উত্তর: কবি বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার অধিবাসী। তাঁর প্রতিভাও ছিল বিচিত্রমুখী। স্মৃতিশাস্ত্র, পৌরাণিক পূজাপদ্ধতি ও সাধনপ্রণালি, ইতিহাস, ভূগোল, অলংকারশাস্ত্র, কথাসাহিত্য প্রভৃতি নানা বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাছাড়াও পদগীতি রচনা করেছিলেন হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের লীলা-প্রসঙ্গ নিয়ে। বিভিন্ন ভাষাতেও বিদ্যাপতির দখল ছিল গভীর। তাঁর স্মৃতি ও ধর্মগ্রন্থগুলো সংস্কৃত ভাষায় লেখা, ‘পুরুষপরীক্ষা’ নামক কথাসাহিত্যও তাই। ‘কীর্তিলতা’ আর ‘কীর্তিপতাকা’-এ দুখানি ইতিহাসগ্রন্থ লেখা হয়েছিল ‘অবহটঠ’ ভাষায়। ‘অবহটঠ’ অর্থে বুঝি ‘অর্বাচীন’ অপভ্রংশ ভাষা। হর-গৌরী বিষয়ক পদ কবি তাঁর মাতৃভাষা ‘মৈথিলি’ ভাষায় লেখা। কিন্তু মিথিলায় প্রাপ্ত বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদের সংখ্যা একশোরও কম; তাঁর সাহিত্যিক উৎকর্ষও প্রায় অনুল্লেখ্য। বস্তুত রস-মধুর যে পদগুলোর জন্য বিদ্যাপতি আজ কবি-কুলপতি, তার প্রায় সকবটিই বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। বাংলা বৈষ্ণব পদাবলীর জন্য প্রাচীন সংকলনে পদগুলো এক বিচিত্রতর ভাষায় লেখা আছে-একালে তার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ব্রজবুলি ভাষা।
আমরা জানি, ব্রজবুলি কোনো দেশের কোনো লোকেরই মাতৃভাষা নয়। মূলত “বাংলা মৈথিলি পদাবলীর মিশ্রণে এবং অবহটঠর ঠাটে ব্রজবুলির উৎপত্তি” হয়েছিল। মনে হয়, এ বিমিশ্র ভাষাকে আশ্রয় করেই বিদ্যাপতি অধিক সংখ্যক বৈষ্ণব কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু সেভাষা একালে আমাদের চেনা বিদ্যাপতির পদে যে অনেকটাই পালটে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রাচীন বাংলাদেশে কাব্য কবিতার চর্চা লিখিতভাবে বড়ো একটা হতো না যত হতো মৌখিক আবৃত্তি বা গানের মধ্য দিয়ে। ফলে কালে কথ্যভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গায়েনদের কণ্ঠে মূল পদের ভাষাতেও পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে লেগেছে যুগের কথ্যভঙ্গির ছাপ। তবু ব্রজবুলি কবিতার মূল কাঠামোটি হয়ত বিদ্যাপতির হাতেই প্রথম গড়ে উঠেছিল। পরে চৈতন্য-উত্তরকালে বাংলার শ্রেষ্ঠ এক বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির অনুসরণ করে মুখ্যত এ ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করে গেছেন, এজন্য তাঁকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এ কবির নাম গোবিন্দদাস কবিরাজ। এ ছাড়াও বহু বাঙালি কবি ব্রজবুলি ভাষায় উৎকৃষ্ট বৈষ্ণব পদ লিখেছেন। বাঙালির লেখা ব্রজবুলি বৈষ্ণব কবিতার আদিগুরু রূপেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাপতির অক্ষয় প্রতিষ্ঠা। মহাপ্রভুর প্রীতি পক্ষপাত তাঁর পদাবলীকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে কেবল আস্বাদনীয় নয়, পূজনীয়ও করে তুলেছিল। এ জন্যই মূল রচনার পটভূমি মিথিলায় বিদ্যাপতির বৈষ্ণব কবিতা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেলেও, বাংলাদেশে তা সবিশেষ যত্নসহকারে রক্ষিত হয়েছে। বাঙালির ভাবভক্তি-বিশ্বাস বিদ্যাপতির কবি কীর্তিকে বিনাশের হাত হতে রক্ষা করেছে, তাঁর রচনাশৈলী ও ভাষাপ্রকৃতি বাঙালি কবিকে উদ্বুদ্ধ করেছে নবীন কাব্য-রচনায়-এ পারস্পরিক হৃদ্যতা ও পরিপূরকতার প্রীতিসূত্রেই বিদ্যাপতি স্মরণীয়-
এ সখি হামারি দুখেরও নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।
এরকম অসংখ্য পদে বিদ্যাপতি অমরত্ব লাভ করেছেন।
Leave a comment