সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসাবে বিচার বিভাগের কাজ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বল-এর মতানুসারে যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের কাজকর্মের পরিধি বিশেষীকরণের মাত্রার (degree of specialisation) উপর নির্ভর করে। Modern Politics and Government গ্রন্থে বল বলেছেন: “The courts will have various functions to perform in the political system depending on the degree of specialisation involved.” আবার যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় বিচার-বিভাগের কাজের পরিমাণ একরকম হয় না। আধুনির রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিচার-বিভাগের ভূমিকা বিভিন্ন হয়ে থাকে। দেশের বিদ্যমান রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিচার বিভাগ অপরিহার্যভাবে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। সরকারের বিভিন্ন কাঠামোর সঙ্গে বিচার-বিভাগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক বর্তমান থাকে। আবার রাজনীতিক ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেও বিচার-বিভাগের ওতপ্রোত সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। এই সমস্ত কারণের জন্য বিচার-বিভাগের কার্যাবলীর মধ্যে রাজনীতিক প্রভাব কার্যপ্রক্রিয়ার অনুপ্রবেশ আটকান যায় না। বস্তুত বিচার-বিভাগের কার্যাবলী রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি অনুসারে নির্ধারিত হয়।
বিচার বিভাগের কার্যাবলী সম্পর্কিত সাধারণ ও সাংবিধানিক আদালতের কার্যাবলী
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিচার বিভাগের কার্যাবলী সম্পর্কিত আধুনিক আলোচনা পৃথক প্রকৃতির। এ বিষয়ে সাবেকি চিন্তাধারা প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয় না। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সাবেকি চিন্তাধারা অনুসারে বিচার বিভাগের কার্যাবলী পর্যালোচনার পক্ষপাতী নন। সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বিচার-বিভাগের দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা বিচার-সম্পর্কিত কার্যাবলীর কথা বলা হয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর দেন না। কারণ নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও অন্যান্য বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরা পড়ে না। বস্তুত বিচার-বিভাগের কার্যাবলীকে দুটি দিক থেকে দেখা যায়। এই দুটি দিক হল:
-
(ক) সাধারণভাবে বিচার বিভাগের কার্যাবলী ও
-
(খ) শাসনতান্ত্রিক আদালতের (constitutional courts) কার্যাবলী।
বিচার বিভাগের কার্যাবলী সম্পর্কিত বলের অভিমত
বল বিচার-বিভাগের সাংবিধানিক দায়-দায়িত্বের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: “We will therefore concentrate on the functions of the constitutional courts, or on the constitutional functions of courts in systems where legal specialisation has not developed in this way.” বিচার বিভাগের কাজকে অ্যালান বল মূল চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলি হল:
-
(ক) বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত কাজ (judicial review and interpretation of the constitution),
-
(খ) রাজনীতিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি সম্পর্কিত কাজ (arbitration between separate institutions in the political process),
-
(গ) বর্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি সমর্থনমূলক কাজ (general support for the existing political system) এবং
-
(ঘ) ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কিত কাজ (protection of individual rights)।
(ক) বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা
বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষার অধিকার: বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষা (Judicial Review) আদালতের একটি বড় দায়িত্ব ও ক্ষমতা। এই ক্ষমতাবলে বিচার-বিভাগ সংবিধানের বিরোধী যে কোন আইন ও সরকারী সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিকতার অভিযোগে বাতিল করে দিতে পারে। আইন-বিভাগ যদি এমন কোন আইন প্রণয়ন করে বা শাসন-বিভাগ এমন কোন আদেশ জারি করে যা সংবিধানের কোন ধারার বিরোধী, তা হলে সেই আইন বা আদেশকে বাতিল করার যে ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে আছে তাকে বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষার অধিকার (Power of Judicial Review) বলে। এই ক্ষমতার মাধ্যমে বিচার-বিভাগ সংবিধানের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসাবে কাজ করে। সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার-বিভাগ কোন আইনের বৈধতাও বিচার করে দেখতে পারে।
