সঙ্গমবংশ:

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুঝ-র পিতা সঙ্গমের নামানুসারে এই রাজবংশ ‘সঙ্গমবংশ’ নামে পরিচিত হয়েছে। হরিহর ও বুব্ধ ছাড়াও সঙ্গমের অপর তিন পুত্র কম্প, মুরপ্পা ও মুদল্লাও রাজনৈতিক কাজে অংশ নিতেন। হরিহর ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গমবংশের শাসন শুরু করেন। তবে হরিহর এবং বুদ্ধ সম্ভবত রাজা উপাধি গ্রহণ করেননি। পার্শ্ববর্তী দুই শক্তিশালী রাজ্য— মহীশূরের হোয়সল রাজা এবং মাদুরাই-এর সুলতানি রাজ্যের ঈর্ষা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামুক্ত থেকে শক্তিসংগ্রহের উদ্দেশ্যেই তাঁরা রাজকীয় উপাধি গ্রহণে দ্বিধান্বিত ছিলেন। অবশ্য সাহস ও উদ্যোগের অভাব তাঁদের আদৌ ছিল না। হরিহর জানতেন যে, অবিরত যুদ্ধের দ্বরাই তাঁকে রাজ্য রক্ষা ও বিস্তার করতে হবে। তবে সুযোগের জন্য অপেক্ষা ও সাফল্যের জন্য ধৈর্যরক্ষার মহৎ গুণ তাঁর ছিল। মাদুরার সুলতান ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হোয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লালকে পরাজিত ও হত্যা করেন। অতঃপর হরিহর ও বুব্ধ পতনোন্মুখ হোয়সল রাজ্যটিকে গ্রাস করতে উদ্যত হন। স্বভাবতই মাদুরার সাথে বিজয়নগরের সংঘর্ষ বাধে। সঙ্গম ভাইয়েরা সাফল্যের সাথে মাদুরার আক্রমণ প্রতিহত করে ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র হোয়সল রাজ্যটিকে বিজয়নগরের অধিকারভুক্ত করেন। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার সঙ্গমের পুত্রগণ ও সহযোগী আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। হোয়সল রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ থাকে হরিহরের হাতে, পূর্ব ও মধ্যভাগের দায়িত্ব পান বুক। উদয়গিরি ও উত্তর কানাড়া অঞ্চল পান যথাক্রমে কম্প ও মুরপ্পা। মহীশূরের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের শাসনভার পান মুদগ্ধা। এই ব্যবস্থাকে অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র ‘সমবায় লোকায়ততন্ত্র’ ধরনের শাসন বলে উল্লেখ করেছেন। এইভাবে উত্তর ও দক্ষিণে কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড ও পূর্ব-পশ্চিম দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী অঞ্চল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফেরিস্তার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, বাহমনী রাজ্যের হাতে পরাজিত হয়ে হরিহর তাঁর রাজ্যের কিছু ভূখণ্ড সুলতান বাহমন শাহকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। হরিহরের মৃত্যুর পর ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন বুক্ক। তিনি ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বুক্কর প্রধান কৃতিত্ব হল প্রবিবেশী শত্রু রাজ্য মাদুরার বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালিয়ে ওই রাজ্যের শক্তি খর্ব করা। সম্ভবত, বুক্কর মৃত্যুর বছরেই সম্পূর্ণ মাদুরা রাজ্য বিজয়নগরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। দক্ষিণে রামেশ্বরম্ পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন। একটি লিপিতে তিনি নিজেকে ‘পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ সমুদ্রের অধিপতি’ বলে অভিহিত করেছেন।

