জয়দেব গোস্বামী সংস্কৃত ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের সূত্রপাত করেছিলেন, আর ‘অভিনব-জয়দেব’ বিদ্যাপতি ঠাকুর ব্রজবুলি ভাষায় সেই পদাবলী সাহিত্যকে পরিপূর্ণ করে তোলেন। বিগত শতাব্দীতে বাঙালি মনীষীদের অনেকের ধারণা ছিল যে বিদ্যাপতি বাঙালি কবি এবং তিনি যে ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছিলেন, তা রাধা-কৃষ্ণের লীলাভূমি ব্রজেরই ভাষা, অতএব তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘ব্রজবুলি’। পরবর্তীকালে উভয় ভ্রান্ত ধারণারই অবসান ঘটে এবং প্রমাণিত হয় যে, বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার কবি এবং তিনি যে ব্রজবুলি ভাষায় কাব্য রচনা করেছিলেন সেই ভাষা ব্রজের তো নয়ই, এমনকি বিদ্যাপতির জন্মভূমি মিথিলার ভাষাও নয়, ব্রজবুলি এক কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা, যার সঙ্গে বেশ কিছু মৈথিল শব্দ এবং কিয়ৎ পরিমাণ বাংলা শব্দও মিশ্রিত হয়ে আছে এবং এর উদ্ভব ঘটেছে অবহট্ট ভাষার বিকারে।
খ্রিঃ চতুর্দশ শতকের কোনো এক সময় জন্মগ্রহণ করে পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিদ্যাপতি বর্তমান ছিলেন, এরূপ অনুমানের সপক্ষে অনেক প্রমাণ রয়েছে। বিদ্যাপতি যে অন্তত পাঁচজন মিথিলাপতির রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন, তা তার রচনা থেকেই অনুমান করা হয়। বিদ্যাপতি মিথিলার এক পণ্ডিত বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
বাংলা দেশে বিদ্যাপতি একজন প্রখ্যাত বৈষ্ণব কবিরূপে পরিচিত হলেও স্বদেশে তার পরিচয় প্রধানত একজন প্রখ্যাত বহুশাস্ত্রাভিজ্ঞ পণ্ডিতরূপেই। বস্তুত বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যাপতি এত গ্রন্থ রচনা করেছেন যে, সেকালের পক্ষে তা বিস্ময়কর বলেই মনে হয়। তার রচিত ‘বিভাগসার ও ‘দানবাক্যাবলী’ স্মৃতিশাস্ত্র সম্বন্ধীয় এক বিচার-গ্রন্থ, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, বাড়ীভক্তি-তরঙ্গিণী, গঙ্গাবাক্যাবলী ও বর্ষক্রিয়ায় বিভিন্ন পূজাপদ্ধতি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। ‘ভূ-পরিক্রমা’ নামক গ্রন্থে তীর্থ-কাহিনীচ্ছলে বিদ্যাপতি আপনার ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পুরুষ পরীক্ষা’ নামক গ্রন্থে কথাসাহিত্যের গুণাবলী বর্তমান। এ সমস্ত গ্রন্থে তিনি সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার দিন গত, জনসাধারণের মনের দরজায় পৌঁছুতে হলে দেশীয় ভাষার শরণ গ্রহণ করতে হবে। তাঁর ভাষায় –
‘সক্কয় বাণী বহুজন ভাবই।
পাউঅ রসক মম্ম ন পাবই।।
সেসিল বঅনা সবসন মিঠা।
তেঁ তইসন জম্পঞো অবহট্ঠা।।’
অর্থাৎ ‘বুধজন সংস্কৃত বাণীতে ভাবনা করেন, (তাহারা) প্রাকৃত রসের মর্ম পান না। দেশীয় বচন সর্বাপেক্ষা মধুর, তাই ঐরূপ অবহট্ট ভাষায় লিখিতেছি।”
