সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পটল্ডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানিকে রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই চারটি দেশের কর্তৃত্বাধীনে চারটি পৃথক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেদের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। রাশিয়া চেয়েছিল তার অধিকার করা পূর্ব জার্মানিতে এক তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত হােক। কিন্তু মিত্রশক্তি চেয়েছিল তাদের অধিকার করা অঞ্চলগুলি নিয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করতে। এর ফলে জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বার্লিন সংকট।

[1] প্রেক্ষাপট: জার্মানিকে চার ভাগে ভাগ করা হবে-

  • রাশিয়ার অঞ্চল: ওডার-নিস নদীর তীর বরাবর এ পর্যন্ত অঞ্চলের অধিকার পাবে রাশিয়া।

  • মার্কিন অঞ্চল: জার্মানির দক্ষিণ অঞ্চলের অধিকার পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

  • ব্রিটিশ অঞ্চল: জার্মানির উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকার পাবে ব্রিটেন।

  • ফ্রান্সের অঞ্চল: জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকার পাবে ফ্রান্সে।

চারভাগে বিভক্ত হলেও সমগ্র জার্মানিতে অর্থনৈতিক নীতি থাকবে একটিই। জার্মানির চারটি ভাগে একই অর্থনীতি চালু রাখার জন্য বার্লিনে গঠিত হবে ACC (Allied Control Council) জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও চার ভাগে ভাগ করা হবে বলে ঘােষণা করা হয়।

[2] সােভিয়েত কর্তৃক বার্লিন অবরােধ: বার্লিন ছিল পূর্ব জার্মানির অংশ আর তাই তা ছিল রাশিয়ার কর্তৃত্বাধীন।আবার পশ্চিম জার্মানিতে মার্কিনিরা যে আর্থিক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তাতে রাশিয়া ক্ষুধ হয়েছিল। এর ফলে রাশিয়া পশ্চিমি রাষ্ট্রজোটের পূর্ব বা পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশের সড়কপথ (যা ছিল রাশিয়ার অধীনস্থ) অবরােধ করে (১৯৪৮ খ্রি., ২৪ জুন)। এই ঘটনা বার্লিন অবরােধ (Berlin Blockade) নামে পরিচিত।

[3] সংকটের অবসান: রাশিয়ার বার্লিন অবরোধের ফলে পশ্চিম জার্মানিতে‌ চরম খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ব্রিটেন ও আমেরিকা রাশিয়ার অবরােধের কাছে। নতিস্বীকার না করে দীর্ঘ ১১ মাস ধরে ১৪০০ বিমানের সাহায্যে আকাশপথে অবরুদ্ধ বার্লিন অঞ্চলকে প্রতিদিন ৮ হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ, তেল, কয়লা-সহ অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দেয়। এই ঘটনা ‘Berlin Airlift’ নামে খ্যাত। স্টালিন এই আকাশপথে সরবরাহ ব্যবস্থার বিরােধিতা করার সাহস দেখাতে পারেননি। অবশেষে বাধ্য হয়ে রাশিয়া ২৯৩ দিন পর অবরােধ তুলে নেয় (১৯৪৯ খ্রি., ১২ মে)।

[4] বার্লিন সংকটের ফলাফল: বার্লিন সংকটের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।

  • জটিলতা বৃদ্ধি: বার্লিন সংকট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছিল। আমেরিকা সাম্যবাদের প্রসার রােধ করতে চাইলে রাশিয়াও পুঁজিবাদের প্রসার রােধে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বিশ্বরাজনীতি জটিল রূপ ধারণ করে।

  • জার্মানিতে আলাদা সরকার: মার্কিন জোটের মদতে পশ্চিম জার্মানি, জার্মান যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র (Federal Republic of Germany, FRG) হিসেবে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম জার্মানির প্রধান হন খ্রিস্টান ডেমােক্রেটিক দলের কনরাড আদানুর। আর রুশ জোটের মদতে পূর্ব জার্মানি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (German Democratic Republic, GDR) হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সরকারের কর্ণধার হন আটো গ্রোটোহল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কংক্রিটের ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রাচীর গড়ে তােলে।

  • সামরিক শক্তিবৃদ্ধি: এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃহৎ শক্তিভুক্ত দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তিকে আরও মজবুত করার দিকে নজর দেয়।

উপসংহার: বার্লিন সংকটের পরিণতি হিসেবে পরবর্তীকালে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতি আরও পরিপুষ্ট হয়।