বুক্কর সময় বাহমনী রাজ্যের সাথে বিজয়নগরের দীর্ঘ সংগ্রামের সূচনা হয়। রাজ্যের উত্তরদিকে মুসলমান-শাসিত বাহমনী রাজ্য ছিল বিজয়নগরের সবথেকে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক আফগান সৈনিক আলাউদ্দিন হাসান শাহ। তিনি বাহমান শাহ উপাধি নিয়েছিলেন। তাই এই রাজ্যটি বাহমনী রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। যাই হোক, মুসলমান-শাসিত বাহমনী রাজ্যের সাথে হিন্দু-শাসিত বিজয়নগর রাজ্যের সংঘাত ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি। সাধারণভাবে বলা যায় যে, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের ধারক হিসেবে বিজয়নগর রাজ্য মুসলমান-শাসিত বাহমনী রাজ্যের বিনাশসাধনে উন্মুখ ছিল। আবার বাহমনী রাজ্যের শাসকদের হিন্দুবিদ্বেষ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মীয় বিদ্বেষ এই দুটি দক্ষিণী রাজ্যের দীর্ঘ সংঘাতের মূল কারণ ছিল না। এই সংঘর্ষের আপাত লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করা। তবে সেই লক্ষ্য গভীর অর্থনৈতিক প্রয়োজনবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। তুঙ্গভদ্রা-দোয়াব, কৃষ্ণা-গোদাবরী বদ্বীপ ও মারাঠা রাজ্য—এই তিনটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের সাথে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন জড়িত ছিল। (১) কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল তুঙ্গভদ্রা-দোয়াব বা রায়চুর-দোয়াব নামে পরিচিত ছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দক্ষিণী রাজ্যগুলির মধ্যে সংঘাত চলত। প্রাচীনকালে পশ্চিমি-চালুক্য ও চোলদের মধ্যে এবং পরে যাদব ও হোয়সলদের মধ্যে এই ধরনের দীর্ঘ সংঘাত ঘটেছিল। মধ্যযুগে সেই স্বার্থসংঘাতের ধারা লক্ষ্য করা যায় বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের মধ্যে। (২) কৃষ্ণা-গোদাবরী উপকূল অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত উর্বর ও বাণিজ্যসমৃদ্ধ। এই অঞ্চলে অনেকগুলি সমৃদ্ধ ও ব্যস্ত বন্দর থাকার ফলে ব্যাপক বহিবাণিজ্য সম্ভব হত এবং কৃষিজ উৎপাদনের ক্ষেত্রও অঞ্চলটি ছিল লোভনীয়। স্বভাবতই এই সমৃদ্ধ অঞ্চলের কর্তৃত্বলাভের জন্য দক্ষিণ ভারতের দুটি অগ্রণী শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। (৩) বিজয়নগর-বাহমনী সংঘর্ষের তৃতীয় কারণ ছিল কোঙ্কন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কর্তৃত্ব দখলের ইচ্ছা। পশ্চিমঘাট পর্বত ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী কোম্বন অঞ্চলটি ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে। ভারতে ভালোজাতের ঘোড়া ছিল না। ভালো ঘোড়ার জন্য ভারতীয় শাসকদের নির্ভর করতে হত মধ্য-এশিয়ার ব্যবসায়ীদের ওপর। গোয়া বন্দর হয়ে ঘোড়া আমদানি সহজ ছিল। তাই এই অঞ্চলের সামরিক উপযোগিতাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য দুটি এই তিনটি অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের লক্ষ্যে দীর্ঘ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।