বস্তুত তিনি ‘কীর্তিলতা’ ও ‘কীর্তিপতাকা’ নামক ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ এই অবহট্ট ভাষাতেই রচনা করেছিলেন। মাতৃভাষা মৈথিলীতেও তিনি হরগৌরী এবং রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কয়েকটি পদ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। সর্বোপরি ব্রজবুলি ভাষায় তিনি যে অমৃতমধুর বৈষ্ণবপদ রচনা করেছেন, তা’ সুদীর্ঘকাল বাঙালির রসপিপাসা নিবারণে নিযুক্ত রয়েছে। বিভিন্ন ভাষা এবং বিষয়ে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, “যে গানে তাহার খ্যাতি, যে গানে তাহার প্রতিপত্তি, যে গানে তিনি জগৎ মুগ্ধ করিয়াছেন তিনি যদি তাহার একটি গানও না লিখিতেন, কেবল পণ্ডিতের মতো স্মৃতি, পুরাণ, তীর্থ ও গেজিটিয়ার প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ লিখিয়াই ক্ষাস্ত থাকিতেন, তাহা হইলেও বলিতে হইত, তাহার প্রতিভা উজ্জ্বল ও সর্বতোমুখী।”
বিদ্যাপতি সমস্যা: বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষার উল্লেখযোগ্য প্রথম কবি বলেই হোক্ অথবা তার অসাধারণ খ্যাতির জন্যই হোক্ ব্রজবুলির পদ মাত্রই বিদ্যাপতির, এরূপ একটা মনোভাব বা সংস্কার অনেকের মধ্যেই ছিল। তাই কাব্যবিশারদের সংস্করণে বিদ্যাপতির পদের সংখ্যা দুই শতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও নগেন্দ্রনাথের সংস্করণে সেই সংখ্যা প্রায় সহস্রে উন্নীত হয়। এই সমস্ত পদের অনেকগুলোই যে কোনো-না-কোনো বাঙালি কবির রচনা তা পরবর্তী কালে প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত কয়েকটি প্রসিদ্ধ পদের কথা উল্লেখ করা চলে। সপ্তদশ শতকের শেষে রচিত ‘অষ্টরস ব্যাখ্যা’য় এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’ কবিতাটি শেখরের (কবিশেখরের) ভণিতায় পাওয়া যায় অথচ পদটি বিদ্যাপতির নামেই চলছে। ‘রসকদম্ব’ প্রণেতা কবিবল্লভ-রচিত ‘কী পুছসি অনুভব মোয়’ কবিতাটিও বিদ্যাপতির নামেই প্রচারিত হয়ে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে নয়ন কোনো অনুসরই’ নামক প্রসিদ্ধ পদটির রচয়িতাও বিদ্যাপতি নহেন, বিদ্যাবল্লভ নামক কোনো কবি। বাংলা দেশেও বিদ্যাপতি-উপাধিধারী একজন কবি পরবর্তীকালে ব্রজবুলি ভাষায় অনেক পদ রচনা করেন—ইনি শ্রীখণ্ডের ‘কবিরঞ্জন’ বা ‘ছোটো বিদ্যাপতি’ বলে পরিচিত। এঁর রচিত অনেক পদও বিদ্যাপতির নামে চলে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত আদি বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে ছোটো বিদ্যাপতির পদ এমনভাবে মিশে আছে যে, হয়তো এদের পৃথক্করণ আর সম্ভব নয়। সংগ্রহকর্তা এবং কীর্তনীয়াদের কল্যাণে বিভিন্ন কবিদের ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদও বিদ্যাপতির নামে চলছে। আবার কোনো কোনো কবি আপনার রচনাকে অমর করে রাখবার আকাঙ্ক্ষায়ও ভণিতায় বিদ্যাপতির নাম যোগ করে থাকতে পারেন। এই সমস্ত কারণে বিদ্যাপতির নিজস্ব রচনা বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া কষ্টকর ফলত বিদ্যাপতিও বাংলা সাহিত্যে এক সমস্যা হয়ে আছেন।
প্রতিভা পরিচয় : মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদের রসাস্বাদন করতেন, বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার এ এক অখণ্ডনীয় প্রমাণ। সংস্কৃত ভাষায় হলেও বাঙালি কবি জয়দেবই সর্বপ্রথম রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক পদ প্রথম রচনা করেছিলেন, কিন্তু তার পদ কাওকোমল হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় উত্তরকালে বিদ্যাপতিই অধিকতর অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। জয়দেব ও বিদ্যাপতি উভয়ের রচনায় কয়েকটি সাধারণ ধর্ম বর্তমান দু’জনেই দেহবিলাস এবং সম্ভোগ বর্ণনার কবিরূপেই প্রসিদ্ধ। সম্ভবত উভয়েই রাজসভার কবি ছিলেন বলেই তাদের রচনায় আধ্যাত্মিকতা আরোপ করতে হয়, আসলে তা’ দেহাসক্তিই বটে। জয়দেব নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব হলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অভ্যুদয়ের পুর্বেই তার আবির্ভাব হওয়াতে তিনি শুধুই মধুর রসের উপাসক ছিলেন না, ঐশ্বর্য রসও তাঁর কাব্য বস্তু ছিল। আর বিদ্যাপতি তো নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবই ছিলেন না, কাজেই তার রচনায় দেহ-ভাবনার উপস্থিতি একাস্ত স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই অনুমান করা যেতে পারে। হয়তো তারা উভয়েই পূর্বসুরীদের অনুসরণে সাধারণ প্রেমের কবিতা রূপেই রাধাকৃষ্ণ কাহিনীকে উপজীব্য করে থাকতে পারেন। তবে এ কথাও সত্য যে, আসলে সৌন্দর্যপ্রীতির জন্যই তারা দেহবর্ণনার উপর এত গুরুত্ব দান করেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার রূপাসক্তি, ভোগাসক্তিকে অতিক্রম করে গেছে। বড়ু চণ্ডীদাসের রচনার সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যাবে যে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর তুলনায় বিদ্যাপতি জয়দেবের রচনা কত মার্জিত, অগ্রাম্য ও শ্লীলতাপূর্ণ। বস্তুত সস্তোগ বর্ণনাও তাঁদের রচনায় এক কল্পজগতের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে একটা পরিপূর্ণতা দানের চেষ্টা করেছিলেন। প্রেমোন্মেষ থেকে প্রেমের চরম পরিণতি পর্যন্ত স্তরে স্তরে লীলা বৈচিত্র্যের বিভিন্ন পর্যায় রচনায় তিনি অনুপম কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্যাপতি বর্ণিত প্রেম অতি জটিল ও মনস্তত্ত্বসম্মত। তিনি প্রেমকে কেবল একটি জৈবিক বৃত্তি বলে মনে করেননি, তাই তার অঙ্কিত প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লজ্জা, ভয়, ঈর্ষা, ছলনা, উদ্বেগ, হর্ষআদি বিভিন্ন মানসিক বৃত্তি। বিদ্যাপতি বর্ণিত রাধাপ্রেমকে বিশ্লেষণ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ – “বিদ্যাপতির রাধা অল্পে অল্পে মুকুলিত বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢলঢল করিতেছে। শ্যামের সহিত দেখা হয় এবং চারিদিকে যৌবনের কম্পন হিল্লোলিত হইয়া উঠে। খানিকটা হাসি, খানিকটা ছলনা, খানিকটা আড়চক্ষে দৃষ্টি।… আপনাকে আধখানা প্রকাশ এবং আধখানা গোপন কেবল উদ্দাম বাতাসের একটা আন্দোলনে অমনি খানিকটা উন্মেষিত হইয়া পড়ে।” বিদ্যাপতি এইভাবে তুলিকায় বিচিত্র বর্ণাধার থেকে এক একবার রং নিয়ে একটু ছোঁয়াচ্ছেন, দেখছেন, আবার ছোঁয়াচ্ছেন এবং এইভাবেই পূর্ণতা দান করেছেন। এইজন্যই “ছন্দ, সঙ্গীত এবং বিচিত্র রঙে বিদ্যাপতির পদ এমন পরিপূর্ণ, এইজন্য তাহাতে সৌন্দর্য-সুখ সম্ভোগের এমন তরঙ্গলীলা।”
