প্রশ্নঃ ভাববাদ ও বাস্তববাদের মূল বিতর্কের বিষয় ব্যাখ্যা কর। এ দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায় কি?

অথবা, বাস্তববাদ ও ভাববাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।

ভূমিকাঃ জ্ঞান জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক প্রকাশ করে। যিনি জানেন তার নাম জ্ঞাতা। সমস্ত জ্ঞানেই কোনাে একজন লােক কোনাে একটি বস্তু জানে। সুতরাং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় সম্পর্কই জ্ঞান। আমাদের আলােচ্য প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে বাস্তববাদের স্বরূপ উল্লেখ করে, বাস্তববাদ ও ভাববাদের মুল বিতর্কটি তুলে ধরতে সচেষ্ট হব।

বাস্তববাদঃ বাস্তববাদ ভাববাদের আগেই আবির্ভূত হয়েছে। মননিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেই মানুষের চিন্তার যাত্রা শুরু হয়। বাস্তববাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তুর মন নিরপেক্ষ সত্তা আছে। যে বস্তু জানা হয় তাকে বলে জ্ঞেয় বস্তু আর যিনি জানেন তাকে বলে “জ্ঞাতা’। সুতরাং যে মতবাদ মননিরপেক্ষ জ্ঞেয়-বস্তর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাকে বলে বাস্তববাদ। বাস্তববাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাতার জানা বা না জানার ওপর নির্ভর করে না। বস্ত জ্ঞানের বিষয় হতে পারে। কিন্তু বস্তুর অস্তিত্ব মন বা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না। বাস্তববাদীগণ বস্তুর মন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নিম্নেক্ত যুক্তিগুলি উত্থাপন করেন। যথা-

(ক) জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কের ওপর জ্ঞান নির্ভরশীল। সুতরাং ‘জ্ঞাতা’ ও ‘জ্ঞেয়’ বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আমরা স্বাভাবিকভাবেই স্বীকার করে থাকি। বস্তু ছাড়া জ্ঞান সম্ভব নয়। সুতরাং বস্তুর জ্ঞান বা মননিরপেক্ষ অস্তিত্ব রয়েছে।

(খ) জ্ঞানের সঙ্গে বস্তুর যে সম্পর্ক তা বাহ্যিক, অন্তর নয়। সুতরাং এদের সম্পর্ক প্রমাণ করে যে জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞান বা মননিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র নয়।

ভাববাদঃ ভাববাদ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছ এবং এটির বিভিন্ন ব্যবহারও রয়েছে। অনেকে ভাববাদ শব্দটিকে আদর্শবাদী (idealist) শব্দের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে থকেন। এ ক্ষেত্রে একজন আদর্শবাদী বলতে বােঝায় এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি নৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শানুসারে জীবনযাপন করে থাকে। আবার, অনেক সময় আদর্শবাদী বলতে এমন ব্যক্তিকে নির্দেশ করে যিনি বাস্তবজীবনে প্রতিফলন সম্ভব নয়, এমন আদর্শ সামনে রেখে চলার চেষ্টা করেন। এসব কিন্তু ভাববাদ শব্দটির অদার্শনিক ব্যবহার বৈ কিছু নয়। ভাববাদ শব্দটির দার্শনিক অর্থ আদর্শ (ideal) নয় বরং ধারণা (idea) ও মন শব্দগুলাের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত দর্শনে ভাববাদ পরস্পর সম্পর্কিত তিনটি অর্থে গৃহীত হয়ে থাকে। এক, ভাববাদ এমন একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের নির্দেশ করে যার মতে বাহ্যবস্তু আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে মনের ধারণাবিশেষ। দুই, ভাববাদ এমন একটি পরিণতিমূলক মতবাদ বােঝায় যার মতে বিশ্ব কোনাে উদ্দেশ্য অনুধাবনের জন্য ক্রম-অগ্রসরমান। তিন, ভাববাদ বলতে অনেক সময় এমন একটি পরাতাত্ত্বিক মতবাদকে বােঝায়, যার মতে বিশ্বজগৎ চিন্তন বা মনের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হয়। প্রথম দুটি অর্থে ভাববাদ বাস্তববাদের সম্পূর্ণ বিরােধী একটি মতবাদ এবং তৃতীয় অর্থে এটি জড়বাদের বিরােধী একটি মতবাদ বিশেষ।

বাস্তববাদ ও ভাববাদের মৃল বিতর্কঃ জ্ঞেয় বস্তু মন-নিরপেক্ষ না মন সাপেক্ষ সত্তা, এটাই হচ্ছে বাস্তবাদ ও ভাববাদের মূল বিতর্কের বিষয়। এ সম্পর্কে উভয় মতবাদের যুক্তিগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-

