প্রশ্নঃ বিচারবাদ কী? এটি কীভাবে অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আলােচনা কর।

অথবা, জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ ব্যাখ্যা কর। তুমি কোন মতটি সমর্থন কর এবং কেন?

অথবা, জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে কান্টের বিচারবাদের একটি সমালােচনামূলক ব্যাখ্যা দাও।

ভূমিকাঃ জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আধুনিককালের দর্শনে জ্ঞানবিদ্যা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানের স্বরূপ, বিষয়বস্তু, বৈধতা, শর্ত, সীমা, উৎপত্তি প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করা হয়। দর্শনের এই শাখায় যথার্থ জ্ঞান সম্ভব কিনা, সম্ভব হলে এর সীমা কী, শর্ত বা উৎপত্তি কী, তা নিয়ে বিশদভাবে আলােচনা করা হয়। কান্ট জ্ঞানবিদ্যাকে দর্শনের আদি পর্ব বলে মনে করেন। সুতরাং জ্ঞান উৎপত্তি কি করে হয়- এই প্রশ্ন জ্ঞানবিদ্যার অন্যতম প্রধান জটিল সমস্যা এবং প্রথম প্রশ্ন। এই প্রশ্নের আলােচনাকে কেন্দ্র করে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এ মতবাদগুলাে হলাে-

(১) বুদ্ধিবাদ (Rationalism), (২) অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism), (৩) বিচারবাদ (Critical theory), (৪) দ্বান্দ্বিকবাদ (Dialectic theory), (৫) স্বজ্ঞাবাদ (Intuitionism)। নিম্নে বিচারবাদী মতবাদ এবং তা কীভাবে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সে সম্পর্কে তা আলােচনা করা হলাে-

কান্টের বিচারবাদঃ বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ উভয়ই চরম মতবাদ। বুদ্ধিবাদ বুদ্ধির ওপর এবং অভিজ্ঞতাবাদ অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। কান্ট নিজের মতবাদে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন। কান্ট দেখালেন যে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়েরই অবদান আছে। কোনােটিকে বাদ দিয়ে জ্ঞান সম্ভব নয়। কান্টের মতে অন্য বস্তুর মতাে জ্ঞানেরও দুটি দিক আছে। একটি তার আকার যা বুদ্ধির কাছ থেকে পাওয়া যায়, আর একটি উপাদান যা সংবেদন বা অভিজ্ঞতার কাছ থেকে পাওয়া যায়। কান্ট দেখালেন যে, বুদ্ধি কেবল জ্ঞানের আকার দিতে পারে। তার অভিজ্ঞা কেবল জ্ঞানের উপাদান দিতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের আকার দিতে পারে না। তিনি বিচারবাদের মাধ্যমে অভিজ্ঞতাপূর্বক জ্ঞানের সূত্র বের করেছেন।

(১) অবভাসিক দিকঃ বস্তুটি যেভাবে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়, তাকেই বস্তুর অবসিক দিক বলা হয়। যেমন- গােলাপ লাল, এই লাল দেখাটাই বস্তুর অবসিক দিক।

(২) অতীন্দ্রিয় সত্তাঃ বস্তুটি আসলে যা তা-ই, যেমন- গােলাপের লাল; রঙ-এর বাইরে যে আসল রুপ আছে সেটাই তার অতীন্দ্রিয় সত্তার দিক। বস্তুর আসল রূপ অজ্ঞাত, অজ্ঞেয়। জ্ঞানের উপাদান অর্থাৎ সংবেদন আসে মনের বাইরে থেকে। বস্তুটির অতীন্দ্রিয় সত্তা বা যথার্থ স্বরূপই এই সংবেদন উৎপন্ন করে। কিন্তু এই সংবেদন যতক্ষণ না মনের সংশ্লেষণী ত্রিয়া দ্বারা সুসংহত ও সুসংবদ্ধ হয় ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না। মন তার অন্তর্নিহিত অভিজ্ঞতাপূর্ণ জ্ঞানের আকারগুলাের দ্বারা এই সংবেদনকে সুসংবদ্ধ ও সুসংহত করে। এই সংবেদন দেশ ও কালের মাধ্যমে মনে এসে উপস্থিত হয়। কান্ট বলেছেন যে মনের আকারগুলােকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকার, (২) বােধজাত আকার এবং (৩) বুদ্ধির ধারণার আকার।

মনের বাইরে থেকে আগত সংবেদন বা উপাদান মনে যখন উপস্থিত হয় তখন মনের ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকার সেগুলােকে গ্রহণ করে। এ অবস্থায় সংবেদনগুলাে থাকে বিশৃঙ্খল ও অসংবদ্ধ। এর ওপর বােধজাত আকারের ছাপ পড়ে। অর্থাৎ মনের মধ্যে অবস্থিত বােধজাত আকার বিশৃঙ্খল অসংবদ্ধ সংবেদনকে মনে সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ করে। জ্ঞানের উপাদান ছাড়া শুধু আকার হলাে শূন্যগর্ভ। আকার ছাড়া শুধু উপাদান হলাে বিশৃঙ্খল। ইন্দ্রিয়ানুভূতির দ্বারা দেশ ও কালে বিন্যস্ত সংবেদনসমূহ বােধের আকারে আকারিত হবার পর বুদ্ধি’ তাদের পরস্পর সংবদ্ধ করে। এই পরস্পর সংবদ্ধ জ্ঞানকে বুদ্ধি তার নিজস্ব মূলনীতি, যথা-জগৎ, আত্মা ও ঈশ্বরের ধারণার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃত জ্ঞান হলাে ইন্দ্রিয়ানুভূতি বােধ ও বুদ্ধির সম্মিলিত ফল।

কান্টের মতে, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও বােধের আকার বা ধারণাগুলাে বস্তুর প্রকাশিত রূপের ক্ষেত্রেই শুধু প্রযােজ্য, বস্তুর স্বরূপের ক্ষেত্রে নয়। সুতরাং বস্তুর অবভাসই জানা যায়, বস্তুর স্বরূপ অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। অতীন্দ্রিয় শুধু শুদ্ধ সত্তা চিরকালই অজেয়। তাহলে অতীন্দ্রিয় শুদ্ধ বস্তু বা বস্তুস্বরূপ যে আছে তা-ই বা জানা গেল কী করে? এর উত্তরে কান্ট বলেন যে, তাকে জানা গেছে বুদ্ধির ধারণা দিয়ে। এজন্যেই কান্টের দর্শনকে অজ্ঞেয়বাদী দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

সমালােচনাঃ জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করলেও কান্ট সমালােচকদের দৃষ্টি এড়াতে পারেননি। বিচারবাদের কয়েকটি ত্রুটি এখানে উল্লেখ করা হলাে-

(১) কান্ট এ মতের সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছেনঃ কান্ট বস্তুর প্রকৃতরূপ ও অবভাসিক রূপের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেন তার সুষ্ঠু ব্যাখ্যা তিনি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাছাড়া জ্ঞানের উপাদান ও আকার হলাে দু’টি বিপরীতধর্মী প্রক্রিয়া। এ দুয়ের মধ্যে তিনি যে সমন্বয় সাধন করেন তা সন্তোষজনক নয়।

(২) কান্টের বিচারবাদ অজ্ঞেয়বাদঃ কান্ট বলেন, বস্তুর অতীন্দ্রিয় সত্তাকে জানা যায় না। ফলে, তার বিচারবাদ অজ্ঞেয়বাদে পরিণত হয়েছে।

(৩) কান্টের এ মত স্ববিরােধীঃ কান্ট বলেন, প্রকৃত সত্তার অস্তিত্ব আছে, তবে তা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। এখন প্রশ্ন হলাে আমরা যদি জানি যে প্রকৃত সত্তার অস্তিত্ব আছে, তাহলে তাকে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বলা হবে কেন? আর এই প্রকৃত সত্তাই যদি সংবেদনের উৎস হয়, তাহলে সে সত্তাকে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বলা যায় কি? সুতরাং কান্টের মতবাদ স্ববিবােধী।

(৪) অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞানঃ কান্টের মতে, জ্ঞান অভিজ্ঞতাপূর্ব সংশ্লেষক বাক্যে প্রকাশিত। কিন্তু আধুনিককালের অনেক দার্শনিক অভিজ্ঞতাপূর্ব সংশ্লেষক বাক্যের সম্ভাবনা অস্বীকার করেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কান্টের বিচারবাদে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদগুলাের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সন্তোষজনক। বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য বিচারবাদ একটি অসাধারণ মতবাদের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। এ কৃতিত্বের জন্য আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে কান্টের আসন সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে।