বিচ্ছিন্নতার ধরন ও প্রকারভেদ

প্যারিস পাণ্ডুলিপি যা পরে Economical and philosophical manuscript নামে প্রকাশিত হয়েছিল তাতে মার্কস ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় চার ধরনের বিছিন্নতাকে চিহ্নিত করেছেন। এগুলি হলঃ 

  • (ক) নিজের উৎপাদিত বস্তুর থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা, 

  • (খ) উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা, 

  • (গ) নিজের প্রজাতি সত্ত্বা থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা এবং 

  • (ঘ) অন্যান্য শ্রমিকের থেকে বিচ্ছিন্নতা।

(ক) ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কি উৎপন্ন হবে, কতটা উৎপন্ন হবে, উৎপাদিত বস্তুর ধরন (design) কি হবে তার কোনটাই নির্ধারণ করার অধিকার শ্রমিকের থাকে না। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকের দৈহিক ও বৌদ্ধিক শ্রম দুটোই মালিক আত্মসাৎ করে ও উৎপাদিত বস্তু বা সেবা এমন দামে বিক্রি করে যাতে তার সর্বাধিক লাভ হয়। শ্রমিকের শ্রমকে ব্যবহার করা হয় এমন সব দ্রব্য বা বস্তু তৈরী করার জন্য যেগুলির বাজারে ভাল চাহিদা আছে বা যেগুলি ভাল বিনিময় মূল্য আনতে সক্ষম। ফলে এই ধরনের উৎপাদন থেকে শ্রমিক কোন উৎসাহ বা আনন্দ পায় না, সে এই উৎপাদিত বস্তু থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

(খ) ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় যে সব দ্রব্য ও সেবা উৎপন্ন হয় তা এতই যান্ত্রিক একঘেয়ে যে, শ্রমিকরা এই কাজ করে কোন মানসিক বা আত্মিক সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে না। এই কাজ করে তারা কোন মানসিক তৃপ্তিও পায় না। সমস্ত উৎপাদনই বাজারী পণ্যে পরিণত হবার কারণে শ্রমিকের শ্রম মজুরীতে পরিণত হয়। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকের মানসিক বিচ্ছিন্নতা আসে মূলত দুটি ক্ষেত্র থেকে— মজুরির বাধ্যতা ও দ্রব্য বা সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে তার অধীনতামূলক অবস্থান ও স্বাধীনতাহীনতা। শ্রমিক এই অবস্থায় তার অপছন্দের কাজে শ্রম দিতে বাধ্য হয় কারণ এর সঙ্গে শুধু তার নয়, তার পরিবারের অস্তিত্বও জড়িত। উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা বণিকশ্রেণীর হাতে থাকায় শ্রমিকরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে-কোন কাজ করতে বাধ্য হয়, তাদের পছন্দ হোক বা না হোক। মার্কস EPM-এর 74 পাতায় মন্তব্য করেছেন— শ্রমিক এই কাজে সন্তুষ্টি বোধ করে না, সে এর ফলে আরও অসুখী হয়ে পড়ে, তার শারীরিক ও মানসিক শক্তির স্বাধীন বিকাশ ঘটে না, যা হয় তা হল শ্রমিকের শরীর এর ফলে বাঁধা পড়ে যায় ও তার মন ধ্বংস হয়ে যায়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক মানসিকভাবে কাজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আর কাজ তার থেকে আলাদা হয়ে যায়। তিনি আরও বলেছেন, উৎপাদনের প্রতিটি বিষয় (পরিমাণ, ধরন) মালিকের নির্দেশে পরিচালিত হওয়ায় শ্রমিকরা ক্রমশই এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শ্রমিকরা মনে করে এই উৎপাদন ব্যবস্থা তাদের নয়, ফলে তারা এই উৎপাদন ব্যবস্থা, উৎপাদিত বস্তুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে শ্রমিকরা উৎপাদন ব্যবস্থার এক নিষ্ক্রিয় যন্ত্রে পরিণত হয়।

(গ) মানুষের শ্রম কখনই তার প্রজাতি সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রজাতি সত্ত্বা তার কর্মের মধ্যে দিয়েই আত্মপ্রকাশ করে। প্রজাতি সত্ত্বা শব্দ দুটির মধ্যে প্রজাতি শব্দটি মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক সত্ত্বাকে বোঝায় যেখানে মানুষের মধ্যে স্বার্থের বহুক্তৃতাবোধ ও মানসিক প্রগতি তাকে মানব প্রজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এরফলে মানুষ অন্যান্য মানুষ ও সমাজের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে। মানুষের মানসিক বৈশিষ্ট্য এমনই যে মানুষ তার কর্ম সম্পর্কে আগেই ধারণা করতে পারে এবং পরে সেই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রজাতির (জীবজন্তুর) এই ক্ষমতা নেই। কর্মী মানুষ বা শ্রমিক হল সচেতন সত্তা (subject) যে তার কর্মকে (object) নিজেই নির্ধারণ করতে পারে, এর ফলে সে এক সৃষ্টির আনন্দ লাভ করতে পারে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক সচেতন সত্ত্বা থেকে নিষ্ক্রিয় সত্ত্বায় পরিণত হয়, সে নিজ বা বৃহত্তর মানবপ্রজাতির কল্যাণের জন্য কোনো ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে না। ফলে সে সমগ্র মানব প্রজাতি ও নিজ প্রজাতি সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মার্কসের মতে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় যখন উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদন সম্পর্কগুলি নতুনভাবে বিন্যস্ত হবে, যখন উৎপাদনের উপকরণের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক হবে সমতার ও অ-বিরোধিতার, যখন শ্রমিকের শ্রম মূল্যের ক্ষেত্রে কোনরকম কৃত্রিম বিভাজন থাকবে না, যখন শ্রমিকের শ্রমের প্রকৃত মালিক হবে শ্রমিকরাই, একমাত্র তখনই বিচ্ছিন্নতার সমস্যাটিকে চিরতরে সমাধান করা যাবে।

(ঘ) ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা শুধুমাত্র যে শ্রমিককে তার উৎপাদিত বস্তুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে বা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাই নয়, শ্রমিককে অন্যান্য শ্রমিকদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকের শ্রম ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয়, যাকে ব্যবহার করে মালিকশ্রেণী তাদের মুনাফাকে বহুগুণে বর্ধিত করে। এই শ্রম কোন সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহৃত হয় না, ফলে এর থেকে শ্রমিকের নিজের ও বৃহত্তর মানবসমাজের কোন উপকারই হয় না। আবার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন সম্পর্ক সামাজিক ঐক্য বা সংহতিকে বিপন্ন করে তোলে, এর ফলে সামাজিক ঐক্যের পরিবর্তে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্ধিত মজুরীর লোভ দেখিয়ে শ্রমিকদের একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়, এরফলে শ্রমিকরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সাধারণভাবে যে উৎপাদন প্রক্রিয়া তাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে বা একে অপরের সমব্যথী করে তোলে তা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ক শ্রমিককে বেশী মজুরীর লোভ দেখিয়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে ফলে তাদের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতা শ্রমিককে মানসিকভাবে অসুখী ও একাকী করে তোলে।