বৈধতা বিচার: সংবিধানের সঙ্গে আইনসভার আইন বা শাসন-বিভাগের আদেশ-নির্দেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা বিচার-বিভাগ তা বিচার করে দেখে। সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে সংশ্লিষ্ট আইন বা আদেশ-নির্দেশকে আদালত সংবিধান-বিরোধী বলে ঘোষণা করে। এবং সেক্ষেত্রে সেই আইন বা আদেশ-নির্দেশ বাতিল বলে বিবেচিত হয়। কোন মামলার সঙ্গে আইনের ব্যাখ্যা সম্পর্কযুক্ত থাকলে আইনের প্রকৃতি প্রসঙ্গে আদালত তার অভিমত ব্যক্ত করে। আইনের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে আদালত আইন ব্যাখ্যা করে থাকে। আইনের বৈধতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন দেখা দিলে আদালত আইনের বৈধতা বিচার করে থাকে। আদালত আইনের বৈধতা বিচারের মাধ্যমে বিচার্য আইনকে অ-সাংবিধানিক বা সংবিধান-বিরোধী বলে ঘোষণা করতে পারে। বৈধতা বিচারের এই ক্ষমতার অধিকারী হল আদালত। আদালতের এই ক্ষমতা নিছক আইনগত সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আর্থ-সামাজিক বা রাজনীতিক সমস্যাদি বা প্রশ্নের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও আদালত বৈধতা বিচারের ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।
বিচারপতিদের রাজনীতিক চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা আদালতের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা প্রভাবিত হয়। বৈধতা বিচারের ক্ষমতার প্রয়োগ আদালতকে একটি অত্যধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আইনসভায় (super legislature) রূপান্তরিত করে। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। আইনের বৈধতা বিচারের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় বিচার-বিভাগীয় স্বৈরাচারের বিপদকে রদ করা যাবে না।
সকল দেশের আদালত আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতার অধিকারী নয়। সকল দেশের সংবিধানে আদালতকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। যে সমস্ত সংবিধানে আদালতকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ক্ষমতার পরিধি ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। অর্থাৎ সকল রাজনীতিক ব্যবস্থায় আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা আদালতকে দেওয়া হয়নি; আবার দেওয়া হলেও সমানভাবে দেওয়া হয়নি।
সংবিধানের ব্যাখ্যা: আদালতের সংবিধান ব্যাখ্যা করার ক্ষমতাও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেই আদালত একাধারে সংবিধানের আসল উদ্দেশ্য ও যাবতীয় বক্তব্যকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। আবার আদালত সংবিধানের রচয়িতাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সংরক্ষণের চেষ্টা করে। তা ছাড়া সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা আর একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংবিধানের অনমনীয়তাকে আদালত অপসারিত করে এবং এইভাবে সমাজের পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংবিধানের সামঞ্জস্য সাধন করে। আদালতের এই ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সতত পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী থাকে। আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতার মত সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষমতাও আদালত সকল দেশে সমানভাবে প্রয়োগ করতে পারে না।
ব্রিটিশ আদালত: গ্রেট ব্রিটেনে আইনের বৈধতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করার ক্ষমতা আদালতের নেই। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হল সার্বভৌম। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা অবাধ ও চূড়ান্ত। তা ছাড়া গ্রেট ব্রিটেনে কোন লিখিত সংবিধান নেই। এই কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত কোন আইনকে আদালত অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করতে বা বাতিল করতে পারে না। গ্রেট ব্রিটেনে বিচার বিভাগ পার্লামেন্টের অভিমত অনুসারে আইন ব্যাখ্যা করে। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “In Britain the legal sovereignty of parliament and the absence of a codified written constitution force the courts to construe acts of parliament with the intentions of the framers of the legislation as the paramount considerations.”