বিদ্যাপতি প্রধানত সম্ভোগরসের কবি, তার কাব্যে প্রেমে-রসে জীবস্তরূপ ধরা পড়েছে তা’ ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে সর্বজনীন অনুভূতিলোকে উন্নীত হবার দাবি রাখে বলেই বিদ্যাপতির প্রেম একান্তভাবে বৈষ্ণবীয় না হওয়া সত্ত্বেও বৈষ্ণবজনের প্রাণের বস্তু। বিদ্যাপতি রাধিকার বিচিত্র অনুভূতির কথা প্রকাশ করলেও বিরহ-বেদনা এবং ভাবোল্লাসের বর্ণনায় তিনি যেন আপনাকেও অতিক্রম করেছেন। গীতিকাব্যের প্রাণরূপে পরিচিত ভাবাবেশ এখানেই সর্বাধিক গভীর। বিদ্যাপতির কাব্যে এই ভাবসমাবেশের জন্যই মহাপ্রভু অকৃপণভাবে তা থেকে রস-উপলব্ধির সুযোগ পেয়েছিলেন। পরিশেষে আর একটি কথা না বললে বিদ্যাপতির প্রতি অবিচার করা হবে। প্রধানত রস-সম্ভোগের কবি বলে পরিচিত হলেও বিদ্যাপতি যে শান্তরসাশ্রিত প্রার্থনা পদাবলী রচনা করেছিলেন, সাহিত্যকীর্তি হিসেবে এবং সাধক ভাবুকচিত্তে অপার্থিব রসের উদ্বোধনে এদের স্থানও অতি উচ্চে। বিদ্যাপতির রচনার সর্বত্র ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটলেও অন্তত প্রার্থনার কবিতাগুলিতে যে আত্মদৈন্য, আত্মনিবেদন এবং ঈশ্বরভক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তা একমাত্র চণ্ডীদাসের সঙ্গেই তুলনীয়। রূপের আরাধনা করতে করতে এক সময় বিদ্যাপতি অরূপের সন্ধান লাভ করলেন, রূপরসিক কবি সাধক চূড়ামণি পদে উন্নতি হলেন।
বিদ্যাপতির অপর একটি কৃতিত্বের কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন পর্যায়ে রস সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু কিছু বাক্য রচনা করেছেন, সেগুলি প্রবচন বা প্রৌঢ়োক্তির মর্যাদা লাভ করতে পারে।
বিভিন্ন রসপর্যায়ে কৃতিত্ব: বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায় অবলম্বন করেই পদ রচনা করেছেন। বিশ্লেষণে এই বৈচিত্র্যের মধ্যেও দুটি স্তরের সন্ধান পাওয়া যায় প্রথম স্তরে মনে হয়, সৌন্দর্য-সাধনাই কবির ঈপ্সিত। এই স্তরে পড়েছে বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ ও অভিসার পর্যায়ের পদ। বয়ঃসন্ধি এবং পূর্বরাগের রাধা বাস্তব, কিন্তু অভিসারে যেন বাস্তবাতীতের ছায়াপাত ঘটেছে। পরবর্তী স্তরে—বিরহে এবং ভাবোল্লাসের পদে বিদ্যাপতি যেন স্বধর্মকে অতিক্রম করে একটা মানসলোকে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বয়ঃসন্ধি: বিদ্যাপতির সৌন্দর্যরসঙ্গতার পরিচয় পাওয়া যায় বয়ঃসন্ধির পদে। বয়ঃসন্ধির পদ রচনায় বিদ্যাপতি মৌলিক কবিদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। বয়ঃসন্ধি রূপাত্তরের সন্ধিকাল – একদিকে উল্লাস, অন্যদিকে বেদনা, হাসিকান্নার যুগপৎ উপস্থিতি একালের পদে। কৈশোর থেকে যৌবনের উন্মেষে দেহে যেমন পরিবর্তন দেখা দেয়। তেমনি পরিবর্তন দেখা দেয় মনেও। দেহ মনের এই দ্বন্দ্ব বিদ্যাপতি চমৎকার ফুটিয়েছেন –
‘শৈশব যৌবন দরশন ভেল।
দুহু দলবলে দ্বন্দ্ব পড়ি গেল।
কবহু বাঁধয় কচ কবহু বিথারি।
কবহু ঝপয় অঙ্গ কবহু উঘারি।।’
