গোবিন্দ দাস ছিলেন বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। শিল্প গুরু গোবিন্দ দাস দ্বিতীয় বিদ্যাপতি হিসাবে দিকে দিকে নন্দিত হয়েছিলেন, এই দুই কবির কাব্যে ভাবের এবং রূপের এক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

বিদ্যাপতির কবি-ব্যক্তিত্বের নেপথ্যে ছিল সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র, জয়দেবের মধুর কান্ত পদাবলীর ঐতিহ্য এবং রাজসভার বিলাস-কলা-সমুজ্জ্বল পরিবেশ। তাই মণ্ডন কলা নিপুণতা, অলংকার সুষমা প্রভৃতির মণিকাঞ্চন সংযোগে তাঁর কবিতা ঝলমল করে ওঠে তাঁর প্রকৃতি বন্দনা আমাদের হৃদয় বিমুগ্ধ করে।

কিন্তু গোবিন্দ দাসের কাব্য রচনার পটভূমি ছিল ভিন্নতর, চৈতন্যদেবকে তিনি দেখতে পাননি। কিন্তু চৈতন্য ঐতিহ্যের সঙ্গে সুপরিচিত হয়ে স্বয়ং চৈতন্যদেবকে নিজ কবি- প্রাণ চেতনায় একীভূত করে নিয়ে তিনি পদরচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণু কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পী প্রতিভূ। একটি যুগের সামগ্রিক সাধনা ও উপলব্ধির বাঙ্ময় প্রকাশ তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও এইখানেই তাঁর সঙ্গে আছে মৌলিক পার্থক্য। বিদ্যাপতির কাব্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ও উপলব্ধির মাধ্যমে কবি মানসের শৈল্পিক প্রকাশ, আর গোবিন্দ দাসের কাব্য যুগ সাধনার সামগ্রিক অভিব্যক্তি। তাঁর প্রাণচেতনার সঙ্গে চৈতন্য-ঐতিহ্য একাত্মরূপে প্রকাশিত।

কাব্যের গঠনরীতির দিক দিয়ে বিদ্যাপতির সঙ্গে “দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’র কাব্যের মিল বেশি নেই। বিদ্যাপতির কোন কোন পদে ছন্দ, অলংকার, ধ্বনি সব কিছু থাকা সত্ত্বেও কোথায় যেন একটা খুঁত রয়ে গেছে। তাঁর সঙ্গীত যেন কালাওয়াতের হাতের বিচিত্র তন্ত্রী সুর যন্ত্র—মুগ্ধ করে, আভিভূত করে, আবিষ্ট করে কিন্তু সমাহিত করে না। “শূনভেল মন্দির শূনভেল নগরী। শূনভেল দশ দিন শূনভেল সগরী।”—তাঁর এই পদ শূন্যতা বোধের এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি। কিন্তু এ শূন্যতা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি যত, তার চেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ করি চোখ দিয়ে। কিন্তু গোবিন্দ দাসের কাব্যে ঘটেছে নিটোল সুরের পরিপূর্ণতা। বিদ্যাপতির কাব্য অনেক সময় সেখানে বাক্য জালের জটিলতায় আচ্ছন্ন গোবিন্দ দাসের কাব্য সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর কাব্য দেহ লাবণ্য-শ্রী মণ্ডিত। বয়ঃসন্ধি, ভাব সম্মিলন ও প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতির একক প্রাধান্য। পূর্বরাগ, মান, এবং বিরহের পদেও তাঁর বাণী বন্দনা কীর্তি সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদে, অভিসার ও রূপানুরাগের পদে গোবিন্দ দাস ‘দ্বিতীয় রহিত।

গোবিন্দ দাস সৌন্দর্য্য রসিক, রূপদক্ষ শিল্পী, ব্রজবুলির ছন্দঝংকারে, সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র মন্থন করা শব্দে আর চিত্তচমৎকারী রূপ সুষমায় গড়ে উঠেছে তাঁর কাব্যের কায়া।

“নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন গন্ধ নন্দিত অঙ্গ

জলদ সুন্দর কন্ধু কন্নুর নিন্দি সিন্দুর ভঙ্গ।”

এরকম রূপ সুষমায়, শব্দ ও অর্থালংকারের এরকম স্বর্ণোজ্জ্বল দীপ্তি বিদ্যাপতির কাব্যেও লভ্য। কিন্তু গোবিন্দ দাসের প্রতিটি পদে প্রকাশ নিষ্ঠা ও বিশ্বাস জনিত প্রশান্তি আর ধীরতা যা অন্যান্য কবির পদে দুর্লভ।

“মম হৃদয় বৃন্দাবনে কানু ঘুমায়ল। 

প্রেম প্রহরী রহুঁ জাগি।” 

এই অতুলনীয় পদে কবি আপন হৃদয়কে কানুর চিরন্তন বিশ্রাম কেন্দ্র নিত্য বৃন্দাবনে পরিণত করেছেন। আপন কবি চেতনাকে সদাজাগ্রত প্রহরীরূপে রক্ষা করেছেন সেই প্রেমতীর্থের দ্বারে, কানুর প্রশান্ত নিদ্রাটি যেন ভেঙ্গে না যায়। তাঁর সব কবিতায় এই নিষ্ঠা বিশ্বাস পূর্ণ প্রেম নিত্য বৃন্দাবনের বংশীধ্বনির সুরে অনুরণিত। ব্রজবুলির ছন্দ ঝংকার তাঁর কাব্যে মন্ত্র এবং স্তোত্রের মহিমায় সমুন্নত। অবশ্য অনুরূপ অভাবনীয় পদ বিদ্যাপতির কাব্যেও লভ্য। তাঁর— “সখি, কি পুছসি অনুভব মোয়” পদটি শুধু বাংলা কাব্যে নয় বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ।

অভিসারের পদে গোবিন্দ দাস সম্রাট। তাঁর কোন কোন অভিসার-চিত্র প্রশান্ত গম্ভীর। 

“পহিলহি রাধা মাধব মেলি। 

পরিচয় দুলহ দূরে বহু কেলি।” 

এই লীলা চিত্রটি অখণ্ড চৈতন্য-ঐতিহ্যের স্বরূপ : “মন্দির বাহির কঠিন কপাট। চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।”— প্রকৃতির দুর্যোগ ও সমাজের বন্ধন উপেক্ষা করে রাধা পথে নেমেছেন, কেননা “হরি রহু মানস সুরধনী পার।” হরিই শ্রীরাধার মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তির উৎস। তাই অত বেদনা আর অত সাধনার শেষে যে মিলন তাতে চাঞ্চল্য নেই, আছে শুধু পরম মিলনের অক্ষয় তৃপ্তি।

গোবিন্দ দাস ভক্ত কবি তাই তাঁর সমস্ত পদের মধ্যে ভক্তির উচ্ছ্বসিত ভাবের ফল্গুধারা, কিন্তু বিদ্যাপতির কাব্যে ভক্তিভাব গৌণ। তিনি পঞ্চ-উপাসক বা শৈব ধর্মে বিশ্বাসী। তিনি ভক্তকবি অপেক্ষা সৌন্দর্য রসিক রূপতাত্ত্বিক কবি হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত। নায়িকার বেদনা বিহ্বল হৃদয়াবেগকে প্রকাশ করার মত শিল্প কৌশল তাঁর জানা ছিল।

গোবিন্দদাস পদাবলি সাহিত্যে যে উজ্জ্বল কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন তার পিছনে ছিল বিদ্যাপতিরই ভাব প্রেরণা।