নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ছাড়া সভ্য ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অসম্ভব। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অনুমান হিসাবে বিচারব্যবস্থা ও বিচারপতিদের নির্ভীকতা ও নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়। নিরপেক্ষ ও নির্ভীক বিচারব্যবস্থা নাগরিক স্বাধীনতা, আইনের অনুশাসন; সর্বোপরি উদারনীতিক গণতন্ত্রের স্বার্থে অপরিহার্য বিবেচিত হয়। তা ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার জন্যও নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী বিচার-বিভাগ দরকার। আবার বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রকে বোঝায়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে। তাই এখনকার প্রতিনিধিমূলক গণতে মন্যতম স্বীকৃত মূলনীতি হল সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিধান। বিখ্যাত দার্শনিক রাসেল বলেছেন: “The safe guarding of minorities so far as it is compatible with •orderly government is an essential part of the taming of power.” আবার নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার জন্য বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক। বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় যে, বিচারপতিগণ সকল রকম রাজনীতিক, শাসন-বিভাগীয় এবং আইন-বিভাগীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্ভীকভাবে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা অনুসারে বিরোধের নিষ্পত্তি করবেন।
বিচার-বিভাগের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা
উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সমাজব্যবস্থার প্রধানতম স্তম্ভ হিসাবে গণ্য করা হয়। ন্যায়বিচার করা বিচার-বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ছাড়া ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। আবার স্বাধীনতা ছাড়া বিচার-বিভাগ নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারে না। বস্তুতপক্ষে বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা পরস্পরের পরিপূরক। বিচার বিভাগের উপর আইন বা শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব কার্যকর হলে পক্ষপাতহীন ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। তাই ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। তাছাড়া গণতন্ত্রের সাফল্য বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও উৎকর্ষের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। লর্ড ব্রাইস-এর মতানুসারে সরকারের উৎকর্ষ বিচারের ক্ষেত্রে বিচার-বিভাগের কর্মকুশলতা অপেক্ষা অধিকতর উপযোগী মানদণ্ড আর নেই। রাষ্ট্রে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন। নির্ভীক, নিরপেক্ষ এবং সৎ ও অভিজ্ঞ বিচারপতিরাই সংকীর্ণ ব্যক্তি বা শ্রেণীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। গোখেল-এর মতানুসারে বিচারকগণ দুর্নীতিপরায়ণ ও বিকৃত মনোভাবাপন্ন হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হতে বাধ্য। এই সমস্ত কারণে বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সংরক্ষণ নিতান্তই আবশ্যক। আর বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা কতকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।
(১) বিচারপতিদের যোগ্যতা
সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত বিচারপতি একান্তভাবে দরকার। দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে সৎ, সাহসী ও যথার্থ আইনজ্ঞ ব্যক্তিগণ বিচারপতিদের পদে আসীন হলে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে প্রার্থীদের গুণগত যোগ্যতা সতর্কভাবে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। বিচারপতিগণ অবশ্যই বিজ্ঞ, স্বাধীনচেতা ও নিরপেক্ষ হবেন। শাসন-বিভাগের কোন ব্যক্তিকে বিচারক পদে নিযুক্ত করা উচিত নয়। কোন রকম কূটনীতিক বিচারে বা দলীয় আনুগত্যের কারণে বিচারপতিদের নিয়োগ করা বাঞ্ছনীয় নয়। অযোগ্য ব্যক্তি রাজনীতিক কারণে বিচারক হিসাবে নিযুক্ত হলে ন্যায়বিচার পদদলিত হতে বাধ্য। তেমনি বিচারপতিদেরও কোন রাজনীতিক পদে নিযুক্ত করা অনুচিত। কারণ, এরকম পদ লাভের আশায় বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিচারপতিগণ শাসন-বিভাগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন।
বিচারব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ব্যাপারে বিচারপতিদেরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে হবে। বিচার-বিভাগের প্রক্রিয়া বিচারপতিদের মাধ্যমেই মূর্ত হয়ে উঠে। এই কারণে বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার স্বার্থে বিচার-বিভাগীয় কাঠামোগত বিন্যাসের উপর জোর দেওয়া দরকার।
(২) বিচারপতিদের নিয়োগ
বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিয়োগপদ্ধতির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিচারপতিদের সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে নিয়োগ করা যায়:
-
(ক) জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচন,
-
(খ) আইনসভা কর্তৃক মনোনয়ন এবং
-
(গ) শাসন-বিভাগ কর্তৃক নিয়োগ।