কী করবেন তা স্থির করে উঠতে পারছেন না শ্রীমতী ঃ
‘খিনে খনে নয়ন কোনো অনুস ঈ।
খনে খনে বসনধূলি তনু ভরঈ।।
হিরদয় মুকুল হেরি হেরি থোর।
খনে আঁচর দএ খনে হোয় ভোর।।’
এর পরই যৌবন উপস্থিত হল। দেহচাঞ্চল্য যেন খানিকটা নিবৃত্ত হয়েছে, এবার চাঞ্চল্য জাগলো মনে –
‘শুনইতে রসকথা থাপয় চিত।
জইসে কুরঙ্গিণী শুনয়ে সঙ্গীত।।’
বয়ঃসন্ধির পদগুলোতে বিদ্যাপতি তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং অসাধারণ মনোধর্মিতার পরিচয় দিয়েছেন। কী গভীর অভিজ্ঞতা ও অস্তদৃষ্টির পরিচয় ফুটে উঠেছে বিদ্যাপতির নিম্নোক্ত পদটিতে –
‘কেলিক রভস যব শুনে আনে।
অনতএ হেরি ততহি কএ কানে।
ইথে যদি কেও করএ পরচারী।
কাদন মাখী হাসি দত্র গারী।।’
পূর্বরাগ: পূর্বরাগের পদে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস বা জ্ঞানদাসের তুল্য কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেননি। সাধারণত পূর্বরাগ বলতে শ্রীরাধার পূর্বরাগই বুঝিয়ে থাকে; কিন্তু বিদ্যাপতি পূর্বরাগেও যা কিছু কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা’ শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগে। শ্রীরাধার রূপে শ্রীকৃষ্ণের মুগ্ধতাই বিদ্যাপতির পদকে রসসিক্ত করে তুলেছে এ তো পূর্বরাগ নয়, যেন শ্রীকৃষ্ণে রূপানুরাগ শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে স্বয়ং বিদ্যাপতিই যেন আরাধ্য সৌন্দর্য প্রতিমার বন্দনাগান করেছেন –
‘অপরূপ পেখল রামা।
কনকলতা অবলম্বনে উয়ল
হরিণীহীন হিম ধামা।।’
কৃষ্ণকে পেয়েও এবং প্রিয়তমের অনুরাগ দীপ্ত হয়েও রাধা মনে জিজ্ঞাসা –
‘পাখীক পাথ মীনক পানি।
জীবক জীবন হাম ঐছে জানি।।
তুহুঁ কৈছে মাধব কহ তুই মোয়।
বিদ্যাপতি কহ দুই দোঁহা হোয়।।’
বলাই বাহুল্য বিদ্যাপতির এই বর্ণনায় একদিকে যেমন উপমাদি অলঙ্কারের ছড়াছড়ি, তেমনি অসাধারণ সব চিত্রকল্পও উপস্থাপিত হয়েছে। অতএব শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগকেও যদি পূর্বরাগের পর্যায়ভুক্ত করা যায়, তবে পূর্বরাগের পদেও বিদ্যাপতির কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
অভিসার: অভিসার পর্যায় থেকেই বিদ্যাপতির রচনায় গতানুগতিক রীতির বাইরেও রস ও ভাবের ছোঁয়া লেগেছে। এর মধ্যে যেমন একটা মৌলিক দিক আছে তেমনি লোকোত্তরতার ইঙ্গিতও এই অভিসারের পদেই সহজলভ্য। অভিসার যাত্রার মধ্যে যে কৃচ্ছ্বতা সংযম আদির প্রয়োজন, তা’ ‘অনায়াসেই দেহ ধর্মকে অতিক্রম করে অধ্যাত্মলোকে প্রবেশের ছাড়পত্র পায়। তাই অভিসারের আরম্ভে –
‘বরিস পয়োধর ধরণী বারিভর
রঅনী মহাভয় ভীমা’—
সমাপ্তিতে দেখি –
‘তু অনুরাগ মধুর মদে মাতলি
কিছু ন গুণল বরনারী।।’
বস্তুত গোবিন্দদাস ব্যতীত অপর কোনো কবিই অভিসারের পদ রচনায় বিদ্যাপতির তুল্য কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেননি।
বিরহ: বিরহের পদে বিদ্যাপতি রাজাধিরাজ, তার কবিত্বশক্তি বিরহের পদেই যেন শ্রেষ্ঠত্বের সীমায় এসে পৌঁছেছে।
‘অঙ্কুর তপন-তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মোহে।’
বিদ্যাপতি এখানে বিরহ বর্ণনা করতে গিয়ে রাধিকার বয়ানে অলঙ্কৃত বাক্য ব্যবহার করেছেন সত্যই, কিন্তু তারও সার্থকতা রয়েছে। এই অলঙ্কৃত বাক্যই রাধিকার বিরহের গভীরতা প্রকাশের সহায়ক।
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভর বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।’
গভীরতম বেদনার বাণী এ-রকম ভাষা ছাড়া কি প্রকাশ করা যায়। সবশেষে রাধিকার সেই আর্ডি—কৈসে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া।’ অলঙ্কারবিহীন বাক্যেও বিদ্যাপতি গভীর আর্তি প্রকাশ করেছেন –
‘চির চন্দন উরে হার না দেলা।
সো অব নদী-গিরি আঁতর ভেলা।।’
প্রিয়তমের দেহে যাতে বিন্দুমাত্র আঁচড়ও না লাগে তার জন্য শ্রীমতী বুকে বস্ত্রখণ্ড রাখেননি, চন্দন অনুলেপন করেন নি, তৎসত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ চলে গেলেন গিরি-নদী পার হয়ে কোন্ সুদুরে। তাই বিরহ-বেদনা শোকের মতো শ্রীমতীর হৃদয় ভেদ করছে –
‘আন অনুরাগে পিয়া আন দেশে গেলা।
পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঝর ভেলা।।’
বিদ্যাপতি যে শুধু রূপ-রসেরই কবি ছিলেন না, কৃষ্ণৈকপ্রাণা রাধা যে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণময় হয়ে উঠেছিলেন, শেষ পর্যন্ত নদীও যে গিয়ে সাগরে পড়ল, তারও পরিচয় দিয়েছেন বিদ্যাপতি –
‘অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে
সুন্দরী ভেলী মধাঈ।’
রূপ ও রসের কবি বিদ্যাপতির বিরহ পর্যায়ের পদগুলি পাঠ করলে কিন্তু আমাদের মন রূপ আর রসে আবদ্ধ থাকতে চায় না। বিদ্যাপতি রাধাকে বিরহের আগুনে পুড়িয়ে তার দেহ-সৌন্দর্যের অতিরিক্ত একটা আত্মিক সৌন্দর্যে মণ্ডিত করে দিয়েছেন। -এখানে বিদ্যাপতি নিজেও যেন রূপরসময় পৃথিবীর ‘বাইরে একটা আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান পেয়েছেন।
ভাবোল্লাস: বিদ্যাপতি সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন ভাবোল্লাস ও প্রার্থনার পদগুলিতে। বিরহে তিনি রাজাধিরাজ হলে এখানে তিনি সম্রাট; বিদ্যাপতি দুঃখকে কখনও একান্ত সত্য বলে গ্রহণ করতে পারেননি, তাই বিরহের পর ভাবোল্লাসে তাঁর চিত্ত আবার নৃত্যপর হয়ে উঠেছে।
‘আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু
পেখলু পিয়া-মুখ চন্দা।’
প্রিয়মুখদর্শনে শ্রীমতীর মনে আর কোনো বেদনা নেই, এখন তিনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন—
‘সোহি কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করুচন্দা।
পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হউ
মলয় পবন বহু মন্দা।।’
কবিতাটিতে কবি তথা রাধিকার কি উল্লাস, আনন্দের কি অপূর্ব প্রসন্ন বিস্তার। ‘ভাব ও ভাষা, রস ও রূপের এমন পার্বতী পরমেশ্বর মিলন সত্যই বিরল।”
প্রার্থনা : প্রার্থনার পদগুলিতে বিদ্যাপতির সুগভীর আন্তরিকতা এবং সুতীব্র আকুতিতে তার ঈশ্বরানুভূতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চণ্ডীদাসের রাধার মতোই বিদ্যাপতি স্বয়ং এখানে আত্মসমর্পণ করেছেন— “দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিলু দয়া জনি ছোড়বি মোয়।
Leave a comment