মার্কিন আদালত: মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট এক্ষেত্রে সর্বাধিক ক্ষমতাযুক্ত। মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মার্শাল (Marshal) মারবারী বনাম ম্যাডিসন (Marbury Vs. Madison) মামলায় যে ঐতিহাসিক রায় দেন তা থেকেই বিচার বিভাগের এই ক্ষমতার সৃষ্টি হয়েছে। অ্যালান বল বলেছেন: “The famous case of Marbury V. Madison in 1803 established the Courts right to declare a law void if it is in opposition to the American constitution as interpreted by the Court.” মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট আইনের যথাবিহিত পদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে আইনের সাংবিধানিকতা ব্যাখ্যার ব্যাপারে ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের এই ক্ষমতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সংবিধান আছে। কিন্তু এই সংবিধানের অর্থ বিচারপতিদের ব্যাখ্যা অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিচারপতিরা যা বলেন সেটাই হল সংবিধান। যে কোন দেশে আইনের সাংবিধানিকতা বিচার প্রভুত্বকারী রাজনীতিক স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় প্রাধান্যকারী শক্তির স্বার্থের অনুকূলে মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট আইন ও সংবিধান ব্যাখ্যা করে থাকে। বল বলেছেন: “Generally the Court has reflected the dominant forces in the American political process, and the right of judicial review did not oke serious contradictions within the system until the 1930s…”
পশ্চিম জার্মানীর আদালত: পশ্চিম জার্মানীর ১৯৪৯ সালের সংবিধানে আইনের সাংবিধানিকতা বিচার করার ক্ষেত্রে আদালতকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। পশ্চিম জার্মানীর যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক আদালত এ ক্ষেত্রে বহুলাংশে মার্কিন মডেলের সমপর্যায়ভুক্ত। বল বলেছেন: “The Federal Constitutional Court of West Germany is the nearest equivalent to the American model among European states. ১৯৪৯ সালের সংবিধানে বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষা (judicial review)-র ব্যাপক ক্ষমতা স্বীকার করা হয়েছে। ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের (Weimar Republic) ভাগ্যের হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রকে (Federal Republic) রক্ষা করার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই সুযোগ গ্রহণ করে সংবিধান লঙ্ঘন না করেও হিটলারের উত্থান সম্ভব হয়েছিল। দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দলগুলি সম্পর্কে এই ক্ষমতা অবাধে প্রয়োগ করা হয়েছে।
ইতালী এবং অস্ট্রিয়াতেও আইনের সাংবিধানিকতা পর্যালোচনার ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই দুটি দেশের সুপ্রীম কোর্টের বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষার ক্ষমতা পশ্চিম জার্মানীর যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক আদালতের সমপর্যায়ভুক্ত নয়। বল বলেছেন: “Powers of the judicial review have been granted to the Supreme Courts of Italy and Austria for similar historical reasons, but these courts lack the wide powers of the West German court.”
ফ্রান্সে বিচার-বিভাগীয় সমীক্ষার ব্যবস্থা দুর্বল। বল বলেছেন: “The strengthening of the French Constitutional Council in 1958…marked a father move away from a republic dominated by the National Assembly, but its powers of judicial review are seriously limited by the necessity for the initiative to consider the constitutionality of legislation to come from other organs of government.” দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনের সাংবিধানিকতা বিচারের ক্ষমতা আপীল আদালতের উপর ন্যস্ত আছে।
(খ) রাজনীতিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি
বিচার-বিভাগ বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের মীমাংসাও করে থাকে। সাংবিধানিক উপায়ে বা সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার-বিভাগই এই সব বিরোধের মীমাংসা করে। প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকে। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আবার শাসন বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে বিরোধ বাধতে পারে। অনুরূপভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যেও বিরোধ বাধতে পারে। সাংবিধানিক আদালত এই ধরনের বিরোধ মীমাংসা করে। এবং সাংবিধানিক আদালতের এই দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “All constitutional courts have the important function of arbitrating between various political institutions, whether between federal and provincial governments or between executives and assemblies.”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্ট সক্রিয় ও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের এই ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ম্যাচ বনাম ম্যারিল্যাণ্ড [McCulloch Vs. Maryland (1821)] মামলায় সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের কথা বলা হয়।
পশ্চিম জার্মানীর যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক আদালত (Federal Constitutional Court)-এর ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে এই আদালতের অর্থবহ ভূমিকার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বল সংশ্লিষ্ট আদালতের ১৯৫৮ সালে প্রদত্ত একটি মামলার রায়ের কথা বলেছেন।
শাসন-বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা ও সাংবিধানিক আদালত: অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে এ কথা ঠিক নয় যে, সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত সব সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করেছে। এ ধারণাও সঠিক নয় যে, শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আদালত শাসন-বিভাগের অনুকূলে রায় দেয়। এ প্রসঙ্গে মার্কিন সাংবিধানিক ইতিহাসের ১৯৭৪ সালের একটি ঘটনাকে নজির হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনায় মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট ‘শাসন-বিভাগীয় বিশেষাধিকার’ (executive privilege)-এর ধারণার ভিত্তিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতির সীমাহীন ক্ষমতার দাবিকে সীমাবদ্ধ করেছে। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারী মামলায় (১৯৭৪) মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট রাষ্ট্রপতি নিকসনকে কংগ্রেসের সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কমিটির কাছে কেলেঙ্কারীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত টেপ-রেকর্ড পেশ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর একটি সাধারণ ধারা হল শাসন-বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শাসন-বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর সম্প্রসারণ আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল প্রকৃতির যাবতীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারকে না দিয়ে জাতীয় সরকারকে দেওয়া হয়। সাংবিধানিক আদালত হল সমকালীন রাজনীতিক ব্যবস্থা ও পদ্ধতির অন্যতম অংশীদার। সেই সুবাদে সাংবিধানিক আদালতও শাসন-বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতাকে প্রতিফলিত করেছে। বল বলেছেন: “…the movement in the twentieth century has been towards stronger and more complex functions being given to national government, constitutional courts, as part of the political process, have tended to reflect this movement.”
