বিষয়ের বিচারে এবং বক্তব্যের ক্ষেত্রে যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি একটি যুগান্তকারী কবিতা এ বিষয়ে মতভেদের অবকাশ নেই, কিন্তু এর গঠন ও আঙ্গিক সম্বন্ধে যে দু’একটি অভিযোগ শোনা যায় সেগুলি একেবারে অবাস্তব নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস । এইসব বিষয়ে কয়েকটি ত্রুটি আমাদের চোখে পড়ে। কবিতাটির উৎকর্ষ সম্বন্ধে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হয়েও সেগুলি উল্লেখ করা অসমীচিন হবে না।
প্রথমত এর গঠন-কৌশল। কবি যখন এই কবিতা রচনা করেন তখন যে উচ্ছ্বাস এবং ভাবাবেগ তাঁকে মথিত করে সে উচ্ছ্বাসের ফলেই কবি তাঁর এই কবিতাটিকে সুনিয়ন্ত্রিত করে তুলতে পারেননি। কবি এই কবিতায় বহুস্থলেই তাঁর ধ্বংসাত্মক শক্তি, সৃষ্টি-শক্তি, ধ্যানগাম্ভীর্য, ঔদাস্য, খেয়ালিপনা প্রভৃতি দিকের পরিচয় দিয়েছেন। কিছুটা সংযত এবং সংহত মন নিয়ে সেগুলি উপস্থাপিত করলে বিভিন্ন স্তবকে এগুলি নিয়ন্ত্রিতভাবে উপস্থাপিত করা যেত, অর্থাৎ কবি নিজের শক্তির বিভিন্ন দিক দেখাবার জন্য এক একটি স্তবক বেছে নিতে পারতেন—একটি প্রসঙ্গ শেষ হ’লে অন্য স্তবকে ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে পারতেন। কিন্তু সেদিকে কবি সতর্ক ছিলেন না, ফলে একটি মূর্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেও অকস্মাৎভাবে এসে পড়েছে অশান্ত মূর্তি, অথবা যখন কবি নিজেকে সম্মিলিত রূপের আধার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তখনই এসে পড়েছে ভিন্ন প্রসঙ্গ-ফলে বক্তব্য কিছু অগোছালো হয়ে গিয়েছে। সেইভাবে কবিতাটি দেখতে গেলে বলা যায়, এর প্রথম স্তবকে আছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার বলিষ্ঠ ঘোষণা, এখানে অসঙ্গতি কিছু নেই। দ্বিতীয় স্তবকে কবি তাঁর ধ্বংসাত্মক পরিচয়ই সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরেছেন—কাজেই স্তবকটিও সংগত। তৃতীয় স্তবকে কবি খেয়ালিপনার পরিচয় গ্রথিত করতে চেয়েছেন এবং প্রথম এগারোটি পঙক্তিতে কবি নিজের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন। কিন্তু তারপরই অকস্মাৎ কবি নিজের ধ্বংসাত্মক রূপটি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
চতুর্থ স্তবকটি মাত্রাজ্ঞানের পরিপূর্ণ নিদর্শন। এখানে কবি যে শুভ এবং অশুভ শক্তি দুটিরই প্রকাশ সে সম্পর্কে তাঁর মনোভাব সুষ্ঠু এবং একনিষ্ঠভাবে ব্যক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু পঞ্চম স্তবকে কবির প্রকাশরীতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। কবি শুরু করেছিলেন এইভাবে—
“আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,”
কিন্তু মধ্য পর্বে তিন ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠে বলেছেন—
“আমি দাবানল দাহ, দহন করিব বিশ্ব।”
অথচ এই স্তবকের শেষের দিকে কবি তাঁর খেয়ালিপনায় ফিরে গিয়েছেন—
“আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-উর্মির হিন্দোল দোল্।”
ষষ্ঠ স্তবকটিতে সমালোচকদের যে অভিযোগ তা বিষয়-সংক্রান্ত গঠনের ব্যাপারে এটির কোনো ত্রুটি আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু সপ্তম স্তবকে কবির বক্তব্যে আবার কিছু অসংগতি দেখা দিয়েছে। এই স্তবকে তিনি প্রধানত নিজের শান্ত ও অশান্ত মূর্তির যুগল সম্মিলন দেখাতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষের দুটি পঙ্ক্তিতে কবির সব সংযম যেন ভেসে গিয়েছে।