(ক) জনগণের দ্বারা নির্বাচন: জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এবং সুইজারল্যাণ্ডের কয়েকটি ক্যান্টনে প্রচলিত আছে। তবে এই পদ্ধতি বিভিন্ন দোষে দুষ্ট। জনগণের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ ল্যাস্কির মতে একটি নিকৃষ্ট পদ্ধতি। (১) নির্বাচনের সাফল্য যোগ্যতা অপেক্ষা জনপ্রিয়তার উপর অধিক নির্ভরশীল। আবার মিথ্যা ও অপপ্রচারের দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়। এতে অযোগ্য ব্যক্তির বিচারক হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। (২) জনগণের দ্বারা বিচারক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে বিচারকগণ জনসমর্থন লাভের আশায় সতত জনসাধারণের সন্তুষ্টি বিধানে আত্মনিয়োগ করবেন। তাঁরা পুনর্নির্বাচনকে সুনিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে ন্যায়-নীতিকে বিসর্জন দিতেও পিছপা হবেন না। (৩) তাছাড়া নির্বাচনে দলপ্রথার প্রভাব পড়বেই। তার ফলে নির্বাচিত বিচারক দলীয় স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারেন। এরূপ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও সুবিচার আশা করা যায় না। (৪) সর্বোপরি, বিচারপতি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাই করার জন্য প্রয়োজনীয় বিচার-বুদ্ধি বা যোগ্যতা জনসাধারণের থাকে না। এই সমস্ত কারণের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ ল্যাস্কির মতানুসারে একটি নিকৃষ্ট পদ্ধতি (“Of all the methods of appointment, that of election by the people at large is without exception the worst.”)।
(খ) আইনসভার দ্বারা নির্বাচন: আইনসভার দ্বারাও বিচারপতি নিয়োগ করা যায়। আইনসভার দ্বারা বিচারপতি নিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এবং সুইজারল্যাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। তা ছাড়া বলিভিয়া, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া ও যুগোশ্লাভিয়ার বিচারপতিরা আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন। ল্যাস্কি এই পদ্ধতিকেও সমর্থন করেননি। তাঁর কথায় “Election by the legislature is an undesirable form of appointment.” এর ফলে দলীয় স্বার্থ ও আইনসভার কর্তৃত্ব প্রাধান্য পায় এবং বিচারের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এই পদ্ধতিতে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত ব্যক্তিরাই বিচারপতি পদে নির্বাচিত হন। অর্থাৎ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিজ দলের সভ্য-সমর্থকদের ভিতর থেকে বিচারক নির্বাচিত করেন। এই সবের ফলে বিচারপতি পদে অযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার এবং ন্যায়বিচার পদদলিত হওয়ার আশংকা থাকে।
(গ) শাসন-বিভাগের দ্বারা নির্বাচন: বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শাসন-বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিটি প্রচলিত আছে। শাসন-বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের তৃতীয় পদ্ধতিটিই বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে কাম্য বিবেচিত হয়। বলা হয় যে এইভাবে বিচারপতিরা নিযুক্ত হলে রাজনীতিক দল, গোষ্ঠী বা জনমতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ন্যায়বিচার সম্পাদন করতে পারেন। ঊর্ধ্বতন বিচারপতিদের সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ করেন। অধস্তন বিচারপতিগণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার দ্বারা নিযুক্ত হন। ঊর্ধ্বতন বিচারকগণ সাধারণত বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নিযুক্ত হন। ভারতের রাষ্ট্রপতি সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরামর্শ করেন। ভারত, ব্রিটেন ও কানাডায় শাসন-বিভাগের বিচারকগণ নিযুক্ত হন। ল্যাস্কির মতানুসারে বিচারকদের নিয়ে গঠিত একটি স্থায়ী কমিটির সম্মতিসাপেক্ষে বিচারপতিদের নিযুক্ত করা উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত বিভিন্ন দেশে বিচারপতিদের নিয়োগ রাজনীতিক বিচার-বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
গেটেলও এই পদ্ধতিকে সমর্থন করেছেন। তবে তিনি সতর্কতামূলক কয়েকটি শর্তের কথা বলেছেন। শর্তগুলি হল: বিচারকদের যোগ্যতার সুনির্দিষ্ট মান, বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শদানের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বতন আদালতের কয়েকজন বিচারপতিকে নিয়ে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কোন প্রশাসনিক বা কূটনীতিক পদ লাভের সম্ভাবনা রদকরণ।
(৩) বিচারকগণের কার্যকাল
বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্বের উপরও বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কার্যকালের স্থায়িত্ব না থাকলে নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারকার্য সম্পাদন করা বিচারকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার কার্যকাল স্বল্পস্থায়ী হলে বিচারপতিদের পদের অপব্যবহারের আশংকা থাকে। কার্যকাল বৃদ্ধির জন্য বিচারপতিদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী দেখা যায়। এর ফলে বিচারকার্যে অবহেলা ঘটে ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। বিচারপতিদের কার্যকাল স্থায়ী হলে তাঁরা নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে ন্যায় বিচার করতে পারেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার জন্য বিচারপতিদের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত স্থায়িভাবে নিযুক্ত করা উচিত, যাতে তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অক্ষমতার অভিযোগ প্রমাণিত না হলে পদচ্যুত করা না যায়। এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রেই বিচারপতিদের কার্যকালের ব্যাপারে এই নীতি অনুসরণ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারপতিরা অক্ষম হয়ে না পড়লে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন। ভারতে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিরা ৬৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত এবং হাইকোর্টের বিচারপতিরা ৬২ বৎসর বয়স পর্যন্ত পদে আসীন থাকেন।
