কমলাকান্তরুপী বঙ্কিমচন্দ্র ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর মধ্য দিয়ে সহজ লঘু সুরে জীবনের গভীর কথা বলেছেন। তিনি যেন সংসারের এক কোণে দাঁড়িয়ে একটি অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির সহায়তায় জীবন ও জগৎ পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই কার্যে জীবন ও জগতের নানা অসংগতি ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁর চোখে পড়েছে। তিনি সেগুলি হাস্যরসের ভাব-কল্পনায় গভীর ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। ‘বিড়াল’ এবং অন্যান্য কতিপয় প্রবন্ধের হাস্যরসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় “……humour-এর লক্ষণ হইতেছে—একটি অসাধারণ দৃষ্টিকেন্দ্র হতে জীবনের পর্যবেক্ষণ ও তার প্রচলিত গতির মধ্যে নানা বক্ররেখা ও সূক্ষ্ম অসংগতির কৌতুককর আবিষ্কার। অনেকগুলি প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র জীবনকে একটা প্রবল সর্বব্যাপী হাস্যকর অথচ গভীর অর্থপূর্ণ কল্পনার ভিতর দিয়ে দেখেছেন। সেই কল্পনার দ্বারা বিকৃত ও রূপান্তরিত হয়ে জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য একটা ব্যর্থ উদ্ভট খেয়ালের সূত্রে গ্রথিত বলিয়া প্রতিভাত হয়েছে। ‘মনুষ্যফল’, ‘পতঙ্গ’, ‘বড়বাজার’, ‘বিড়াল’, ‘ঢেঁকি’, ‘পলিটিকস’, ‘বাঙ্গালীর মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধগুলি এই প্রণালীর উদাহরণ। এই সমস্তই প্রবন্ধেই জীবনক্ষেত্রে কল্পনার প্রয়োগ খুব স্বাভাবিক হয়েছে ও উপমাগুলির নির্বাচন সাদৃশ্য-আবিষ্কারের ক্ষমতার পরিচয় দেয়। হয়তো স্থানে স্থানে তুলনার মধ্যে একটু কষ্ট কল্পনার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়; হয়তো কোথাও কোথাও জীবন-সমালোচনা যেন একটু অতিরিক্ত মাত্রায় কল্পনাবিলাসী (far-fetched) বলিয়া আমাদের মৃদু প্রতিবাদ-স্পৃহা জাগায়। কিন্তু লেখকের অনুভূতির প্রখরতায় ও কল্পনাস্রোতের প্রবল প্রবাহে এ সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সন্দেহ কোথায় ভেসে যায়।”
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লঘু কৌতুক সুরে পৃথিবীর একটি চিরন্তন সমস্যার মূল কারণ আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটিতে তাঁর সমাজচেতনা ও কৌতুকরস-রসিকতার মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে। এই প্রবন্ধে আলোচিত সমাজতন্ত্রবাদ লইয়া তিনি তাঁর বিশ্লেষণমূলক পাণ্ডিত্যধর্মী ‘সাম্য’ প্রবন্ধেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের বক্তব্য যত হৃদয়গ্রাহী ও আন্তরিক হয়েছে, ‘সাম্য’ ততটা হয়নি। ‘সাম্য’ প্রবন্ধের আলোচনায় তিনি পাঠকের মনন দ্বারে সাড়া জাগাতে পারেন, কিন্তু ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বিড়ালের বক্তব্য মারফত তিনি পাঠকের মর্মদ্বারে আঘাত করেছেন। লঘু হাস্যকৌতুকের মধ্য দিয়ে মূল বক্তব্য পরিবেশন করলেও তা গভীর বাঞ্জনাদ্যোতক। বস্তুত সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রবাদের মতো কঠিন নীরস বিষয়কে কমালাকান্তের ও ক্ষুদ্র বিড়ালের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের বক্তব্য অত হৃদয়গ্রাহী ও চিত্তাকর্ষক হয়ে পড়েছে। প্রবন্ধের কৌতুককর উপস্থাপনা ও পরিবেশন নৈপুণ্য পাঠকচিত্তে হাস্যরসের স্রোতোধারায় অকস্মাৎ কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্রের বিশুদ্ধ নির্মল লঘু কৌতুকের সুর লক্ষণীয়। “আহার প্রস্তুত হয় নাই—এই জন্য হুঁকা হাতে, নিমীলিত লোচনে আমি ভাবছিলাম যে, আমি যদি নেপোলিয়ান্ হতাম, তবে ওয়াটার্লু জিততে পারতাম কী না। এমন সময় একটি ক্ষুদ্র শব্দ হল, ‘মেও’। কমলাকান্ত প্রথমে ভেবেছিলেন, ডিউক অব ওয়েলিংটন বিড়ালের রূপ ধরে আফিম ভিক্ষার্থে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙিল। ব্যথিত চিত্তে দেখলেন একটি ক্ষুদ্র বিড়াল তাঁর দুধ খেয়ে ফেলেছে। সাম্যনীতিতে আস্থাবান কমলাকান্ত প্রথমটা এ বিষয়ে গ্রাহ্য না করলেও পরে ভাবেন এমত অবস্থায় বিড়ালকে না মারলে স্বজাতিমণ্ডলে কাপুরুষ বলে পরিগণিত হবেন। “অতএর ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করে, সকাতরচিত্তে, হস্ত হতে হুঁকা নামিয়ে, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করে সগর্বে মার্জারের প্রতি ধাবমান হলাম।”