অষ্টম স্তবকে কবির অশান্ত চিত্তবৃত্তি এবং বিজয়োল্লাসই প্রধানত স্থান পেয়েছে। কিন্তু শেষাংশে কবির বক্তব্য কিছুটা ভিন্ন হয়ে পড়েছে, সেখানে কচি ‘শ্যামের হাতের বাঁশরী’ হতে চেয়েছেন।
পরবর্তী স্তবকগুলিতে কবি তাঁর বিদ্রোহ এবং ধ্বংসলীলার প্রকৃত তাৎপর্য পাঠক মনে সংক্রামিত করতে চেয়েছেন। এখানে তিনি সংযত নন কিন্তু প্রসঙ্গ সম্বন্ধে সচেতন। ফলে গঠন-কৌশলের বিচারে এগুলিতে বিশেষ কোনো ত্রুটি আমাদের চোখে পড়ে না।
আঙ্গিক-সংক্রান্ত বিচারের দ্বিতীয় কথা কবির ছন্দ-সৃষ্টি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দ-নির্মাণ এবং বিষয়বস্তুর মতোই উচ্ছ্বসিত। দীর্ঘপক্তি এবং হ্রস্বপক্তি সাজিয়ে কবি তাঁর অশান্ত মনোবৃত্তি এই জাতীয় ধ্বনিপ্রধান ছন্দে ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে কবির ছন্দ-নির্মাণ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, যথা—
“আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,”
অথবা—
“আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম্ ভরপুর-মদ।”
অতঃপর কবির শব্দপ্রয়োগ। শব্দপ্রয়োগে কবি আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তৎসম এবং তদ্ভব শব্দের সঙ্গ আরবি, ফারসি শব্দ তিনি অক্লেশে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণ—
“তাজি বোর্রাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মৎ-হ্রেয়া হেঁকে চলে।”
কবি যখন দুর্দান্ত তখন শব্দ প্রয়োগ সেই দুর্দস্ত ভাব কবি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন—
“আমি বসুধা বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,”
আবার যখন কবি রোমান্টিক তখন তাঁর শব্দগুলিও আশ্চর্যভাবে তাঁর সেই মানসিকতার অনুগামী—
“চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর।”
কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত তাঁর উচ্ছ্বাসের জন্যই কিছু অসতর্ক শব্দ প্রয়োগ করে ফেলেছেন। যেমন, ষষ্ঠ স্তবকে পাওয়া যায়—
“আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।”
এখানে ‘ধন্যি’ শব্দটি একেবারেই অনুপযুক্ত। এই স্তবকেই আর একটি পক্তি আছে—
“আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
বুকে গতি ফের।”
এখানে ‘গতি ফের’ শব্দ দুটিও সুপ্রযুক্ত নয়। এছাড়া কবি কয়েকটি শব্দ বার বার ব্যবহার করেছেন, যেমন—তৃতীয় স্তবকে কবি প্রথমেই লিখেছেন—
“আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি”
এই স্তবকের শেষের দিকে আবার পাই—
“আমি উন্মাদ, আমি বক্তা।”
‘উন্মাদ’ শব্দটি কবি বার বার ব্যবহার করেছেন, কখনো প্রায় একই বাক্যে ব্যবহারের দৃষ্টান্তও আছে। সপ্তম স্তবকে পাই—
“আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।”
দশম স্তবকে আবার পাই—
“আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ !!—
তবে, এইসব প্রক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত থেকে কবিতার সঠিক মূল্য নিশ্চয়ই কমে না। ‘বিদ্রোহী একটি প্রথম শ্রেণির কবিতা হয়েও আঙ্গিকের বিচারে ত্রুটিমুক্ত নয়, কেবল এইটুকু মাত্র বলা চলে।
Leave a comment