‘বিদ্যায়তনিক চলাচল’ বা Academic Mobility বলতে বোঝায় এক ধরনের পরিকাঠামো। যে পরিকাঠামোর দেশীয় ভাষা বর্তমান। এই দেশীয় ভাষার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিশেষ ভালোভাবে চলছিল। কিন্তু লেখক এখানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদেশি ভাষায় সমস্যাকে উপস্থাপিত করেছেন। বলা বাহুল্য বিরুদ্ধবাদীরা বলেছেন এই যে, ইংরাজি ভাষা থাকার ফলে এই Academic Mobility অর্থাৎ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দান প্রতিদান সহজ হয়ে উঠবে। অনেকেই মনে করেন যে পরাধীনতার দাসত্ব শৃঙ্খল ঘুচে গেলেও ইংরাজি ভাষার স্বর্ণ-শৃঙ্খল এখনও হিতকারী বস্তু, কারণ সংহতির সূত্রটি এখানেই নিহীত। লেখক মনে করেন “এই সব লোক এখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শেই বিশ্বাসী,” এইসব জ্ঞানাবলম্বীরা ঐতিহ্যপন্থী। তাঁরা পাঠ্য বিষয়ে ক্লাসিক পাঠগ্রহণের পক্ষে। এদের মতে, পুরানো আদর্শের স্থান নিতে পারে বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে এমন কিছুই নেই। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে সংস্কৃতি ও উদ্দেশ্যমুখীন জীবন গড়ে তোলা সম্ভব শুধু প্রাচীন দর্শনের ভিত্তিতে। এই দর্শন হল অহিংসা দর্শন।
অনেকেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার মতের পরিপন্থী ধারণায় বিশ্বাস করেন। বিরুদ্ধবাদীদের মতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহন হিসাবে ইংরাজিকে ব্যবহার কোনো মতেই শিক্ষা স্বার্থের অনুকূল নয়। কারণ নানা দেশের নানা প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ যোগসূত্র অক্ষুণ্ণ থাকে না। শিক্ষার academic mobility নষ্ট হয়। এঁরা বলেন, উগ্র প্রাদেশিকতার প্রতিশেধক চিন্তা হিসাবে এই মত গ্রহণযোগ্য। এছাড়াও বিচিত্র ভাবাদর্শের অবাধ লেনদেন হতে পারে। এঁদের মধ্যে অনেকে সাহসে ভর করে বললেন যে ইংরেজের দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি নিয়ে ও তার শেষ স্বর্ণসূত্র ইংরেজি ভাষার ইতিবাচক গুরুত্ব যথেষ্ট। এইসব মতাবলম্বীরা ইংরাজি ভাষার অপরিহীনতার কথাতো অকপটে বলে চলে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষার ধারণার পরিপন্থী কথা বলেন। চিন্তাশীল বিজ্ঞানী এই মত পর্যালোচনা করে এই মতের অসারতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন—“এই সব লোক এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শে বিশ্বাসী।” কারণ এই সব মতাবলম্বীরা মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃষ্ঠপট হিসাবে ক্লাসিক্স চর্চা বিশেষ প্রয়োজনীয়। বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্বকে একটা সীমার বাইরে ঠেসে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। কালই পারলৌকিকতার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে।
এ জ্ঞানের সঙ্গে পার্থিব জ্ঞানের সামজ্ঞস্য এনেছেন। অর্থাৎ সমকালীন সময়ে কীভাবে শিক্ষার দিকে এগোতে হবে এবং ভারতীয়দের মধ্যে কী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটাতে হবে। তা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন নিজের অভিমত। লেখক বলেছেন—‘বহু শতাব্দীর শিক্ষা থেকে আধুনিক কালের ভারতীয়কে ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব না দেওয়ার পাঠ করা উচিত। হয়তো জীবনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখাই ভালো। ব্যক্তিগত সুখ দুঃখকেই দর্শনের প্রধান বিষয় করা ঠিক নয়। বরং সাধারণ ঐতিহ্যের ঘনিষ্ঠ সূত্রে গ্রোথিত দেশ বিদেশের মানুষকে মনে করা যেতে পারে যেন এক ‘রিলেদৌড়ের প্রতিযোগী’। যেখানে ব্যক্তিগত দৌড়বাজের ভাগ্যের চাইতে দেশের উন্নতি, জাতীয় পতাকার অগ্রগতি ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
আসলে প্রাবন্ধিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু চায় এক সুন্দর কল্যাণমুখী আধুনিক ভারত। যে ভারতে প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা-চেতনার মাধ্যমে আপন পরিশ্রমের দ্বারা ভারতের মানুষেরা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিজেরাই সচেষ্ট হয়ে দূরীকরণ করবে সমগ্র দেশ থেকে দারিদ্র্য ও রোগ ভোগ। প্রয়োজনে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মৃত্যুকে জয় করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে দেশের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হবে। প্রাবন্ধিকের কথাতেই যার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আমরা পেয়ে যাই।—পুরুষ পরস্পরা ধরে যদিও মানুষ পরিশ্রম করে যায় আর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের এবং দারিদ্র্য রোগ ও মৃত্যুর ওপরে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করতে করতেই তার জীবনাবসান হয়, তবু ওইসব প্রয়াস দেশের ও জগতের কতটা কল্যাণ করতে পেরেছে, এইটেই হচ্ছে আসল কথা।
তাঁর অভিপ্রেত যুক্তিগুলির বিরুদ্ধে বস্তুবাদী দার্শনিকদের মত নিয়ে আলোচনা করে প্রাবন্ধিক আমাদের সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন ভারতীয়দের মুক্তি কামনার জন্য বস্তুবাদী দার্শনিকেরা যে পারলৌকিক চর্চার পথ দেখিয়েছেন তাঁদের সে পথ রয়েছে জড়ত্ব, স্বার্থপরতা ও লোভের উৎস। কেননা মোক্ষলাভের জন্যই ব্যক্তি মানুষকে একাকী লোকালয় ত্যাগ করে আশ্রয় নিতে হয় স্বার্থপরের মতন গুহার ভিতরে। আর যারা কোনো মোক্ষ লাভের চেষ্টাই করেন না তাদের করুণ অবস্থার কথাও প্রাবন্ধিক তুলে ধরেন আমাদের কাছে এই বলে—’যারা পেছনে পড়ে থাকে সংসারের অশুভ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সমাজ ও দেশের বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্যে চেষ্টা করে তাদের ছেড়ে দেয় শয়তানের কবলে। অর্থাৎ সংসারের অশুভ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে সমাজের ও দেশের সমৃদ্ধির ধারক ও বাহক হয়েও সমষ্টিগত ঐক্য ও দৃঢ় মানসিকতার অভাবের জন্য শেষমেষ তারা শয়তানদের কাছে পরাভূত হয়।
প্রাবন্ধিক বিদেশি হানাদারদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত ও ভারতের মানুষদের পরাধীনতার প্রধান কারণ হিসাবে আমাদের জাতীয় ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তিনি জানান, আমাদের দেশে প্রথম সারির চিন্তাবিদরা যখন মুক্তি কামনারূপ দর্শনকে গুরুত্ব দেবার ফলে দ্বিতীয় শ্রেণির খুদে মানুষেরা প্রাধান্য পায়—যারা মুখে আনুগত্য প্রকাশ করত দর্শনের প্রতি, কিন্তু হিংসা ঝগড়াঝাটি ও আভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসংবাদে মেতে থাকত, ফলে পরিণাম হল ভয়ংকর। মানব সমাজে প্রথম সারির মানুষদের মুক্তি কামনারূপ দর্শনের প্রতি আনুগত্য ও পলায়ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপরদিকে দ্বিতীয় সারির মানুষদের দ্বিচারিতার জন্য বিদেশি শত্রুদের উপদ্রব ঠেকানো গেল না। হানাদারদের লুণ্ঠন ও অত্যাচার রদ তো হলোই না, উলটে দেশের মানুষকে দাসত্ব গ্রহণ করতে হল। প্রাবন্ধিকের ভাষায়—“শতাব্দীর পর শতাব্দী জোড়া দাসত্ব।
তবে দাসত্ব মোচনের জন্য মানুষের যে মুক্তি ইচ্ছা জেগেছে তা স্বাগত জানিয়েছেন প্রাবন্ধিক। এখানে একটা কথা বোধ করি ভালো হবে, ‘দাসত্ব’ বলতে তিনি ইংরেজ শাসনের কথাই এখানে বলতে চেয়েছেন। দাসত্বশৃঙ্খল মোচনের উদ্ধারের পথও বাতলে দিয়েছেন তিনি। তাঁর অভিমত হল, পারলৌকিকতার সঙ্গে পার্থিব দায়িত্ব পালনে একটা সুসংগতি গড়ে তোলা। এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের নীতি ও আদর্শের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কারণ তিনি দুর্গত মানুষের সেবাকে মোক্ষের ওপর স্থান দিয়েছেন। আর এর জন্যই জাপানি শিক্ষার প্রতি তিনি বিশেষ নজর দিয়েছেন এবং ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থার মতো করতে চেয়েছেন। এর ফলে ভারত মহান হবে। আর এর জন্য পারলৌকিক জ্ঞানচর্চার সঙ্গে পার্থিব জ্ঞানের সামঞ্জস্য আনা হয়েছে।
