বর্তমানে পণ্য ও পরিষেবা ছাড়া বিজ্ঞাপণের পরিধির অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা বা আদর্শ। যা মানুষের ইচ্ছা শক্তিকে উজ্জীবিত করে। সুতরাং পণ্য সংক্রান্ত খবরা-খবর দেওয়াই বিজ্ঞাপণের একমাত্র লক্ষ্য নয়।

বিজ্ঞাপনের সংজ্ঞা / বিজ্ঞাপন কি বা কাকে বলে :-

বিজ্ঞাপন কি বা বিজ্ঞাপন কাকে বলে? এ নিয়ে অনেকের অনেক রকম মত রয়েছে। তবে বিশেষ কিছু ব্যক্তিদের মতে বিজ্ঞাপনের সংজ্ঞা নিন্মে আলোচনা করা হলো-

প্রখ্যাত বিজ্ঞাপণ লেখক রজার রিভ্স এর মতে বিজ্ঞাপন কি

“এক জনের ধ্যান ধারণা অন্য ব্যক্তির মস্তিষ্কে প্রবেশ করানোর কলা কৌশল বিজ্ঞাপণ ।”

জে. ভল্টার টমসন বিজ্ঞাপণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,

“বিজ্ঞাপণ এমন এক বার্তা যা এক বা একাধিক ব্যক্তিকে জাগানোর জন্য বা প্রভাবিত করার জন্য মূল্য দিয়ে প্রচার করা হয়।”

বিজ্ঞাপন কাকে বলে তা বলতে গিয়ে ডেভিড কর্নস্টাইল বলেছেন,

“বিজ্ঞাপণ বিভিন্ন পণ্যের ধারণার উৎস এবং সংযোগ যা ব্যবহারকারীকে পণ্যটি ব্যবহার করতে উদ্দিপিত করে।”

ফ্যাঙ্ক জ্যাফকিন (Frank Jafliees) বিজ্ঞাপন কি এ সম্পর্কে বলেছেন,

“Advertising is a paid, silent Salesmanship in print or as the means by which we make known what we have to sell and what we want to buy.”

বিজ্ঞাপনের প্রকারভেদ :-

বিজ্ঞাপনের নানা প্রকারভেদ হতে পারে তবে নিন্মোক্ত বিভাগ গুলোর সাথে সব ধরণের বিজ্ঞাপন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

  1. মুদ্রণ বা ছাপা বা পোস্টারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন
  2. টেলিভিশন বিজ্ঞাপন
  3. রেডিও / বেতার বিজ্ঞাপন
  4. ইন্টারনেট বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপনের এই প্রকারভেদের আবার নানা ভাগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপণের গঠন :-

একটি বিজ্ঞাপণ তৈরী বা গঠন করতে যে বিষয়ে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হল বিজ্ঞাপণের শিরোনাম, উপশিরোনাম,ছবির ব্যবহার, বিষয় লিপি, স্লোগান, ছবি লোগো এই সবই হল বিজ্ঞাপণ তৈরির বিভিন্ন অংশ। এইসব কিছু গ্রাহকের সামনে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য হল দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করা, আগ্রহ অভিলাষ জাগানো।

শিরোনাম :-

বিজ্ঞাপণ গঠনের শুরুতেই নজর রাখা হয় শিরোনাম তৈরির উপর। কারণ বিজ্ঞাপণের শিরোনামের সাথেই পাঠকের প্রথম পরিচয় ঘটে। এটি পাঠকের কাছে টেলিগ্রাফের মত কাজ করে। শিরোনাম এমন হবে যাতে দেখে পাঠক বিজ্ঞাপণের বাকি অংশের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠবে। তাই বিজ্ঞাপণ গঠন শিরোনামের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বিষয় লিপি :-

শিরোনাম পাঠকের প্রতিশ্রুতি এবং প্রলেভসকে সন্তুষ্ট করে, আর কপি পণ্য বা সেবার বিক্রয়ের কাজটিকে সম্পূর্ণ করে। বিষয়লিপিতে পণ্যটি বিক্রি ও ব্যবহারের সমস্ত যুক্তি ও আবেদনকে তুলে ধরে। উৎসাহিত পাঠক সেই আবেদনে সারা দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করে।

