সংক্ষেপে বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভা আলোচনা কর

উত্তর: মধ্যযুগের গীতিকবিতা বলতে আমরা ‘বৈষ্ণব পদাবলীকেই বুঝে থাকি। তেমনি পদাবলীর কবিদের প্রসঙ্গ আসলেই যে নামটি সবার আগে চলে আসে, তিনি হলেন রাজসভার কবি বিদ্যাপতি। তিনি ছিলেন মিথিলার কবি যাঁর অপরিসীম দক্ষতা ছিল ভাষা ও অলঙ্কার শাস্ত্রে। তাঁর রচনার প্রধান আকর্ষণ হলো, তিনি ব্রজবুলি ভাষাতে তাঁর পদগুলো রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন চৈতন্য পূর্ববর্তী কবি। বিদ্যাপতির পদে মূলত বয়ঃসন্ধিক্ষণ ও যুবতী রাধিকার মনের চিত্র অসাধারণ শিল্পিত সৌন্দর্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর পদে রাধার দেহসৌন্দর্য তথা কবির রূপমুগ্ধতা অতি সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যাপতির এই রূপমুগ্ধতা দর্শনে রবীন্দ্রনাথ বলেন:

“যৌবন সেও সবে আরম্ভ হইতেছে, তখন সকলই রহস্যে পরিপূর্ণ। সদ্যবিকচ হৃদয় সহসা আপনার সৌরভ আপনি অনুভব করিতেছে; আপনার সম্বন্ধে আপনি সবেমাত্র সচেতন হইয়া উঠিতেছে; তাই লজ্জায় ভয়ে আনন্দে সংশয়ে আপনাকে গোপন করিবে কি প্রকাশ করিবে ভাবিয়া পাইতেছে না।”

তাঁর এমনই একটি পদ:

ক্ষণে ক্ষণে নয়ন কোণ অনুসরই।

ক্ষণে ক্ষণে বসন-ধূলি তনু ভরই॥

ক্ষণে ক্ষণে দসন ছটাছট হাস।

ক্ষণে ক্ষণে অধর আগে ঝরু বাস ॥”

বিদ্যাপতির রাধা যেমন চৈতন্যপরবর্তী রাধার থেকে আলাদা তেমনি তাঁর রচিত পদের সাহিত্যগুণ ভিন্ন। তাঁর পদে ভাব ভাষা ছন্দ অলঙ্কারের অনুপম ব্যবহার তাঁকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। পদাবলী সাহিত্যের অঙ্গনে রাজকীয় বৈচিত্র্য নিয়ে বিদ্যাপতি বেঁচে ছিলেন ষাট বছর। জীবিতাবস্থায় বিদ্যাপতি প্রায় সহস্রাধিক পদ রচনা করেছিলেন। বিদ্যাপতি তাঁর পদে শ্রীমতী রাধাকে নির্মাণ করেছেন সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রানুযায়ী। বিদ্যাপতির রাধিকা বর্ণচ্ছটায় পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন, মান-অভিমান ইত্যাদি পর্যায়ে মুগ্ধ নায়িকা। তাঁর রাধা রসবতী রমণী, যার কথোপকথনে চাতুরি, নয়নে য়নে বক্রভঙ্গি, ভ্রুতে বিদ্যুতের ছটা এবং সিঞ্জনীর আহ্বান। রাজসভার কবি বিদ্যাপতি যে রাধিকাকে নির্মাণ করেছেন সে মার্জিত রুচিসম্পন্ন এক প্রগলভ বিদগ্ধ নায়িকা। নিম্নোক্ত পদে বিরহী রাধার হাহাকার অপূর্ব কাব্যসৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে:

“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।”

বিদ্যাপতি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন এবং জ্ঞানী কবি। তাই তিনি এমন একটি ভাষা অবলম্বন করলেন যে, ভাষা একটি নিজস্ব বিশেষত্ব নিয়ে আজও দীপ্যমান। তাই তিনি ‘কীর্তিলতা’ রচনা করেছেন অবহট্ঠ ভাষায়। এই অবহট্ট ভাষার পরবর্তী রূপ পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় কথ্যভাষার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে এক ব্যাপক সরস ভাষারূপে উদিত হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল প্রাচীন মৈথিলী এবং ব্রজভাষা।

“জতনে জতেক ধন পায়ে বটোরল

মিলি মিলি পরিজন খায়।

মরণক বেরি হরি কৈঈ নপুএ

করম সঙ্গ চলি জাএ।”

কিশোরী রাধার শারীরিক পরিবর্তন তথা যৌবনাগমন এবং ক্রমবিকাশ যেমন কবি বর্ণনা করেছেন শৈল্পিক নিষ্ঠায়, তেমনি তিনি রাধার মনোজগতের ক্রমিক পরিবর্তনটিও তুলে ধরেছেন সমান দক্ষতায়। উভয় ক্ষেত্রেই কবির সুন্দরের আরাধনা থেকেছে সমভাবে ক্রিয়াশীল।

কবি রাধার দৈহিক পরিবর্তনের চিত্র এঁকেছেন এভাবে:

” দিনে দিনে উন্নত পয়োধর পীন

বাঢ়ল নিতম্ব মাঝ ভেল ক্ষীণ।

অবে মদন বঢ়ালয় দীঠ

শৈশব সকলি চমকি দেল পীঠ।”

বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রায় হাজার খানেক পদ লিখেছেন। একটু যত্নের সঙ্গে সেগুলো, পাঠ করলেই বুঝা যায় বহু পদেই তিনি রাধাকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করেননি। শ্রীরাধার চিত্রাঙ্কনে কবি যে একাধিক সংস্কৃত কবি ও রতিশাস্ত্র প্রবক্তাদের অনুসরণে পার্থিব কামকলার চিত্রণে স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়েছেন, তাতে সৌন্দর্যানুরাগী কবির পরিচয়টি বড়ো হয়ে ওঠে। পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা বিদ্যাপতির মাধ্যমেই সংস্কৃত কামকলার প্রাচীন কবিদের সঙ্গে মিলনসূত্রটি গেঁথে নিয়েছেন। পদাবলী সাহিত্যের প্রথম এবং সম্ভবত বৈচিত্র্যের ও ভাবসৌন্দর্যের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার হলেন বিদ্যাপতি। তিনিই রাধাকৃষ্ণ লীলা আখ্যায়িকার প্রধানতম পর্যায়গুলোর প্রথম কাঠামো তৈরি করে দিয়েছেন। বৈষ্ণব পদের ভাবরসে কিছু অলৌকিকত্ব গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদকারেরা হয়ত এনেছেন, তবে আলম্বন বিভাব এবং মূল ভাবলীলা বিস্তারের সঞ্চারী ভাবে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলার চিত্রাবলম্বনে তাঁর বিদ্যাপতিকেই আদর্শ ধরেছেন। কারণ রাধাকৃষ্ণ প্রেমের বিশুদ্ধ চিত্ররসিকের অভিধা বিদ্যাপতির জন্য প্রযোজ্য। বিদ্যাপতি পদাবলী সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।