বিলুপ্তির পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে প্রায়ই সামরিক সংঘাত চলেছিল। এই যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারায় এবং বিনষ্ট হয় প্রভূত ধনসম্পদ। ধ্বংসের কাজে কোনোপক্ষই পিছিয়ে ছিল না। উভয়েই অপরের গ্রাম ও নগর লুণ্ঠন করত, অগ্নিসংযোগ করত এবং স্ত্রী, পুরুষ ও শিশুদের বন্দি করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করত। সব মিলিয়ে উভয় রাজ্যই নৃশংসতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিত। বিজয়নগররাজ বুক্ক রায়চুর-দোয়াবে ‘মুদ্‌গল’ দুর্গ আক্রমণ করে (১৩৬৭ খ্রিঃ) এই দীর্ঘ সংঘর্ষের সূচনা করেন। বুক্ক এই আক্রমণকালে যথেষ্ট নৃশংসতার পরিচয় দেন। এর প্রত্যুত্তরে বাহমনী রাজ্যের সুলতান এক লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করার শপথ নিয়ে বিজয়নগরের বিরুদ্ধে যাত্রা করেন। তিনি মুদ্গল দুর্গ পুনর্দখল করেন এবং তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে বিজয়নগর রাজ্যে প্রবেশ করেন। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করেছিল। অবশ্য তুলনামূলকভাবে রাজ্যের অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনী বেশি দক্ষতার পরিচয় দেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পরেও ফলাফল অমীমাংসিত থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত রণক্লান্ত উভয়পক্ষই সন্ধিস্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে। শর্তানুসারে উভয়পক্ষ যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যায় এবং দোয়াব অঞ্চল উভয়ের ভাগাভাগি হয়। উভয় রাজ্যই যুদ্ধে নিষ্ঠুরতা পরিহার করার পক্ষে মতপ্রকাশ করে। স্থির হয়, ভবিষ্যৎ যুদ্ধে অকারণে অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হবে না। ড. সতীশ চন্দ্র লিখেছেন : “কখনো কখনো এ মতৈক্য লঙ্ঘিত হলেও এই সন্ধি দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধবিগ্রহের মানবিকতাবোধকে জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল।” বুব্ধ রামেশ্বরম্ পর্যন্ত তাঁর কর্তৃত্ব প্রসারিত করেন এবং একটি লেখতে নিজেকে ‘পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ সমুদ্রের অধিপতি’ বলে বর্ণনা করেছেন। শাসক হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আঞ্চলিক শাসকদের ওপর তিনি কেন্দ্রের কার্যকরী নিযন্ত্রণ আরোপে সক্ষম ছিলেন। ভাষা-সাহিত্যের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তাঁর আমলে বেদের নতুন ব্যাখ্যা রচিত হয়। তেলেগু ভাষার উন্নয়নে তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখান। তেলেগু কবি নাচনা সোমা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন।

বুদ্ধের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র দ্বিতীয় হরিহর (১৩৭৭ – ১৪০৬ খ্রিঃ)। তিনিই সর্বপ্রথম মহারাজাধিরাজ এবং রাজা পরমেশ্বর উপাধি নেন। সুযোদ্ধা দ্বিতীয় হরিহর মাদুরাই দখল করে পূর্ব উপকূলের দিকে রাজ্যবিস্তারে মন দেন। এই অংশে কয়েকটি হিন্দু-রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এদের মধ্যে উচ্চ বদ্বীপ অঞ্চলে রেড্ডিরা এবং কৃষ্ণা-গোদাবরী নিম্ন বদ্বীপ অঞ্চলে বরঙ্গল রাজ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই পূর্ব-উপকূলের দিকে উড়িষ্যা রাজ্য এবং বাহমনী রাজ্যের কর্তৃত্ব বিস্তারের ইচ্ছা ছিল। যাই হোক, বরঙ্গল রাজ্যের সাথে বাহমনী সুলতানের মিত্রতার ফলে হরিহরের ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। বরঙ্গল-বাহমনী জোট পঞ্চাশ বছরের অধিক স্থায়ী ছিল। এতদ্‌সত্ত্বেও দ্বিতীয় হরিহর বিজয়নগরের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হন। তাঁর বড়ো কৃতিত্ব হল যে, তিনি বাহমনী সুলতানের কাছ থেকে পশ্চিমে বেলগাঁও এবং গোয়া দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গোয়া দখল করার ফলে বিজয়নগরের আর্থিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত সিংহলের বিরুদ্ধেও তিনি একটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় হরিহরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিরোধ দেখা দেয়। প্রথমে প্রথম বিরূপাক্ষ সিংহাসন দখল করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে অপসৃত করে ক্ষমতা দখল করেন দ্বিতীয় বুব্ধ। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সরিয়ে স্থায়ীভাবে সিংহাসন দখল করেন প্রথম দেবরায় (১৪০৬ ‘২২ খ্রিঃ)। তাঁর আমলে আবার বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ হয়। বাহমনী সুলতান ফিরোজ শাহ দেবরায়কে পরাস্ত করে দশ লক্ষ মুদ্রা, বহু মুক্তা, হস্তী ও বিজয়নগর রাজকন্যার সাথে বাহমনী সুলতানের বিবাহ দিতে বাধ্য করেন। এই বিবাহ উপলক্ষ্যে তিন দিন ধরে উৎসব চলে। তবে এই বৈবাহিক সম্পর্ক উভয় রাজ্যের মধ্যে স্থায়ী রাজনৈতিক মৈত্রী রক্ষা করতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই দেবরায় বরঙ্গল রাজ্যের সাথে জোটবদ্ধ হন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল দুর্বল ‘রেড্ডি’ রাজ্যটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া। বাহমনী মৈত্রীজোট থেকে বরঙ্গলের বেরিয়ে আসার ফলে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক শক্তিসাম্যের পরিবর্তন ঘটে। দেবরায় বাহমনী সুলতান ফিরোজ শাহকে পরাজিত করে কৃষ্ণানদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ড নিজ অধিকারভুক্ত করেন।