এঁরা বিশ্বাস করেন, কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare State) প্রতিষ্ঠার ওপর হাতিয়ার হিসাবে ক্লাসিক বা প্রাচীন দর্শনের উপযোগীতা বিরাট। এই যুক্তি ধারার বিরুদ্ধে লেখক প্রাচীন দর্শনের পর্যালোচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক দেশে ইতিহাসের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে বহু মতামত প্রচলিত আছে। এইমত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিভিন্ন ভাবুকের মধ্যে আছে। “কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার অবনতির কারণ সম্বন্ধে একাধিক ব্যাখ্যার অবকাশ আছে।” লেখক এই প্রসঙ্গে নালন্দা ও তক্ষশীলার শিক্ষা ব্যবস্থার পারলৌকিকতা সম্পর্কে যে পোষকতা করা হত, তার উল্লেখ করেছেন। তার মতে, পারলৌকিকতা ও ব্যক্তি-মুক্তির আদর্শ মানুষকে ইহ বিমুখ করে তোলে। তার মতে অধিকাংশ মানুষ এই ভারতীয় ভাবাদর্শের দ্বারা লালিত হয়ে দেশের ও দশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে না। এ দেশের একদল দার্শনিক এই ধরনের মনন, ভাবা দর্শের উৎকর্ষ সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ফলে নিজেদের সংগ্রামী শক্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে ও দেশ বিদেশি হানাদারদের ক্ষেত্রভুক্ত হয়ে চলেছে। আচার্য বসুর মতে, এই ধরনের চিন্তা জীবনের গুরুত্ব বোঝাতে সাহায্য করে না। পারলৌকিকতার সঙ্গে পার্থিব দায়িত্ব বোধ শিক্ষার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত।
মাতৃভাষা যে শিক্ষার বাহন হওয়া প্রয়োজন জাপান গিয়ে লেখক এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেখানে বিষয়ক আলোচনা চক্রে যোগ দিয়ে লেখক দেখেন যে দোকানির মাধ্যমে বিজ্ঞানের কত জটিল আলোচনা সুসম্পন্ন হয়েছে। সব বিদেশি বৈজ্ঞানিক তাদের নিজ নিজ ভাষায় বিজ্ঞানের জটিল ও বিমূর্ত ভাবনা পৌঁছে দিত দোভাষীরা। জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় আধুনিকতম দিক পড়ানো হচ্ছে জাপানি ভাষায়, জাপানি ছাত্ররা বহু দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন জাপানি ভাষায়। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে দুজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইংরেজিতে লেখা বইয়ের তর্জমা হয়েছে জাপানি ভাষায়। বইটি বিক্রি হয়েছে ভালোই, সকলেই গ্রহণ করেছেন কিন্তু আমাদের দেশে ওই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ইংরেজিতে লিখে চলেছেন ও তার ফলে তাঁদের দেশবাসীর অধিকাংশ পারমাণবিক ভস্মপাত সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেছেন। অনেকে মনে করেন পরিভাষার অভাব বিজ্ঞানচর্চায় বাধা স্বরূপ হয়েছে। কিন্তু লেখক মনে করেন বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বহু শব্দ যাকে বলা চলে ধার করা শব্দ তাকে কাজে লাগানো যাবে। এদেশে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার খুবই প্রয়োজন যেখানে বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব চর্চার ওপর জোড় থাকবে এবং যেটি চালানো হবে ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে।
লেখকের ধারণা এই রকম একটি ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হলে উগ্র প্রাদেশীকতার প্রতিশেধক হিসাবে কাজ করতে পারে। এর ফলে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সার্থকতা সফল হবে।
Leave a comment