বিড়াল কমলাকান্তকে বিলক্ষণ চিনত। তাই কমলাকান্তের বীরত্বে বিশেষ বিচলিত না হয়ে ঈষৎ সরে বসল। তারপর দরিদ্রের প্রতিনিধিরূপে সমাজতন্ত্রবাদের মূলসূত্রসমূহ আলোচনা করতে বসল “তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল, প্রভেদ কী ? তোমাদের ক্ষুৎপিপাসা আছে—আমাদের কি নাই ?” চুরির মূল কারণ বিশ্লেষণ করে সে বলেছে, “দেখ, আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করে চোর হয়েছি ? খেতে পেলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁরা বড়ো বড়ো সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁরা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক।.…….. চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত গুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়, চুরির মূল যে কৃপণ, তার দণ্ড হয় না কেন!” মানবসমাজের বিচিত্র নিয়মকে ধিক্কার দিয়ে বিড়াল বলেছে “তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ—দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বোঝে না! যে খেতে বললে বিরক্ত হয়, তার জন্য ভোজের আয়োজন করো—আর ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলে তার দণ্ড করো। ছি! ছি!” আধুনিক বিচার ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে বিড়াল বলেছে, “চোরকে ফাঁসি দাও, তাতেও আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তার সঙ্গে আর একটা নিয়ম করো। যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করবেন। তাতে যদি তাঁর চুরি করে খেতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন।”
বিড়ালের কথাগুলি আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর শুনালেও এর মধ্যস্থিত চিরন্তন সমাজসমস্যার মূল তত্ত্বটির পরিচয় অজ্ঞাত থাকে না। লঘু কৌতুকের সুরে কথাগুলি পরিবেশিত হলেও পাঠকের মর্মদ্বারে তা আঘাত করে যায়। বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্রের কৌতুকরস রসিকতা অতি উচ্চ পর্যায়ের। এটি খুব সূক্ষ্ম পরিমিতবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে পাঠকচিত্তকে নির্মল সংযত হাস্যের অবকাশ দেয়। বঙ্কিমচন্দ্র কৌতুকরস-সৃজনে সর্বদাই সুমার্জিত রুচির পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কৌতুকরসের মধ্যে কোথাও কোনো আবিলতা নেই। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সহজ সত্য দৃষ্টি হতে তাঁর নির্মল শুভ্র কৌতুকরসধারা উৎসারিত। বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বিড়ালের কটাক্ষ—–“বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির আশা দেখি না।” অনেক সময় কৌতুকরসের সহিত করুণ রস যুক্ত হয় উচ্চাঙ্গের humour সৃষ্টি হয়েছে “দেখ, আমাদিগের দশা দেখ, দেখ প্রাচীরে, প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে, প্রাসাদে প্রাসাদে, মেও মেও করে আমরা চারিদিক দৃষ্টি করছি—কেউ আমাদের মাছের কাঁটাখানা ফেলে দেয় না। যদি কেউ তোমাদের সোহাগের বিড়াল হতে পারল—গৃহমার্জার হয়ে, বৃদ্ধের নিকট যুবতি ভার্যার সহোদর, বা মূর্খ ধনীর কাছে সতরঞ্জ খেলওয়াড়ের স্থানীয় হয়ে থাকতে পারল—তবে তার পুষ্টি। তার লেজ ফুলে, গায়ে লোম হয়, এবং তাদের রূপের ছটা দেখে অনেক মার্জার কবি হয়ে পড়ে।” কিংবা “তুমি কমলাকান্ত, দূরদর্শী, কেননা আফিমখোর, তুমিও কি দেখিতে পাও না যে, ধনীর দোষেই দরিদ্রে চোর হয় ?
শুধু উচ্চাঙ্গের humour নয়, উচ্চ স্তরের wit-এর দীপ্তি আলোচ্য প্রবন্ধের স্থানে স্থানে বিদ্যুতের মতো ঝলকে উঠেছে। কমলাকান্ত বিড়ালের নিকট তর্কে পরাজিত হয়ে বলেন, “বিজ্ঞ লোকের মতো এই যে যখন বিচারে পরাস্ত হইবে, তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান করবে” কিংবা “বিড়ালকে বুঝান দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়ায়িক, কস্মিনকালে কেউ তাকে কিছু বুঝাতে পারে না। এ মার্জার সুবিচারক, এবং সুতার্কিকও বটে, সুতরাং না বুঝবার পক্ষে এর অধিকার আছে।”
বস্তুত প্রবন্ধের প্রথমে কমলাকান্তের উদ্ভট চিন্তা হতে শুরু করে প্রবন্ধের শেষে খ্রিস্টধর্মের প্রচারকদের ব্যঙ্গ অনুকরণে “একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হতে আলোকে আনিয়াছে, ভাবিয়া কমলাকান্তের বড়ো আনন্দ হল!” শেষপর্যন্ত সর্বত্রই বঙ্কিমচন্দ্র শুভ্র লঘু কৌতুকরসের মণিমুক্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর হাস্যরস পাঠককে হাসতে হাসতে ভাবিয়েছে ও ভাবতে ভাবতে হাসিয়েছে। জগৎ ও জীবনের গভীর সুর কৌতুকের স্পর্শে লঘু হয়েও হৃদয়কে চিন্তাভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
Leave a comment