প্রথম দেবরায়ের পর মাত্র কয়েক মাসের জন্য সিংহাসনে বসেছিলেন বিজয়রায়। তারপর শুরু হয় সঙ্গমবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি দ্বিতীয় দেবরায় এর শাসন (১৪২২ -‘৪৬ খ্রিঃ)। তাঁর আমলেও বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় দেবরায় উপলব্ধি করেন যে, সুদক্ষ তিরন্দাজ বাহিনী দেশের সামরিক শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান। ফেরিস্তা লিখেছেন যে, বিজয়নগর বাহিনীকে তিরন্দাজিতে সুদক্ষ করে তোলার জন্য দ্বিতীয় দেবরায় জায়গির দিয়ে দু-হাজার মুসলিম প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। তবে ড. সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে, ইতিপূর্বেই বিজয়নগর বাহিনীতে মুসলমান সৈন্য নিয়োজিত ছিল। দক্ষ তিরন্দাজ ও বিজয়নগরে ছিল। সম্ভবত অশ্বারোহী নিপুণ তিরন্দাজ হিন্দু বাহিনীতে ছিল না। এই ত্রুটি দূর করার জন্য দ্বিতীয় দেবরায় হয়তো কিছু নতুন মুসলমান প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। যাই হোক, সামরিক-বহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করার পর তিনি রাজ্যবিস্তারে মন দেন। এই সূত্রে দ্বিতীয় দেবরায় বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন। ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাহমনী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মুদ্গল, বাঁকাপুর প্রভৃতি স্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। দু-রাজ্যের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু কোনোপক্ষই বিজয়ী না-হওয়ায় স্থিতাবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়।

ভারতে আগত পোর্তুগীজ নুনিজ-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, কুইলন, শ্রীলঙ্কা, পুলিকট, পেগু (ব্রহ্মদেশ) ও তেনাসেরিম (মালয়) প্রভৃতি রাজ্য দ্বিতীয় দেবরায়কে কর দিত। তবে এরা সবাই বিজয়নগরের করদ রাজ্য ছিল বলে মনে হয় না। ড. সতীশ চন্দ্রের মতে, বিজয়নগর রাজ্য নৌ বাহিনীতে এত বেশি দক্ষ ছিল না যে, পেগু বা তেনাসেরিম-এর মতো উপকূলবর্তী রাজ্য থেকে নিয়মিত কর আদায় করতে পারত। সম্ভবত মৈত্রীর নিদর্শন হিসেবে তাঁরা বিজয়নগরে উপঢৌকন পাঠাতেন। তবে সিংহলের বিরুদ্ধে বিজয়নগর কয়েকবার সফল অভিযান পাঠিয়েছিল এবং হয়তো সেখান থেকে বিজয়নগর নিয়মিত কর লাভ করত।