(গ) বর্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন:
বিচার-বিভাগ হল দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি অঙ্গ বিশেষ। এই কারণে বিচার-বিভাগ দেশের বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ও সংরক্ষণ করে। বিচার-বিভাগ অনেক ক্ষেত্রে সরকারী নীতি ও কার্যাবলীকে বৈধ ঘোষণা করে এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। অর্থাৎ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা প্রতিষ্ঠা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাকে সমর্থন ও তার স্থিতিশীলতা সংরক্ষণ সাংবিধানিক আদালতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “…constitutional courts are performing one of their most important functions, that of stabilising and supporting the existing political system.” সাংবিধানিক আদালতের এই কাজ হল ব্যবস্থা সংরক্ষণমূলক কাজ।
সাংবিধানিক আদালতের এই দায়িত্ব সম্পাদনের বিষয়টি কতটা অপরিহার্য, তা বহুলাংশে নির্ভর করে, যে রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে আদালত কাজ করে তার উপর। সরকারের কাঠামো ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পশ্চিম জার্মানী এবং ইতালীতে সাধারণ মতৈক্যের অনস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে এই দুটি দেশে এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আদালতের ভূমিকার রাজনীতিক তাৎপর্য অত্যন্ত বেশী। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনে এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সহমতের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে ব্রিটেনে সাংবিধানিক আদালতের এই ভূমিকা ততটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয় না।
আদালত বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ও স্থিতিশীলতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কর্তব্য সম্পাদন করে গেলে তার বৈধতা সম্পর্কে কোন রকম বিতর্কের সৃষ্টি হয় না। অন্যথায় সংবিধানের বৈধতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট ১৯৩৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের ‘নিউ ডিল’-এর বিরোধিতা করে। সুপ্রীম কোর্টের এই বিরোধিতাকে অতিক্রম করার জন্য রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট সুপ্রীম কোর্টের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। কিন্তু তাঁর এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার পক্ষে এই উদ্যোগ বিপজ্জনক প্রতিপন্ন হয়। বল বলেছেন: “The court showed its political sensitivity by changing the policy that had given rise to the conflict.” বল আরও বলেছেন: “Thus in spite of the court’s involvement in political decision making, it is necessary to stress their political impartiality and to increase the respect given to the decisions of the courts.”.
সাংবিধানিক আদালত সরকারের সিদ্ধান্তসমূহকে বৈধকরণের দায়িত্ব সম্পাদন করে। এটি আদালতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “The courts are an important aspect of legitimising the outputs of governments, …” এই প্রসঙ্গে বলা হয় যে, আদালত রক্ষণশীল মতামতকে প্রতিফলিত করে থাকে। এবং এ হল আদালতের একটি প্রয়োজনীয় ও ঔচিত্যযুক্ত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, আদালতের ভূমিকা গণতন্ত্র-বিরোধী বা আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে মর্যাদা দেয়। বল বলেছেন: “…the courts tread carefully in reflecting majority opinions.” বল এ প্রসঙ্গে মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের নজির উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন: “The blows the court received over the disclosures of Justice Fortas’s financial involvements in 1968, leading to his resignation shortly after President Johnson had nominated him as chief justice, illustrate the sensitivity of the court’s relationship to the total political process and that its power is closely related to the respect it can engender.”
