প্রশ্নঃ বিচার বিভাগের কার্যাবলি আলোচনা কর।

অথবা, বিচার বিভাগ কী কী কার্যসম্পাদন করে?

অথবা, বিচার বিভাগের সম্পাদিত কার্যাবলি উল্লেখ কর।

ভূমিকাঃ মানুষের সুখস্বাচ্ছন্দ্য তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কতকগুলো অধিকার ভোগ করা আবশ্যক। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে অধিকারগুলো ‘স্বীকার ও সংরক্ষণ করে। অধিকার সংরক্ষণের এ দায়িত্ব বস্তুতপক্ষে বিচার বিভাগই সম্পাদন করে। আইনের ব্যাখ্যা, বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা, অধিকারগুলোকে বাস্তবে কার্যকর করা প্রভৃতি গুরুদায়িত্ব বিচার বিভাগকেই মীমাংসা করতে হয়। তাই বিচার বিভাগ ছাড়া সভ্য সমাজজীবনের কথা ভাবাই যায় না। প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কথা কল্পনারও অতীত।

বিচার বিভাগঃ সাধারণভাবে বলা যায়, যে বিভাগ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে অথবা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ বাঁধলে তার মীমাংসা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে তাকে বিচার বিভাগ বলা হয়।

বিচার বিভাগের কার্যাবলিঃ বিচার বিভাগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। নিম্নে বিচার বিভাগের কার্যাবলি আলোচনা করা হলো-

১. বিচার করাঃ এ বিভাগের প্রধান কাজ হলো প্রচলিত আইন অনুসারে আইন অমান্যকারীদের বিচার করা ও শাস্তির রিধান করা। বিচারকগণ প্রচলিত আইন অনুযায়ী ন্যায়নীতির ভিত্তিতে বিচার করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।

২. বিচারকগণ আইনও সৃষ্টি করেনঃ প্রচলিত আইনের সাহায্যে আদালতের সম্মুখে উপস্থিত সকল মামলার মীমাংসা করা অনেক ক্ষেত্রে বিচারকদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না। তাছাড়া আইন যেখানে সুস্পষ্ট নয় সেখানে বিচারকগণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দ্বারাই বিবাদের বিচার হয়। বিচারকগণের এসব সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে অনুরূপ মামলার ক্ষেত্রে আইন হিসেবে গণ্য এবং প্রযুক্ত হয়। এভাবে বিচারকগণ নতুন আইনও সৃষ্টি করেন। এগুলোকে বিচারক সৃষ্ট আইন বলে।

৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের ভূমিকাঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আদালতের এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অভিভাবকও চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে এ আদালত কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যের মধ্যকার বিভিন্ন বিরোধের মীমাংসা করে থাকে।

৪. শাসন বিভাগকে পরামর্শ দানঃ অনেক দেশে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে কোন কোন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে। ভারতবর্ষে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনবোধে কোন আইন বা তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার মতামত রাষ্ট্রপতিকে জানায়। ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতকগুলো অঙ্গরাজ্যে এ ব্যবস্থা প্রচলিত।

৫. নাগরিক অধিকার সংরক্ষণঃ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হিসেবেও বিচার বিভাগের গুরুদায়িত্ব রয়েছে। আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সরকার নাগরিকদের শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারে হস্তপেক্ষ করলে বিচার বিভাগ অপহৃত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে।

৬. বিচার বিভাগীয় সমীক্ষাঃ বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা আদালতের একটি দায়িত্ব ও ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগ সংবিধান বিরোধী যে কোন আইনকে বা সরকারি সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিকতার অভিযোগে বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারে। আইন বিভাগ অথবা শাসন বিভাগ সংবিধান বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত বা আদেশ জারি বাতিল ক্ষমতাকে বিচার বিভাগীয় সমীক্ষার অধিকার বলে।

৭. সংবিধানের ব্যাখ্যাঃ সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ যে কোন আইনের বৈধতা যাচাই করতে পারে। সংবিধান লঙ্ঘিত হলে সে আইন বাতিল এবং সংবিধান লঙ্ঘিত না হলে সে আইন প্রয়োগ করা হয় এবং এ বৈধতা যাচাই বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত।

৮. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তিঃ বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের মীমাংসাও করে থাকে। সাংবিধানিক উপায়ে বা সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ এসব বিরোধের মীমাংসা করে। শাসন বিভাগের সাথে আইন বিভাগের বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিভিন্ন সরকারের মধ্যে এ ধরনের বিরোধ দেখা দিতে পারে।

৯. রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থনঃ বিচার বিভাগ হলো দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অঙ্গবিশেষ। এ কারণে বিচার বিভাগ দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ও সংরক্ষণ করে। বিচার বিভাগ অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নীতি ও কার্যাবলিকে বৈধ ঘোষণা করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।

১০. গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণঃ গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেওয়ানি, ফৌজদারি প্রভৃতি যে কোন মামলায় সত্য ঘটনা অনুসন্ধানের দ্বারা অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে বিচার বিভাগকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

১১. প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পাদনঃ এ বিভাগ দেশের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন আদালতের নীতিনির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন- বিদেশি নাগরিকদের নাগরিকত্ব দান, অভিভাবকত্ব নিরূপণ, নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ইত্যাদি।

১৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষাঃ বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। ব্যক্তির মৌল অধিকার যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সে জন্য বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

১৫. পরামর্শ সংক্রান্তঃ অনেক সময় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগকে বিচার বিভাগ পরামর্শ দান করে থাকে। যেমন- ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দান করতে পারে। সাধারণত সাংবিধানিক জটিলতার কারণে আইনসভা ও শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের কাছে পরামর্শ চায়।

উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিচার বিভাগ হলো ব্যক্তিস্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী। অন্যায়ের শাস্তি প্রদানের জন্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে অন্যায় ও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিচার বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও মৌলিক মানবাধিকার রক্ষাতেও বিচার বিভাগ অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। তাই Prof. Laski এর সাথে একমত হয়ে বলা যায় যে, “Acts of parliament are not self- operative, they have to be applied by and their application involves interpretation by a court.”