(৪) বিচারকগণের অপসারণ
বিচারকগণের অপসারণ পদ্ধতির উপরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভরশীল। অকারণে বা সামান্য কারণে অপসারণের ভয় বা আশংকা থাকলে বিচারকদের পক্ষে ন্যায় বিচার করা সম্ভব হয় না। তাই কোন বিচারককে যাতে সামান্য কারণে পদচ্যুত হতে না হয় তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রমাণিত দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই বিচারপতিগণ পদচ্যুত হতে পারেন। তবে সহজে তাঁদের পদচ্যুত করা যায় না। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অক্ষমতার অভিযোগের বিচার সাধারণত আইনসভায় সম্পাদিত করা যায় না। এ ব্যাপারে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হল যাতে অন্য কোন চাপ এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহাঅভিযোগের (impeachment) বিচার পদ্ধতিতে বিচারপতিদের পদচ্যুত করা যায়। মার্কিন কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধি সভা অভিযোগ উত্থাপন করে এবং সিনেট অভিযোগের বিচার করে। ভারতে রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষের মোট সদস্যের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে অভিযুক্ত কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে পদচ্যুত করতে পারেন। ব্রিটেনে রাজা বা রানী পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে বিচারকদের পদচ্যুত করতে পারেন।
(৫) বিচারকগণের বেতন ও ভাতা
বিচার-বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে বিচারকদের বেতন এবং ভাতারও সম্পর্ক আছে। স্বল্পবেতনভোগী বিচারপতিদের দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার আশংকা থাকে। শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক পদে আকৃষ্ট করার জন্য বিচারপতিদের বেতন পর্যাপ্ত হওয়া দরকার। পর্যাপ্ত বেতন ও ভাতা না দিলে কোন অভিজ্ঞ ব্যবহারজীবী বা আইনজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি বিচারক হিসাবে কাজ করতে রাজী হবেন না। তা ছাড়া, তাঁদের বেতন ও ভাতা পদমর্যাদা রক্ষার উপযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা সম্পর্কিত কোন বিষয় শাসন-বিভাগের অনুমতিসাপেক্ষ হওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যয় সরকারী তহবিলের উপর ধার্য ব্যয় হিসাবে গণ্য হওয়া আবশ্যক। আবার জরুরী অবস্থার সময় ছাড়া সহসা বিচারপতিদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে তাঁদের বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তন করা উচিত নয়। তবে জরুরী অবস্থার সময় তা করা যেতে পারে।
(৬) বিচার-বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ
বিচার-বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আইন ও শাসন-বিভাগ থেকে তার স্বতন্ত্রীকরণ অপরিহার্য। প্রাচীনকালে রাজা বা রাজকর্মচারীরাই আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। আগে শাসনকার্য ও বিচারকার্যের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হত না। এই ব্যবস্থা স্বৈরাচারের সুযোগ করে দেয়। ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। বর্তমানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আংশিক প্রয়োগ বলতে এই বিচার-বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণকে বোঝায়। ল্যাস্কির মতানুসারে শাসকের হাতে বিচারের ভার ন্যস্ত থাকলে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। এরকম ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগ সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “The independence of the judiciary is essential to freedom. In that sense, the doctrine of separation of powers enshrines a permanent truth.” বিচার-বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য অধিকাংশ দেশে শাসন-বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছে বা হচ্ছে।
(৭) বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি
বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণীচেতনার উপর বিচার-বিভাগের নিরপেক্ষতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিচারকদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান, আর্থনীতিক ও শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট, রাজনীতিক চেতনা প্রভৃতির ছাপ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর পড়ে। বিচারকদের শ্রেণীচরিত্রের দ্বারা তাঁদের সামাজিক ও রাজনীতিক অঙ্গীকার, মানসিক গঠন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। বিচারপতিরাও হলেন এই সমাজেরই সদস্য। এই কারণে তাঁদের সামাজিক চেতনা তাঁদের সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবিত হয়। সমাজবদ্ধ মানুষ হিসাবে বিচারপতিরা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতি সাধারণত অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন। এই সামাজিক অবস্থানজনিত কারণের জন্য বিচারপতিদের মূল্যবোধ, মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিচারপতিরাও মানুষ, ভিন্ন গ্রহের দেবতা নন। সুতরাং মানুষের দোষ ত্রুটি থেকে তাঁরা মুক্ত নন। Introductions to Political Science শীর্ষক গ্রন্থে রোডী, অ্যাণ্ডারসন ও ক্রিস্টল মন্তব্য করেছেন: “. where the greatest care is taken in democracies to secure the service of… impartial judges, the human element creeps inevitably into the judicial process.” সুতরাং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিচারপতিদেরও প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
বিচার বিভাগের পর্যালোচনা –
আদালত অ-রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান নয়: উপরিউক্ত উপায়সমূহের মাধ্যমে মোটামুটিভাবে বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই সমস্ত ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে বিচারব্যবস্থা সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রদর্শন নিরপেক্ষ হতে পারে না। বিচারপতিগণ সাধারণত রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অনুসারে পরিচালিত হন। বিচার বিভাগ বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনীতিক প্রক্রিয়ার অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই কারণে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর প্রকৃতির উপর বিচার বিভাগের চরিত্র বহুলাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং বিচার-বিভাগ রাজনীতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। আদালতকে একটি অ-রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন করা অর্থহীন। এবং আদালতের কাজ থেকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করা অমূলক। বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা দেশের প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার কাঠামো ও চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। কারণ সমাজের স্বরূপ ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য অনুসারে আইন প্রণীত হয় এবং বিচারপতিগণ সেই আইন প্রয়োগ করেন। বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার রাষ্ট্রযন্ত্রের মত বিচার-বিভাগও শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। শ্রেণীবিভক্ত বৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামোতে আইন প্রতিপত্তিশালী শাসকশ্রেণীর স্বার্থের প্রতিফলন মাত্র। বিচারপতিরা বুর্জোয়া সমাজের নিরপেক্ষতার খোলস নিয়ে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের ভূমিকা গ্রহণ করে। আবার বিচারপতিগণ তাঁদের শিক্ষাক্রম, শ্রেণী চরিত্র প্রভৃতির প্রভাবকেও উপেক্ষা করতে পারেন না।
বিচারপতিদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা: তাছাড়া বিচারপতিদের সামাজিক অবস্থান ও অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত পটভূমি, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও মতাদর্শ বিচার-বিভাগের নিরপেক্ষতার পথে অন্যতম বড় বাধা হিসাবে বিবেচিত হয়। বিচারপতিরা বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে সদা সর্বদা প্রখর যুক্তি ও আইনের নির্দেশের প্রতি অনুগত থাকেন, তা বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উপাদানের প্রভাবও অনস্বীকার্য। ব্যক্তিগত মতাদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার, পূর্ব-কল্পিত ধ্যান-ধারণা প্রভৃতির দ্বারা বিচারপতিরা কার্যক্ষেত্রে প্রভাবিত হন। এবং তার ফলে তাঁরা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন। এ কথা ঠিক নয় যে বিচারপতিরা নিছক বিচার বিভাগীয় নজির ও আইনানুগ যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হন। এক্ষেত্রে বিচারপতিদের আর্থ-সামাজিক পটভূমি ও মতাদর্শগত অঙ্গীকারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে মনে করা হয় যে, কোন মামলা বিচারের ক্ষেত্রে বিচারপতিরা আগেভাগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন। তারপর তাঁরা আইনের যুক্তি ও বিচার-বিভাগীয় নজিরের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন গ্রহণ করেন।
সমাজতন্ত্রে ন্যায়বিচার: বস্তুতপক্ষে একমাত্র পরিপূর্ণ সাম্যের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজেই বিচারকগণের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ন্যায়বিচার সম্পাদন করা সম্ভবপর। কেবল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-শোষণ থাকে না। এবং সমগ্র জনসাধারণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হিসাবে আইনের সৃষ্টি হয়। মেহনতী মানুষের স্বার্থের অনুকূলে এবং সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তার সম্পর্ক অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক আইন প্রণীত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে বিচার-বিভাগ জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে বিচারকার্য পরিচালনা করে।
Leave a comment