ছবির ব্যবহার :-

বিজ্ঞাপনে দৃশ্যের ব্যাপারটা বেশি থাকায় বিভিন্ন ইলাশস্ট্রেশন, কার্টুন, গ্রাফিক্স ইত্যাদি ব্যবহার করলে বিজ্ঞাপণের গ্রহদযোগ্যতা অনেক বৃদ্ধি পায়। যেমন একটি মোবাইল পরিষেবা কোম্পানি ভোডাফোন তাদের বিজ্ঞাপদ প্রচারের জন্য একটি অদ্ভুত কার্টুন ব্যবহার করে।

লোগো :-

সাধারণত বিজ্ঞাপণ গঠনে লোগো বা প্রতীক খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসলে এই প্রতীকই ক্রেতার কাজে পরিচিতির সহায়ক হয়ে ওঠে। লোগো হল কোন একটি বিশেষ স্টাইলে লেখা অক্ষর বা অনন্য একটি প্রতীক। এই লোগো অনেক সময় ক্রেতাকে পণ্য চিনতে সাহায্য করে তাই বিজ্ঞাপণ গঠনে এর বিশেষ প্রাধান্য রয়েছে।

 

স্লোগান :-

বিজ্ঞাপণ গঠনে স্লোগানের ভূমিকা অনস্বিকার্য। স্লোগান হল কতকগুলি শব্দের সমষ্টি। এটি স্বল্প কথায় দ্রব্য ও তার উৎপাদকের গুণমাত্রকে প্রকাশ করে। এটা হল দ্রব্য ও তার পরিষেবা সম্পর্কে বিক্রয়যোগ্য যুক্তি। শ্লোগান হল আস-ক্যাচ ফেজ যা কোন দ্রব্য বা সেবার বিক্রির ধারণাকে যুক্ত করে।

বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা :-

বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা দুইটি ভাগে বিভক্ত।

প্রথমত :-

অর্থনৈতিক গুরুত্ব হিসেবে রয়েছে সামগ্রিকভাবে পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি। চাহিদা ও যোগানে সমতা সৃষ্টি, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, নতুন পণ্য উদ্ভাবন, প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ব্র্যান্ড অগ্রাধিকার ও আনুগত্য বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি, বিক্রেতাদের সহায়তা দান।

দ্বিতীয়ত :-

সামাজিক গুরুত্ব হিসেবে বলা হয় জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, রুচির বৈচিত্রায়ন, ক্রয়ের সুবিধা, মধ্যস্থব্যবসায়ীদের প্রভাব হ্রাস, শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও সামাজিক কল্যাণ।

বিজ্ঞাপণের উদ্দেশ্য :-

বিজ্ঞাপণের উদ্দেশ্য পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে শ্রোতা, পাঠক বা ক্রেতাদের তথ্য পৌঁছে দেওয়া কিন্তু আঙ্গিকগত কারণে বিজ্ঞাপণের ভিন্নতা দেখা যায়। বিজ্ঞাপণের গঠন বা স্বরূপ যাই হোক না কেন, প্রায় সব বিজ্ঞাপণেরই কিছু মৌলিক উদ্দেশ্য থাকে।

১ – চাহিদাকে উজ্জীবিত করা (Stimulate Demand) বিজ্ঞাপনের প্রধান উদ্দেশ্য। নির্দিষ্ট ক্রেতা বা ভোক্তাদের অন্তর্নিহিত চাহিদাকে উজ্জীবিত করা। কারণ অনেক সময় ক্রেতা বা ভোক্তাদের মনে চাহিদা সুপ্ত অবস্থায় বা অচেতন অবস্থায় থাকে । বিজ্ঞাপণের সাহায্যে তাকে জাগিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ বিজ্ঞাপণ সরাসরি চাহিদার সৃষ্টি করলেও পরোক্ষভাবে চাহিদা সৃষ্টিতেও সহায়তা করে।

২ – পরীক্ষামূলক ব্যবহারকে উৎসাহিত করা :

বিজ্ঞাপণের প্রধান উৎসই হল ব্যবহারকারীকে পণ্যাদি সম্পর্কে তথ্য দান করা। কোন পণ্য বা পরিষেবা যখন প্রথম বাজারে আসে তখন উৎপাদনকারী সংস্থা বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে ভোক্তাদের ঐ পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে।

৩ – পণ্য পরিষেবা বা ব্যবহারকে সুনিশ্চিত করা :-

ব্যবহারকারীরা পণ্যটির প্রতি যাতে বিশেষ আকর্ষণ বোধ করে তার জন্য বিজ্ঞাপণ পণ্য পরিষেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের উৎকর্ষতায় পণ্যটিকে পৌঁছে দেয়।

যেমন ‘ম্যাগি’ যখন প্রথমে বাজারে আসে তখন তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে উপযোগীতা বজায় রেখে পরবর্তীকালের বিজ্ঞাপণটি হয় সমস্ত গ্রাহকদের জন্য ‘Fast to cook: good to eat ফলে ম্যাগির বিক্রি অনেক বেড়ে যায়।

৪ – পণ্য ব্যবহারে উপযোগীতাকে সুনিশ্চিত করা :-

ব্যবহারকারীরা পণ্যটির প্রতি যাতে বিশেষ আকর্ষণ বোধ করে তার জন্য বিজ্ঞাপণের পণ্য পরিষেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের উৎকর্ষতা পণ্যটিকে পৌছে দেই।

বিজ্ঞাপণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য কোন পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহারকারীকে সেই পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে ভোক্তানের মনে ভাল ধারণা গড়ে ওঠে অর্থাৎ পণ্য বা পরিষেবার ব্যান্ড রয়্যালিটি বা ব্যান্ড ইমেজ তৈরী হয়। এই ব্যান্ড ইমেজ তৈরী করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যেমন :- Hoffman, Bata, Levis, Lakme, Koutons, Reebok।

৫ – বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে ইমেজ তৈরী হয় :-

বিজ্ঞাপণ দর্শক, পাঠক বা ভোক্তার মনে পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে একটা ভাবমুর্তি তৈরী করে, ফলে ক্রেতার মনে ঐ পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে একটা ভাবমূর্তি তৈরী হয়। বিজ্ঞাপণের এই ইতিবাচক দিকটি পণ্য বা পরিষেবার ইমেজ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

৬ – অভ্যাসের আচরণগত পরিবর্তন :-

পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহারে ভোক্তার আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আসা বিজ্ঞাপণের একটা প্রধান লক্ষ্য। কারণ বিজ্ঞাপণই কোন ভোক্তাকে উদ্দীপিত করতে পারে। সেই পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহারের জন্য।

৭ – তথ্য জ্ঞাপন করা :-

বর্তমানে প্রতিযোগীতার বাজারে কোন পণ্য বা পরিষেবা যখন প্রথম বালরে আসে তখন তার প্রধান লক্ষ্যই হয় ক্রেতার কাছে এক্সক্লসিভভাবে পণ্যটির পরিচয় ঘটানো। আবার কখনও কখনও কোন পণ্য বা পরিষেবা নতুনভাবে বাজারে এলেও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন তথ্যটি তুলে ধরা হয়।

 

৮ – ব্যবসায়ীদের তথ্য জানানো :-

বিজ্ঞাপণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে তথ্য ডিলার, মজুরদার এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে জানায়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওইসব মাধ্যমে ঐ পণ্য বা পারিষেবা পেয়ে থাকে। বিজ্ঞাপণ তাই সবসময় ব্যবসায়ীদের বিশেষজ্ঞ ডিলার এবং বিক্রেতাদের পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে তথ্য জানায়।

৯ – কর্পোরেট ইমেজ তৈরী করা :-

বিজ্ঞাপণ কোন প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট ইমেজ তৈরী করানোর চেষ্ঠা করে। তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বিজ্ঞাপণ কোন প্রতিষ্ঠানের ভিতরের ও বাইরের (Internal & External) পাবলিকানের প্রভাবিত করে। বিজ্ঞাপণ তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মার্কেটিং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়।