বিশ্বকে কবি অধীন বলেছেন দুটি কারণে। প্রথমত, যে বিশেষ রাজশক্তি পৃথিবীকে পদানত করে রেখেছে, সেই ব্রিটিশ রাজশক্তিকেই তিনি ইঙ্গিত করেছেন। পৃথিবীতে ঈশ্বর জীবসৃষ্টি করেছেন কাউকে পদানত করে রাখবার জন্য নয়—তাঁর পৃথিবীতে সবাই স্বাধীন। অথচ ব্রিটিশ রাজশক্তি পৃথিবীর বহু জাতিকে তাদের শক্তির দাপটে বশীভূত করে রেখেছে। সুতরাং বিশ্ব এখন আর স্বাধীন নয়, সে পরাধীন।

দ্বিতীয়ত, কবি বিভিন্ন সংস্কারের কথাও বুঝিয়ে থাকতে পারেন। ঈশ্বর মানুষকে আনন্দ দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, কিন্তু মানুষ নিজেই এখানে বিভিন্ন সংস্কারের বেড়া দিয়ে নিজের স্বাধীন আনন্দের পথ রুদ্ধ করে ফেলছে। সে জাতিভেদের বেড়া তুলেছে, সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর নির্মাণ করেছে—ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপ বিভিন্ন বিধি-নিষেধের সৃষ্টি করে সে নিজেকে ক্রমাগত ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। তার স্বাধীন সত্তা এতে পদে পদে বিঘ্নিত হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ এইভাবে নিজেদের স্বীকৃত অধীনতার জালে জড়িয়ে ফেলেছে বলেও কবি এই বিশ্বকে অধীন বলে থাকতে পারেন।

কবি কবিতার প্রথমেই বলেছেন তিনি বিদ্রোহী। সকল প্রকার অধীনতা ও বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করাই তাঁর প্রধান কাম্য। তাই তিনি এই বিশ্বকে উৎপাটিত বা নির্মূল করে ফেলতে চান। বিশ্বকে উৎপাটিত করার প্রসঙ্গে তিনি হল স্কন্ধে বলরামের মূর্তিকে স্মরণ করেছিলেন। বলরাম একবার শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্বকে উদ্ধার করতে এসে কৌরবপুরী হস্তিনাপুরকে তাঁর হলের অগ্রভাগ দিয়ে উৎপাটিত করার উপক্রম করেছিলেন। কবিও সেই ভাবে এই পৃথিবীকে উৎপাটিত করতে চান। অবশ্য কবির বক্তব্যের আসল অর্থ, তিনি পৃথিবী থেকে সমস্ত রকমের অধীনতার মুলোচ্ছেদ করতে চান। রাজশক্তির বাহ্য পরাক্রমে যে সমস্ত জাতি মানুষের অধিকার খর্ব করে উৎপীড়ন করছে, তিনি সে সব তো দূর করবেনই, সেই সঙ্গে পৃথিবীতে যেসব সংস্কার এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ মানুষের জীবনকে পঙ্গু এবং অসার করে ফেলছে—তাদের আসুরিকভাবে জড় শক্তির অধীন করে জীবনের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে, সেই সংস্কারের আবর্জনাও তিনি সবল হাতে নির্মূল করে দিতে চান।

নবসৃষ্টি বলতে কবি বুঝিয়েছেন এই পৃথিবীকে নূতন করে সৃষ্টি করা। কবি আজকের এই দূষিত পরিবেশ এবং সংস্কারের বিষাক্ত ভূমির পরিবর্তে এমন এক পৃথিবী সৃষ্টি করতে চান যেখানে মানুষ আর অন্য মানুষের অধিকার কেড়ে নেবে না, যেখানে মানুষ সংস্কারের মোহে মানবত্বকে ভুলে থাকবে না, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিকে অন্ধ করে রাখবে না। এক কথায় সে সর্বপ্রকারের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এক অপরূপ স্বাধীনতায় আনন্দ উপভোগ করবে।

কবির এই নবসৃষ্টির কথা থেকে আর একটি ব্যাপারও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। কবি তাঁর এই কবিতার প্রারম্ভ থেকে প্রায় সমাপ্তি পর্যন্ত নিজের প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক শক্তির কথা সগর্বে প্রকাশ করে এসেছেন। কোনো স্থির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছাড়া এই ধরনের ধ্বংসকাণ্ড অন্ধত্বেরই নামান্তর। কবি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পেরেছেন তাঁর এই ধ্বংস অহেতুক নয়। তিনি পৃথিবীর অধিবাসীর উৎপীড়ন ও জ্বালা যন্ত্রণা দেখে ব্যথিত। তাই প্রচণ্ড ধ্বংসের রূপ ধরে তিনি এসেছেন সেই উৎপীড়ন ও অত্যাচারের কারণ নির্মূল করতে। তাঁর আসল উদ্দেশ্য এক সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা।