মিথিলার রাজবংশের কবি হয়েও বাঙালীর অন্তর্লোকে যিনি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে রসিক বাঙালী সমাজ যে কবিকে অন্তরের আত্মীয়রূপে বরণ করেছেন—তিনি “মৈথিল কোকিল’ এবং ‘অভিনব জয়দেব’ বিদ্যাপতি।
কবির আবির্ভাব ও তিরোভাবের সঠিক কাল নির্ণয়ের সমস্যা আছে। ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ বা অনতি-পূর্ববর্তী সময়ে উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বংশে বিদ্যাপতির জন্ম হয়। পিতার নাম গণপতি, কৌলিক উপাধি ‘ঠকুর’ বা ‘ঠাকুর’। অনুমান, পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে (১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ) কবির তিরোভাব হয়। কবি তাঁর আত্মপরিচয় এইভাবে দিয়েছেন—
“জনম দাতা মোর গণপতি ঠাকুর
মৈথিল করু বাস।
পঞ্চ গৌড়াধিপ শিবসিংহ ভুপ,
কৃপা করি লেউ নিজ পাশ ৷৷
বিসফি গ্রাম দান করল মুঝে
রহতঙ্গি রাজসন্নিধান
লছিমা চরণ ধ্যানে, কবিতা নিকষশয়ে
বিদ্যাপতি হই ভাণ!”
মিথিলায় প্রচলিত লোকমুখে দুলহা নামে কবির কন্যা, চন্দ্রকলা নামে কবিত্বখ্যাতি সম্পন্না পুত্রবধূ এবং হরপতি, নরপতি ও বাচ্যপতি নামে পুত্রদের কথা জানা যায়। মিথিলার ওইনীবার বা কামেশ্বর বংশোদ্ভূত রাজা কীর্তিসিংহ ও বিশ্বাস দেবী, নরসিংহ ও ধীর মতি, ভৈরবসিংহ এবং দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা কবি বিদ্যাপতি তার সুদীর্ঘ (নব্বই বৎসর) জীবনে লাভ করেছিলেন। এঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি মৈথিলী, সংস্কৃত ও অবহট্ট ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
মিথিলার রাজসভার সঙ্গে বিদ্যাপতির দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠতা ছিল। মিথিলারাজ কীর্তি সিংহ (১৪০২-০৪ খ্ৰীঃ), রাজা শিব সিংহ, রাজা দেবী সিংহ (১৪১০-১৪ খ্ৰীঃ), প্রমুখ রাজগণ এবং রানী লছমী দেবীর পৃষ্ঠপোষকতা কবি লাভ করেছিলেন। দীর্ঘকাল রাজসভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে তার মনের চারিদিকে একটা দরবারী আদর্শের মার্জিত পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। মণ্ডলকলাসিদ্ধ যে সৌকুমার্য ও বাক্নির্মিতির বিস্ময়কর পরিমার্জনা বিদ্যাপতি-কণ্ঠের মুখ্য রাগিণী, তা এই রাজসভারই পরিবেশ-শাসিত রুচি নিষ্ঠার ফসল। ভাষা-ভঙ্গিমাকে শান্ দিয়ে পালিশ করে ঘষে মেজে “রাজকণ্ঠের মণিমালার মত” দ্যুতিময় করে তোলা, নগর-বৃত্তিচারী রাজসভার এই কবির বাক্রীতির বৈশিষ্ট্য।
বিদ্যাপতির গ্রন্থসমূহ:
বিদ্যাপতি শুধু কবি নন, স্মৃতি-সংহিতা ও নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করে এবং পৌরাণিক ও স্মৃতি গ্রন্থাদি রচনা করে পাণ্ডিত্যেরও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বিদ্যাপতির লেখা গ্রন্থসংখ্যা বিস্ময় জাগায়। বিষয়-বৈচিত্র্য, বিভিন্ন ভাষায় রচনা এবং আঙ্গিক প্রকরণের একাধিক রূপ রীতি চোখে পড়ে। তিনি সংস্কৃতে লিখেছেন তীর্থকাহিনীর আদলে ভৌগোলিক বিবরণ ‘ভূপরিক্রমা’ (আনু. ১৪০০), কথাসাহিত্যের রূপে ‘পুরুষপরীক্ষা’ (১৪১০), অবহট্ঠ ভাষায় লেখা তুর্কী অত্যাচারের ইতিহাস ‘কীর্তিলতা’ ও ‘কীর্তিপতাকা (১৪১০), সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ ‘লিখনাবলী’ (১৪১৮), স্তোত্র-পূজার্চনা ও শাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থ ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’-‘ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী’ ও শৈবসর্বস্বহার’ (১৪৩০-৪০), স্মৃতিশাস্ত্র সম্বন্ধীয় বিচারগ্রন্থ ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ (১৪৪০-৬০), ‘বিভাগসার’ ও ‘দানবাক্যাবলী’ (১৪৪০-৬০), বিভিন্ন পূজাপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা ‘বর্ষক্রিয়া’ (১৪৪০) প্রভৃতি। এছাড়া তিনি মাতৃভাষা মৈথিলীতে লিখেছেন ‘হরগৌরী’ বিষয়ক গান, ব্রজবুলি ভাষায় ‘রাধাকৃষ্ণলীলা’ বিষয়ক পদসমূহ, কবিতা ও গানের সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতে লেখা ক্ষুদ্র নাটক ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘মণিমঞ্জরী’ ইত্যাদি।
বিদ্যাপতির ভণিতায় বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথি এবং গ্রীয়ার্সন সংগৃহীত পদাবলীর প্রাথমিক উৎস ছিল। এর ভিত্তিতে সবচেয়ে প্রামাণ্য সংকলন ‘বিদ্যাপতির পদাবলী’ প্রকাশ (১৩৫৯ বঙ্গাব্দ) করেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র এবং বিমানবিহারী মজুমদার। এখানে ৯৩৩টি পদ আছে মৈথিল কবি বিদ্যাপতির। আবার হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সংকলিত ‘পদাবলী পরিচয়’-তে অনেক পদ আছে যেগুলি মৈথিল কবির নয়, বাঙালি বিদ্যাপতির রচনা। সেইজন্য বিদ্যাপতির কাব্য প্রকৃতি এবং মৈথিল কবির তুলনায় বাঙালি কবির প্রামাণ্যতা নিয়ে সমালোচক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সপ্তদশ শতকের শেষে লেখা ‘অক্টরস ব্যাখ্যায়’ ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর” কবিতাটি শেখরের (কবিশেখর) ভণিতায় পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে “কী পুচ্ছসি অনুভব মোয়” পদটি যথাক্রমে বিদ্যাপতি এবং কবিবল্লভ (‘রসকদম্ব’ গ্রন্থপ্রণেতা)-এর নামে প্রচলিত আছে। “ক্ষণে ক্ষণে নয়ন কোণ অনুসরঈ” পদটিও বিদ্যাপতি এবং বিদ্যাবল্লভের নামে পাওয়া যায়। শুধু এই দুজন কবি নন, কবিকণ্ঠহার, নৃপ-বৈদ্যনাথ, চম্পতি, ভূপতি, রায়শেখর (সতীশচন্দ্র রায়ের ‘বিদ্যাপতি বিচার’ গ্রন্থে উল্লেখিত), কবিরঞ্জন বা ছোট বিদ্যাপতি প্রমুখ একাধিক বাঙালি কবির ব্রজবুলিতে লেখা পদ বিদ্যাপতির ভণিতায় প্রচারিত হয়েছে। অনেক সময় কীর্তনীয়াদের জন্যও বিভিন্ন কবিদের লেখা ব্রজবুলি পদ বিদ্যাপতির নামে চলেছে। গৱেষক ঐতিহাসিক রমাকান্ত চক্রবর্তী বলেছেন: “… বিদ্যাপতির ভাষা ব্রজবুলি বিদগ্ধ বৈষ্ণব কবিতার এবং প্রেমের কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছিল। অসমে বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক শঙ্করদেবের কালে (১৪৪৯-১৫৫৮), এবং উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের শাসনকালে (১৫০৪-১৫৩২) সেই দুই প্রদেশে ব্রজবুলি প্রচলিত হয়। জন্মসূত্রে মৈথিল হলেও বিদ্যাপতি বঙ্গীয় কবিগণের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান পেয়েছিলেন। বাংলা ভাষার ও কবিতার ইতিহাসে বিদ্যাপতির স্থান অতি বিশিষ্ট”
সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য: মৈথিল কবি বিদ্যাপতি মিথিলার সুপরিণত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের এক উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন। তাঁর রচিত প্রায় ৭০০ পদে রাগ রাগিণীর উল্লেখ আছে। বৈষ্ণব সমাজ ও শাস্ত্রের গবেষক রমাকান্ত চক্রবর্তী লিখেছেন : “অষ্টাদশ শতকে মিথিলার কবি লোচন শর্মা (ঝা) মিথিলার রাজা নরপতি ঠাকুরের আদেশে ‘রাগতরঙ্গিণী’ নামে একটি সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। কবি বিদ্যাপতির সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য লোচন শর্মা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বিদ্যাপতির ৫১টি পদের রাগরূপ তিনি নির্দিষ্ট করেছেন।… নেপাল-পুঁথিতে উল্লিখিত রাগরাগিণীর সঙ্গে লোচন শর্মার বিবরণ মিলিয়ে দেখে এমন ভাবা যায় যে, সপ্তদশ শতকে বিদ্যাপতির গীতি বিশুদ্ধ মার্গসঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। তাতে বৈষ্ণব ‘কীর্তন’-এর উপাদান কতটুকু ছিল তা দুনির্ণেয়”
কীর্তন ছিল বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের সর্ব প্রধান মাধ্যম। কিন্তু কীর্তনের পাশাপাশি আর একটি মাধ্যমও প্রচলিত ছিল, সেটি হল কথকতা অথবা পাঠকতা। বৈষ্ণব সাহিত্যের এই ধারার কথা উল্লেখ করে ড. রমাকান্ত চক্রবর্তী লিখেছেন : “মিথিলাতে প্রচলিত কথকতা সম্বন্ধে লোচনের ‘রাগতরঙ্গিণী’তে কিছু তথ্য আছে। রাজ্যেশ্বর মিত্র অনুমান করেছেন যে, বিদ্যাপতিও একজন কথক ছিলেন।…. ভাগবত পাঠে রাগরাগিণীর তরঙ্গবিভ্রম মিথিলাতেই সম্ভবত উদ্ভাবিত হয়, এবং মথুরা-বৃন্দাবনে তা স্পষ্টতর হয়’” (“বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬২)। ধর্মমতে, তিনি কুলরীতি-অনুযায়ী ছিলেন শৈব বা ‘পঞ্চোপাসক’ হিন্দু। তবু তাঁর অন্তরের নিবিড় আকুতি বৈষ্ণব পদেই যেন বেশি পরিমাণে ফুটে উঠেছে।
বিদ্যাপতির প্রধান পরিচয় তার রাধাকৃষ্ণ পদাবলী। রাধা-কৃষ্ণের স্পষ্ট উল্লেখ আছে এমন পদের সংখ্যা ৫০০টিরও বেশি। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে বর্ণিত নায়ক-নায়িকার প্রকরণ অনুসারে তিনি রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগ, প্রথম মিলন, রাধার বয়সন্ধি, বাসক-সজ্জা, অভিসার, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা কলহান্তরিতা বা মান, বিরহ বা মাথুর, পুনর্মিলন বা ভাবসম্মিলন প্রভৃতি বিভিন্ন লীলা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের বিরহ ও মিলনলীলা বর্ণনা করেছেন। এই বিষয়ে তিনি উপকরণ আহরণ করেছেন সম্ভবতঃ বিষ্ণুপুরাণ, শ্রীজয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’, ‘অমরুশতক’, ‘গাহাসত্তসঈ’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে। প্রসঙ্গ ও প্রকরণের সমন্বয়ে, কল্পনা ও বাক্নিমিতির সমতায় তার সৃষ্ট পদগুলি হয়েছে দীপ্তিময়। কিন্তু কেবল হঠাৎ আলোর ঝলকানিতেই তাঁর কাব্যের সীমা আদিগন্ত আলোকিত হয় নি। জীবনরসের চিত্রণই তার স্বভাবধর্ম। তাই তাঁর পদাবলী প্রাণের গভীর রসে দ্রবীভূত। আর এই কারণেই তার কাব্যপাঠে মহাপ্রভু শাস্তি পেতেন। এই কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৈষ্ণবদের গুরুস্থানীয় এবং রসিক বাঙালীর “কবি-সার্বভৌম”।
বয়ঃসন্ধি থেকে মাথুর বিরহের আর্তি পর্যন্ত পদগুলির মধ্যে রাধাচরিত্রের যে স্বরূপটি সঙ্গীতায়িত হয়েছে, তার অভিনবত্ব বিদ্যাপতিকে দান করেছে অমরত্বের সিংহাসন। চণ্ডীদাসের রাধার যৌবন-সমাগমের দুর্লভ মুহূর্তটুকু পাঠকের অগোচরেই সমাপ্ত হয়েছে। পাঠকের সঙ্গে রাধার যখন পরিচয় হল তখন তিনি যোগিনী। জ্ঞানদাস গোবিন্দদাসের রাধা সম্বন্ধেও একথা প্রযোজ্য। একমাত্র বিদ্যাপতিই রাধার অখণ্ড জীবনপ্রবাহকে বর্ণাঢ্য কল্পনার আলোকসম্পাতে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বয়ঃসন্ধির নৃত্যচপল মুহূর্ত থেকে ভাব সম্মিলন পর্যন্ত এই দীর্ঘসময়ে তার রাধা ধীরে ধীরে কোরক থেকে পূর্ণ যৌবন বিকশিত কমলিনীতে পরিণত হয়েছেন।
রাধার প্রথম যৌবনের ভীতিমিশ্রিত কৌতুক, অবাধ বাসনার প্রচ্ছন্ন উল্লাস, শৈশব স্রোতস্বিনীর কুলুকুলু ধ্বনির সঙ্গে যৌবন-সমুদ্রের দূরাগত কল্লোল সংঘাত এমন চিত্রকল্পে ও মণ্ডনকলায় বিদ্যাপতি চিত্রিত করেছেন যে, তাঁর ভাবশিষ্য গোবিন্দদাস ছাড়া অন্যত্র বিরলদৃষ্ট। বয়ঃসন্ধির নবীন আলোকপাতে রাধার মনের উপরে যে চপল চিন্তার নৃত্য চলেছে রসিক-শিল্পী চিত্রের পর চিত্র যোগ করে তাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। “খনে খনে নয়ন কোণ অনুসরঈ/খনে খনে বসন ধূলি তনু ভরঈ”, “নিরজুনে উরজ হেরই কত বেরি/হসই সে অপন পয়োধর হেরি” “জঁহা জঁহা ঝলকত অঙ্গ/তঁহি তঁহি বিজুরি তরঙ্গ” প্রভৃতি পদে কবিশিল্পী যেন অনঙ্গকে অঙ্গের বাসনাপ্রদীপে দীপ্তিময় করে তুলেছেন।
পূর্বরাগের পদে বয়ঃসন্ধির পদের মতো বিস্ময়কর কবিত্বশক্তি অনেকাংশে অনুপস্থিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও কবি-ব্যক্তিত্ব উপেক্ষনীয় নয়। বয়ঃসন্ধির পদের মতো পূর্বরাগের পদেও বিদ্যাপতির রূপবিভোরতা আছে, আত্মবিস্মৃত ভাব নেই। কবি যেন স্বয়ং কৃষ্ণ হয়ে রাধার রূপ-সুন্দর দেহ-কান্তি অবলোকন করছেন। “যব গোধূলি সময় গেল, ধনি মন্দির বাহর ভেলী” ইত্যাদি পদ রাধার রূপ দর্শনে কৃষ্ণের মুগ্ধ-চিত্তের ব্যাকুল আর্তিরই প্রকাশ।
অভিসার, মিলন, বিরহ, বাসকসজ্জা, মান—রাধার সঙ্কীর্ণ জীবনে বিচিত্র রসবর্ষণ শুরু করল। বিদ্যাপতি এতদিন রূপের অন্দরমহলে বন্দী ছিলেন। অভিসার পর্বে এসে, তার মুক্তি ঘটলো অসীম রসলোকে। এতদিন যে রাধার মধ্যে চমক ছিল, অভিসারের দুর্জয় আত্মবিশ্বাসে, এবং দুরূহ ত্যাগে সেই রাধাই অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনাময় স্বর্ণনায়িকায় রূপান্তরিত হলেন। অভিসারের পদে তাই শুনি শঙ্কাহীন রাধার শপথবাণী—“ঘর গুরুজন ডর না মানিব—বচন চুকব নহে।”
‘মাথুর’ পর্বে দেখি, দুঃখ বেদনার অগ্নিতাপে লীলাবিলাসের ছলাকলা রাধাচরিত্র থেকে কিংশুক মঞ্জরীর মত ঝরে পড়ল। পিপাসায় কণ্ঠকাতর, কাজেই সিন্ধু অথচ কোথায় সেই মুক্তির পথ? “এ নবযৌবন বিরহে গোঙায়ব/ কি করব সো পিয়া লেহে ৷৷” এর মধ্যে কোথায় দেহকেন্দ্রিক ভোগবিলাস? এ যেন মধ্যাহ্নের বিরল স্তব্ধতায় পত্রপল্লবে আছাড় খাওয়া বিরহী সমীরণের মর্মরিত দীর্ঘশ্বাস ঘন বরযায় রাধা যখন কৃষ্ণের জন্য উন্মুখ-মুখর তখন শুনি তার হৃদয়ভেদী হাহাকার— “এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভর বাদর মাহ ভাদর—শূন্য মন্দির মোর।” রাধা চিত্তের ব্যাকুল ক্রন্দন বর্ষণমুখর প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বর্ণকমলের মত ফুটে উঠেছে—“মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী/ ফাটি যায়ত ছাতিয়া।” বাংলা কাব্যে এই পদের সমকক্ষ পদ বিরল। কৃষ্ণহারা রাধার মানসিক অবস্থা যেন—
“সূন ভেল মন্দির সূন ভেল নগরী।
সূন ভেল দশ দিস সূন ভেল সগরী ॥”
বিরহের আর একটি অপূর্ব সুন্দর পদ বিদ্যাপতির লেখনী হতে উৎসারিত, যার তুলনা বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ—
“জনম অবধি হাম রূপ নিহাৱঁল
নয়ন না তিরপিত ভেল।
সেই মধুর বোল শ্রবণহি সূনল
শ্রুতিপথে পরশ না গেল ॥ ”
“লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখল।
তব হিঅ জুড়ল না গেল ৷৷”
এই লাখ লাখ যুগের কল্পনাই হল “Cosmic Imagination” কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার “হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি আমি পৃথিবীর পথে” পক্তিগুলির মতো এই পদেও আছে শিল্পের অনন্ত লাবণ্য।
ভাবসম্মিলনের পদে বিদ্যাপতির একক প্রাধান্য— এই পদে তিনি দ্বিতীয়রহিত। বিরহিণী রাধা কল্পনা করছেন কৃষ্ণ আসবেন। তিনি এলে নিজেকে কেমন করে আপন অঙ্গসজ্জায় সুশোভিত করবেন, “কবি-সার্বভৌম” তার বর্ণনা করেছেন—
“পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে।
মঙ্গল যতই করব নিজ দেহে ৷৷”
আরেকটি অবিস্মরণীয় ভাবসম্মিলনের পদ—
“সপনে আএল সখী মঝু পিয়া পাসে।
তখুনুক কি কহব হৃদয় হুলাসে।।
…উঠিল লেহাই আলিঙ্গন বেরী।
রহলি লজ্জাএ সূনি সেজ হেরী ।”
এই পদের জন্ম হৃদয়, এর পালন হৃদয়, এর সুরভি-নির্যাস হৃদয়ের কোমল-কোরকে। জীবনের গভীর উপলব্ধির কথা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সমকালীন বা পরবর্তীকালে আর কার কাব্য মধ্যে এত অজস্র পরিমাণে পাওয়া যাবে?
ছন্দে, অলঙ্কারে, শব্দ-বিন্যাসে, বাগ্বৈদগ্ধে বিদ্যাপতির পদ যেমন হীরকখণ্ডের মত আলোক বিচ্ছুরণে সহস্রমুখী, তেমনি জীবনের আলো ও আঁধারে, বিপুল পুলকে ও অশান্ত বেদনায় দোসরহীন।
Leave a comment