(১) বাস্তববাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তু মন-নিরপেক্ষ সত্তা। যেমন- গাছ-পালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির অস্তিত্ব মানুষের মনের ওপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের মনের বাইরে এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। অপরদিকে ভাববাদ অনুসারে, বস্তু হচ্ছে সত্তার জ্ঞান নির্ভর অভবাস, জ্ঞানের অতিরিক্ত সত্তা নয়। কারণ বস্তুর অস্তিত নির্ভর করে বস্তুকে জানার ওপর। আমরা কখনও আমাদের চিন্তার জগৎ অতিক্রম করতে পারি না। সেজন্য বস্তর অস্তিত্ব আমাদের চিন্তা বা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে।

(২) বাস্তববাদের মতে, বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্কটি বাহ্যিক। বস্তুর সাথে জ্ঞানের বাহ্য সম্পর্ক প্রমাণ করে যে জ্ঞেয় বস্ত জ্ঞান বা মন-নিরপেক্ষ। অপর দিকে ভাববাদের মতে, বস্তুর সাথে জ্ঞানের অন্তর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাননির্ভর। অজ্ঞাত বস্তুর কোনাে জ্ঞানই থাকতে পারে না। বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক বস্তুর জ্ঞাননির্ভরতা প্রমাণ করে।

(৩) বাস্তববাদের মতে বস্তর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক বস্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং বস্তু জ্ঞান-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা। যেমন- কালাে কাকের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে, কাক যে কালাে- এরূপ জ্ঞান আমাদের হতাে না।

(৪) বাস্তববাদীরা বস্তুকেন্দ্রিক। আর ভাববাদীরা আত্মকেন্দ্রিক।

(৫) বাস্তববাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী। অপর পক্ষে ভাববাদীরা উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী।

(৬) বাস্তববাদীরা জড়কে মন থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন। পক্ষান্তরে ভাববাদীরা জড়কে মনের ওপর স্থাপন করেন।

উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যায় যে, বাস্তববাদীদের উদ্দেশ্য মননিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অপরদিকে ভাববাদীদের উদ্দেশ্য তাকে অস্বীকার করা।

বাস্তববাদ ও ভাববাদের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব কি নাঃ বাস্তববাদ ও ভাববাদ বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এদের মধ্যে সমন্বয় কোনােভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তববাদের বক্তব্য হলাে, বস্তুর মন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। এই পৃথিবীতে যা কিছু বিদ্যমান সবকিছুরই অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাস্তববাদীদের মতে, আমরা বাহ্য জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করি বলেই, বাহ্য জগতের জ্ঞান পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব। পক্ষান্তরে, ভাববাদ মন-নিরপেক্ষ কোনাে বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ভাববাদীদের মতে, জ্ঞাতা ছাড়া জ্ঞেয় বস্তুর কোনাে অস্তিত্ব নেই। বস্তু মানেই মনের ধারণা। বাহ্য জগতের অস্তিত্ব আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল। বাস্তববাদ ভাববাদের এ বিরােধ দীর্ঘকালের এ দুটো বিরােধী মতের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা কেউ কেউ করলেও তাদের মতবাদের তেমন কোনাে বিষয়বস্তু নেই। কিন্তু হেগেলের দর্শনে আমরা এ ধরনের একটা প্রচেষ্টা দেখতে পাই। তার মতে, পরমসত্তা এক পরম ধীশক্তি, যিনি প্রকৃতি ও মনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। বস্ত জগৎ জড়াত্মক নয়, মনের বিপরীত নয়, বরং পরম মানবসত্তারই এক বিশেষ মূর্ত প্রকাশ। একই শক্তি জড় জীব ও চৈতনেৰে মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে। হেগেলের এ মত গ্রহণযােগ্য নয়। এ মত বাস্তববাদ ও ভাববাদকে এক করতে সক্ষম নয়। কেননা, এ মতবাদে অতীন্দ্রিয় সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ মত দু’টো বিরােধী সত্তা মন বস্তুকে এক করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, বাস্তববাদ ভাববাদের সমন্বয় কোনােমতেই সম্ভব নয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বাস্তববাদ ও ভাববাদ দুটিই চরমপন্থী মতবাদ। এ দুটি মতবাদের মধ্যে বিতর্ক শেষ হওয়ার নয়। তবে এদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বস্তুগত ভাববাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বস্তুগত ভাববাদ অনুযায়ী, জীবাত্মা ও জড় জগৎ মূলত এক ও অভিন্ন। কারণ উভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ। এদের উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। কাজেই বস্তুগত ভাববাদ এ দুটি মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে।