্লেখে—

“তাজি বোরাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার”

সেই সঙ্গে বাইবেলের গল্পও তাঁর মনে পড়ে, তিনি লেখেন—

“ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি!”

এর পূর্বেই তিনি পৃথিবীতে ভূমিকম্পের কারণ সম্বন্ধে পৌরাণিক প্রবাদ হিসাবে পাতালরাজ বাসুকির উল্লেখ করেছিলেন। হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টান-পুরাণের উল্লেখ এই স্তবকে আরও আছে। বাঁশরী প্রসঙ্গে কবি শ্রীকৃষ্মের হাতের মদুর মুরলীর উল্লেখ করতে যেমন ভোলেন না তেমনি মায়াময় বংশীধ্বনির অন্য উদাহরণও তাঁর মনে পড়ে, তিনি বলেন—

“আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী”,

কবি হিন্দু পুরাণ অনুসারে ‘পাতালে মাতালে অগ্নি-পাখারের’ উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হন না, মুসলিম পুরাণের নরকের কথাও তাঁর মনে পড়ে—

“আমি রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, 

ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।”

নবম স্তবকে কবি দশমহাবিদ্যার ‘ছিন্নমস্তা চণ্ডী’র উল্লেখ করেছেন এবং পরের পঙক্তিতেই তাঁর লেখনীতে এসেছে ‘জাহান্নম’। দশম স্তবকে বলরাম-অবতারের হলস্কন্ধ চেহারা তিনি উল্লেখ করেছেন এবং বিশ্বকে উৎপাটিত করে ফেলার প্রসঙ্গে নিঃসংশয়ভাবে বলরামের হস্তিনাপুর নগরী উৎপাটিত করবার প্রয়াসকে স্মরণ করেছেন।

কবি তাঁর এই কবিতায় কয়েকজন পৌরাণিক ঋষির নাম করেছেন, এঁরা হলেন জমদগ্নি, দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র, পরশুরাম এবং ভৃগু। প্রত্যেক ঋষিই অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন অথচ প্রচণ্ড ক্রোধী। এঁদের ক্রোধের শিকার অনেককেই হতে হয়েছিল। জমদগ্নির ক্রোধে তাঁর স্ত্রীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, দুর্বাসার অভিশাপের কথা পুরাণ-প্রসিদ্ধ, বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বশিষ্ঠর সংঘর্ষের কাহিনিও আমাদের অতি পরিচিত। পরশুরামের ক্রোধের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে ক্ষত্রিয়কুল, একুশ বার তিনি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেছেন, ভৃগুর অভিশাপের হাত থেকে স্বয়ং দেবতারও নিষ্কৃতি ছিল না।

কবি তাঁর এই কবিতায় পৌরাণিক জ্ঞানের নিঃসংশয় প্রমাণ রেখেছেন অনেকবার, কিন্তু সেগুলি সুপ্রযুক্ত হয়েছে কোনো ক্ষেত্রেই—তাঁর পৌরাণিক অনুষঙ্গগুলি কখনও কবিতার ভাবস্বরূপ হয়ে ওঠেনি, সেটাই এ কবিতার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য।