(ঘ) ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ
নাগরিক অধিকার রক্ষা: ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হিসাবেও বিচার-বিভাগের গুরুদায়িত্ব আছে। আইন-বিভাগ ও শাসন-বিভাগের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে বিচার-বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। দেশে লিখিত শাসনতন্ত্র থাকলে আইন ও শাসন-বিভাগকে শাসনতান্ত্রিক গণ্ডীর মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। সরকার নাগরিকদের শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে বিচার-বিভাগ অপহৃত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন দেশে আইন ও শাসন-বিভাগ স্বাভাবিক ও জরুরী অধিকার সংকোচনমূলক বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাংবিধানিক আদালত শক্তিশালী সরকারের স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ থেকে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকে। গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত প্রভৃতি দেশে আদালত এই উদ্দেশ্যে আদেশ-নির্দেশ বা লেখ (writ) জারি করে থাকে। বল লিখেছেন: “Lewis Edinger has noted that the West German Court has been more conservative than innovative, especially on socio-economic and civil liberty issues, and has sought to remain above partisan controversies.”
অন্যান্য কাজ: উপরিউক্ত চারটি মূল ক্ষেত্রের বাইরেও সাংবিধানিক আদালতের অন্যান্য কার্যাবলী আছে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে বিতর্কিত নির্বাচনী এলাকা ও নির্বাচন সম্পর্কিত বিরোধের ক্ষেত্রে রায় দান, জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত ক্ষমতা প্রয়োগ বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ প্রদান, নীতি নির্ধারণ, রাজনীতিক বিরোধ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আদালতের এই সমস্ত কার্যাবলী আলোচিত কার্যাবলীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অ্যালান বল বলেছেন: “…these are clearly related to those we have discussed and can quite easily be fitted into our existing categories the significant point that arises in the context of these functions is that within all areas the courts function as important policy-makers.”
বিচারবিভাগীয় গুরুত্ব: সাম্প্রতিক কালের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগকে এই সমস্ত গুরুদায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়। বিশেষত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার-বিভাগের ভূমিকার গুরুত্ব অতিমাত্রায় বেশী। ল্যাস্কির মতানুসারে কোন রাষ্ট্রের বিচার পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে সেই রাষ্ট্রের নৈতিক প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। তিনি বলেছেন: “When we know how a nation state dispenses justice we know with exactness the moral character to which it can pretend.” ন্যায়বিচারের উপর জনসাধারণের অনাস্থা সৃষ্টি হলে বা ন্যায়বিচারের অভাব দেখা দিলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা এড়ানো যাবে না। সরকারের সব থেকে শক্তিশালী স্তম্ভ হল বিচারব্যবস্থার পরিচালনা। জর্জ ওয়াশিংটন মন্তব্য করেছেন: “Administration of justice is the firmest pillar of government.”
বিচার-বিভাগীয় রাজনীতিক ব্যবস্থার অংশ: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে বিচার বিভাগের ভূমিকার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার মৌল প্রকৃতি এবং তার সঙ্গে বিচার বিভাগের সম্পর্ক পর্যালোচনা করা দরকার। মার্কসবাদীদের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি অনুসারে বিচার-বিভাগ তার ভূমিকা পালন করে থাকে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বা যে কোন শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় আইন হল প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীস্বার্থের প্রতিফলন মাত্র। এ রকম অবস্থায় বিচারপতিরাও শ্রেণীস্বার্থের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কেবল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিচারকদের মূল কর্তব্য হল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সংরক্ষণ। বিচারবিভাগ রাজনীতিক ব্যবস্থা-নিরপেক্ষ হতে পারে না। রাজনীতিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবেই বিচার-বিভাগ তার ভূমিকা পালন করে। বল বলেছেন: “That the judicial system is part of the political process is to be emphasised.” বল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতাকে ‘আধাঅলীক’ (semi-fiction) ধারণা বলে মন্তব্য করেছেন। সমাজতান্ত্রিক দেশ গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় না।
Leave a comment