দ্বিতীয় দেবরায়ের মৃত্যুর পর (১৪৪৬ খ্রিঃ) তাঁর পুত্র মল্লিকার্জুন বিজয়নগরের শাসনভার গ্রহণ করেন। তাঁর দীর্ঘ ১৯ বছরের রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল বাহমনী ও উড়িষ্যা রাজ্যদ্বয়ের মিলিত আক্রমণ। অবশ্য মল্লিকার্জুন এই আক্রমণ প্রতিহত করে নিজ রাজ্যকে অটুট রাখেন। এই কাজে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান চন্দ্রগিরির সালুভবংশীয় জনৈক সেনানায়ক নরসীমা। স্বভাবতই বিজয়নগর রাজ্যে নরসীমার প্রভাব ও মর্যাদা খুবই বৃদ্ধি পায়। মল্লিকার্জুনের পর বিজয়নগরের সিংহাসনের বসেন তাঁর ভাই দ্বিতীয় বিরূপাক্ষ (১৪৬৫ খ্রিঃ)। দীর্ঘ দু-দশক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই অদক্ষ। ফলে সারা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা প্রকট হয়ে ওঠে। বহু সামন্ত তাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীন আচরণ করতে থাকেন। উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যেও লোভ ও শোষণপ্রবণতার বাহুল্য দেখা দেয়। প্রজাদের দুঃখদুদর্শা বাড়তে থাকে। এই সুযোগে উড়িষ্যার রাজা পুরুষোত্তম গজপতি দক্ষিণদিকে তিরুভেন্নামেলাই পর্যন্ত ভূখণ্ড দখল করে নেন। বাহমনী রাজাও বিজয়নগরের ভূখণ্ড গ্রাস করতে উদ্যত হন। এই সার্বিক বিশৃঙ্খলা ও ভাঙনের মুহূর্তে সেনানায়ক নরসীমা রাজা দ্বিতীয় বিরূপাক্ষকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে নেন। এইভাবে সঙ্গমবংশের অবসান ঘটে ও সালুভবংশের শাসন শুরু হয়।

সালুভবংশ :

সালুভবংশীয় শাসন চালু ছিল মাত্র সতেরো বছর (১৪৮৬-১৫০৩ খ্রিঃ)। প্রতিষ্ঠাতা রাজা নরসীমা মোটামুটি দক্ষ শাসক ছিলেন। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তবে উড়িষ্যা ও বাহমনী রাজ্যের হাত থেকে যথাক্রমে উদয়গিরি ও রাইচুর দোয়াব অঞ্চল তিনি পুনরধিকার করতে ব্যর্থ হন। তাঁর পুত্র ইম্মাদি নরসিংহের আমলে জনৈক সেনাপতি নরসনায়ক রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করেন। সিংহাসনে না বসলেও তিনিই ছিলেন। প্রকৃত শাসক। নরসনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বীর নরসিংহ পিতার ক্ষমতার অধিকারী হন। তবে তিনি ছিলেন বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাই ইম্মাদীকে হত্যা করে তিনি নিজেকেই ‘বিজয়নগরের রাজা বলে ঘোষণা করেন। এটি ছিল বিজয়নগর রাজ্যের দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থান। এর ফলে সালুভবংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং সূচনা হয় তুলভবংশের শাসনপর্ব।

তুলভবংশ :

বীর নরসিংহ অবশ্যই দক্ষ শাসক ছিলেন। কিন্তু তাঁর শাসনকাল (১৫০৫ – ১৫০৯ খ্রিঃ) অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও মুসলমানদের আক্রমণ দ্বারা বেশ সংকটপূর্ণ ছিল। নরসিংহ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিদ্রোহী সামন্তদের দমন করেন। এই সময় বাহমনী রাজ্য ভেঙে বিজাপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিজাপুর শাসক ইউসুফ আদিল শাহ রায়চুর-দোয়াব দখল করতে উদ্যত হলে বিজয়নগরের রাজার সাথে সংঘর্ষ বাধে। এই সময় বাহমনী সুলতান মামুদ শাহের উদ্যোগে মুসলমান অভিজাতরা বিজয়নগরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। বিজাপুর সুলতান রায়চুর ও মুদ্গল দুর্গ দখল করে নেন। তবে বিজাপুর সুলতান বিজয়নগরের অভ্যন্তরে ক্ষমতাবিস্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে বীর নরসিংহ আরভিডু অঞ্চলের শাসক রাম রায় ও তাঁর পুত্র তিম্মার বিশেষ সাহায্যলাভে উপকৃত হন। যুদ্ধ-ব্যস্ততার মাঝেও বীর নরসিংহ সামরিক বাহিনীর সংস্কার সাধন করেন। তিনি পোর্তুগাল গভর্নর আলমিদার এক চুক্তি দ্বারা তাঁর আমদানিকৃত সমস্ত ঘোড়া কেনার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে বিজয়নগরের অশ্বারোহী বাহিনী শক্তিশালী হয়। রায়তদের অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি কৃষি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সংস্কার করেন।