কমিউনিস্ট চিনের উত্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে কতখানি প্রভাব ফেলেছে তা আলােচনা করাে। 

অথবা, গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়েছিল? 

সূচনা: পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে (১৯৪৯ খ্রি., ১ অক্টোবর) চিন এশিয়াতে তথা বিশ্বরাজনীতিতে ভারসাম্য আনে।

[1] সাম্যবাদী শিবিরের শক্তি বৃদ্ধি: বিশ্বের দ্বিমেরুকরণ রাজনীতিতে চিনের উত্থান সাম্যবাদী শিবিরে প্রথম শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। চিন ও বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির গঠন করে।

[2] সাম্যবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ: রাশিয়ার সঙ্গে চিনের মৈত্রী বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তােলে। রাশিয়া ওই আন্দোলনকে জোরদার করতে নানাভাবে চিনের শিল্পায়ন, সমরসজ্জা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহায্য করতে থাকে। শুধু তাই নয়, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাশিয়া চিনকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সহযােগী নেতৃত্বের আসনেও বসায়।

[3] রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক

  • সম্পর্কের সূচনা: চিনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাশিয়ার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। চিনের লাল বিপ্লব সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ে তােলার পথে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সােপান। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রূপে চিনের আত্মপ্রকাশের পর রাশিয়াই প্রথম তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল।

  • মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর: বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ উভয় দেশের মধ্যে প্রায় ৩০ বছরের জন্য মৈত্রী চুক্তি (১৯৫০-১৯৭৯ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। এর সুফলরূপে রাশিয়ার কাছ থেকে চিন সহজ শর্তে ৩০ কোটি ডলার ঋণ পায়। এ ছাড়াও রাশিয়া পাের্ট আর্থার বন্দর ও মাঞ্চুরিয়া রেলপথের অধিকার চিনের হাতে তুলে দেয়।

  • বন্ধুত্বে ফাটল: কিন্তু ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে চিন সােভিয়েত বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে চিন-সােভিয়েত মৈত্রী ছিন্ন হয়ে যায়। সে সময়কার সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কুশ্চেভের নির্দেশে চিন থেকে রাশিয়ার সব প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতাদের ফিরিয়ে আনা হয়। আসলে এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল কুশ্চেভের স্টালিন-বিরােধী নীতি, যা চিন মেনে নিতে পারেনি এবং মাও-সে-তুঙের স্বাধীন মনােভাব। পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট চিন ন্যাটোকে সমর্থন করলে বেজিং ও মস্কোর দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়।

[4] আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক

  • সম্পর্কের অবনতি: চিনের সঙ্গে প্রথমদিকে আমেরিকার সম্পর্ক ছিল বৈরিতার। চিনে সাম্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পর মার্কিন-চিন সংঘাত শুরু হয়। চিনের কমিউনিস্ট বিরােধী চিয়াং কাই-শেককে সমর্থন করা, রাষ্ট্রসংঘে সাম্যবাদী চিনের বিরােধিতা করা বা কোরিয়া যুদ্ধের সময় চিনের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ ও পরমাণু বােমা নিক্ষেপের হুমকি দেওয়া ইত্যাদির ফলে মার্কিন-চিন সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কমিউনিস্ট চিনও মার্কিন বিদেশনীতির বিরােধিতা করা শুরু করে। কাগজে বাঘ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালােচনা করে।

  • সম্পর্কের উন্নতি: সাতের দশক থেকে চিন মার্কিন সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে শুরু করে। চিনের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি, রুশ-চিন দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ঘটনা মার্কিন-চিন সম্পর্কের উন্নতিতে সাহায্য করে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিন ১৭টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বেশকিছু পারমাণবিক বােমা তৈরি করে ফেলে। স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ব্যবস্থাতেও চিন দক্ষতা অর্জন করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রসংঘে চিনের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবকে আমেরিকা স্বাগত জানায়। মার্কিন বিদেশ-সচিব স্যার হেনরি কিসিঞ্জার এবং দুজন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিকসন, রেগন পরপর চিন সফরে আসেন। আবার চিনা মন্ত্রী বেন-শিয়াং-পিং মার্কিন সফরে গেলে চিন মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।

[5] গুরুত্বপূর্ণ এশীয় শক্তি: এতদিন কমিউনিস্ট ভাবধারা ও তার আধিপত্য রাশিয়া ও পূর্ব ইউরােপেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবার কমিউনিস্ট চিনের উত্থানের পর তা এশীয় ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে পড়ল। অচিরেই চিন এশিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

[6] তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাব

  • তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্ব: শুধু এশিয়া মহাদেশই নয়, উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবেও চিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

  • সৌহার্দ্যতায়: এশিয়ার পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের পাশাপাশি আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো, মালি, গিনি, তানজানিয়া, জাম্বিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রও চিনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলে।

  • জোটনিরপেক্ষতায়: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে চিনও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছে।

  • আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠায়: আন্তর্জাতিক শান্তি-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে চিনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই এর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ফলশ্রুতি হিসেবে জেনেভা (১৯৫৪ খ্রি.) ও বান্দুং (১৯৫৫ খ্রি.) সম্মেলনে চিন বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ করে।