প্রশ্নঃ বিজয়গুপ্তের পরিচয় দাও৷
উত্তরঃ বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে মনসামঙ্গলের প্রাচীনতম অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশ নদী ও জঙ্গল মাতৃক। ফলে এদেশে সাপের প্রকোপ বরাবরই। সাপের হাত থেকে মুক্তি পেতে এদেশের মানুষ সর্পদেবী মনসার পূজা দিয়ে আসছে। তেমনি সর্পদেবীর প্রশস্তি করেছেন এদেশের অনেক কবিই। তাই মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত সর্প পূজার ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
মনসামঙ্গলের কাহিনীর মানবজীবনরসের প্রাচুর্য অসংখ্য কবিকে কাব্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ড. দীনেশচন্দ্র সেন বাষট্টি জন কবির কথা উল্লেখ করেছেন যারা মনসামঙ্গল কাব্য লিখেছেন। কিন্তু অনেকের পরিচয় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু বিজয়গুপ্ত তার কাব্যে নিজের জন্মস্থান ও সময়কাল সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনিই মনসামঙ্গল কাব্যের প্রথম কবি যিনি কাব্যে সুস্পষ্টভাবে সন তারিখ উল্লেখ করেছেন। কবি তার কাব্যে লিখেছেন-
মুল্লুক ফতেয়াবাদ বাঙ্গ বোড়া তকসিম।
পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূবে ঘণ্টেশ্বর।
মধ্যে ফুল্লশ্রী গ্রাম পণ্ডিত নগর।
স্থান গুণে যেই জন্মে সেই গুণময় ৷
হেন ফুল্লশ্রী গ্রামে নিবসে বিজয়।
কবির বর্ণনা থেকে স্পষ্ট আবিষ্কার করা যায় যে, তিনি বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কারণ গৈলার পূর্বনাম ছিল ফুল্লশ্রী। তাছাড়া এর পশ্চিমেই ঘাঘর নদী রয়েছে। কবির কাব্যের উল্লিখিত শ্লোক থেকে জানা যায় যে, তিনি গৌড়ীয় সুলতান হুসেন শাহের সময়ে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ) কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তার কাব্যের রচনাকাল ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ।
কাব্য বিচারে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য উচ্চস্তরের না হলেও তার কাব্য খুবই জনপ্রিয়তা পায়। ফলে তার কাব্যের কারণে পূর্ববর্তী কবিদের কাব্য ম্লান হয়ে পড়ে। তবে এটা ঠিক যে, তার কাব্যে ভাবপ্রবণতা অপেক্ষা বস্তু বিশ্লেষণ প্রবণতা বেশি ছিল। তাছাড়া তার কাব্যে কতকগুলো বিচ্ছিন্ন সামাজিক চিত্র রূপায়িত হয়েছে, যা তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের নিরিখে মূল্যবান।
তার কাব্যের নতুনত্ব এখানে যে, তার পরিকল্পিত দেবচরিত্র মানবচরিত্র রূপে চিত্রিত। কাহিনী পরিকল্পনার অভিনবত্বের সাথে সাথে ছন্দের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়েছে। উপমা প্রয়োগে তার অভিনবত্ব এখানে যে, তিনি অলঙ্কার শাস্ত্র অনুসারে উপমা প্রয়োগ না করে নিজের অভিজ্ঞতা অনুসারে উপমা দিয়েছেন। এসব কারণে বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যের কবিদের অন্যতম।
Leave a comment