বিংশ শতকের শুরুতে চিনে বিদেশিদের আধিপত্য, বিদেশিদের চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন অসম চুক্তি, বিদেশি পণ্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক চিনাদের মনে ক্রমাগত ক্ষোভ জমতে থাকে। শেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে চিনে এক বিদ্রোহ শুরু হয় যা ৪ মে-র আন্দোলন বা মে ফোর্থ মুভমেন্ট নামে পরিচিত।
[1] আন্দোলনের সূচনা: চিনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু শিউ ছিলেন ৪ মে-র আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর আহ্বানে চিনের হাজার হাজার দেশপ্রেমিক ছাত্র ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে পিকিং এর ‘তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ার’-এ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা চিন থেকে বিদেশি শক্তির অপসারণ, সমস্ত অসম চুক্তি বাতিল, দেশদ্রোহীদের শাস্তি প্রভৃতি দাবি করে এবং জাপানি পণ্য বয়কটের আহ্বান জানায়। বেশ কিছু ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে পিকিং-এর ছাত্ররা ধর্মঘটে শামিল হয়।
[2] আন্দোলনের অগ্রগতি: চিনা ঐতিহাসিক চাও সে সুং ৪ মে-র আন্দোলনের অগ্রগতিকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
-
প্রথম পর্যায়: আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মে ও জুন এই প্রথম দু মাস মূলত চিনের ছাত্ররা এতে অংশ নিয়েছিল। জাপানে পাঠরত চিনা ছাত্ররাও টোকিওর রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা প্রচারপত্রে জানায় যে, “চিনা জনগণকে হত্যা করলেও তারা আত্মসমর্পণ করবে না।”
-
দ্বিতীয় পর্যায়: এই পর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে চিনের শ্রমিক, কৃষক, মজুর ও বুদ্ধিজীবী—চিনের সর্বশ্রেণির মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়। ফলে চিনের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
[3] দমননীতি: চিনের প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রথমে দমননীতির দ্বারা আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ৩ জুন সরকার ৩০০-এর বেশি ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং সব ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ছাত্র আন্দোলন দাবানলের মতাে চিনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এবার শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও অফিস-আদালতে ধর্মঘট শুরু হয়।
[1] শ্রমিক শ্রেণির গুরুত্ব: ৪ মে-র আন্দোলনের দ্বারা চিনে শ্রমিক শ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এই আন্দোলনে শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়।
[2] জাতীয়তাবােধের প্রসার: ৪ মে-র আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই চিনে আধুনিকতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবােধের প্রসার ঘটে। প্রথম পর্বে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি। লি তা চাও এই আন্দোলনকে মানবমুক্তির সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।
[3] সাংস্কৃতিক অগ্রগতি: আন্দোলন শুরু হওয়ার পর চিনে বহু বইপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হলে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটে। চিনের পুরােনাে কনফুসীয় মতাদর্শ সমালােচিত হতে থাকে এবং নতুন সংস্কৃতিকে সবাই স্বাগত জানায়। ঐতিহাসিক ইমানুয়েল সু-র মতে, এই আন্দোলন চিনের সাংস্কৃতিক জগতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনে।
[4] আন্দোলনের সাফল্য: আন্দোলনের চাপের কাছে চিন সরকার নতি স্বীকার করলে আন্দোলনের সাফল্য ঘােষিত হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার আন্দোলনকারী ধৃত ছাত্রদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। চিনের পক্ষে ভার্সাই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর না করার কথা সরকার শেষপর্যন্ত ঘােষণা করে (২৮ জুন, ১৯১৯ খ্রি.)।
[5] কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা: ৪ মে-র আন্দোলনের ফলে চিনে কুয়ােমিনতাং দলের পুনর্গঠন হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন নেতা ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে চিনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে এই পার্টি চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
[6] ব্যাপকতা: চিনে ১৯১১র বিপ্লব ছিল একটি আঞ্চলিক বিপ্লব। কেবল দক্ষিণ চিন এবং সন্নিহিত অঞ্চলেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ৪ মে-র আন্দোলনের প্রভাব ছিল চিনের সর্বত্র এবং এর গণভিত্তি ছিল ব্যাপক।
উল্লেখযােগ্য দুটি সংবাদপত্র
চিনের ৪ মে-র (১৯১৯ খ্রি.) আন্দোলনের সময়কার দুটি উল্লেখযােগ্য সংবাদপত্র ছিল-
Leave a comment