“তাঁহার নাটকাবলীর প্রধান উদ্দেশ্য সমাজ সমালোচনা ও সংস্কার।”— বার্নার্ড শ’-এর নাটক সম্পর্কে এই মন্তব্যের তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
উদ্দেশ্যমূলকতা বার্নার্ড শ’-র নাট্যরচনার প্রধান লক্ষণ। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন, “শুধু শিল্পের খাতিরে আমি একটি লাইনও লেখার কষ্ট স্বীকার করতে সম্মত নই।” এই দৃষ্টিকোণ থেকে বার্নার্ড শ’-এর নাট্যপ্রতিভার স্বরূপ উদ্ঘাটন করো।
বিশ শতকের প্রথম দশক ইংরেজী সাহিত্যের নাটক রচনার ক্ষেত্রে এক প্রতিশ্রুতি ও সম্ভবনাময় দশক। প্রায় এক শতাব্দীর ভাটার টানের পর বার্নার্ড শ’, গলওয়ার্দি এবং আইরিশ নাট্যকার সিগ্ধ (J.M. Synge) প্রভৃতির হাতে ইংরেজী নাটক নতুন ধারায় ও নবজীবনে সঞ্জীবিত হয়ে সাহিত্যে স্থান করে নিল। ইংরেজী সাহিত্যে এই নাটকগুলিকে আমরা ‘নব নাটক’ (New Drama) বলেও অভিহিত করতে পারি। একমাত্র আনন্দ দানই এই নাটকসমূহের উদ্দেশ্য ছিল না, সমাজনীতি, অর্থনীতি, জীববিদ্যা, জ্ঞানের বিচিত্র বহুমুখী দিককেও মনস্বীতার নতুন আলোকে আধুনিক কালের পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন। নতুন জিজ্ঞাসায় আলোড়িত করেছেন পাঠক-মনকে। তৎকালীন কাব্য ও উপন্যাসের প্রতিদ্বন্দ্বী আঙ্গিকরুপেও নাটক গড়ে উঠল।
অবশ্য একথা স্বীকার্য যে এই নতুন ধরনের নাটক একেবারে আকস্মিকভাবে এই সময় আত্মপ্রকাশ করেনি। এর পেছনে একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। শেরিডন (Sharidon)-এর সমাজমুখী নাটক, ‘দ্য রাইভ্যালস’ (The Rivals, ১৭৭৫ খ্রিঃ) এবং ‘দ্য স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল’ (The School for Scandal, ১৭৭৭ খ্রিঃ) রচনার পর প্রায় শতবর্ষ পেরিয়ে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে রবার্টসনের (Thomas William Robertson, ১৮২৯-৭১ খ্রিঃ) হাতে আবার বাস্তব জীবন ও সমাজকে নিয়ে লেখা নাটক পাওয়া গেল। তাঁর কমেডি নাটক ‘সোসাইটি’-তে (Society. ১৮৬৫ খ্রিঃ) তৎকালে প্রচলিত আবেগময় রোমান্টিক কাহিনী পরিবেশনের পরিবর্তে মানসিক চিন্তার খোরাক জোগান হয়েছে। এই কারণে সেকালে নাটকটি দর্শকদের নন্দিত অভিনন্দন লাভ করে নি। কিন্তু আধুনিক ‘নবনাটক’ বা বার্নার্ড শ’ প্রমুখ আধুনিক নাট্যকারদের পথ প্রশস্ত করেছে। ক্রমে নাটক হয়ে উঠেছে সমাজ সংগ্রামের হাতিয়ার। সমসাময়িক জীবন ও সমাজের যে বিভিন্ন সমস্যা, সেই সমস্যা ও তার সমালোচনা নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠল।
এই ধারাপথেই উনিশ শতকের শেষে এলেন বার্নার্ড শ’, গলসওয়ার্দি। এই সময়কালেই এলেন ওস্কার ওয়াইল্ড (Oscar Wilde)। তাঁর হাস্যরসনিপুণতা, চমৎকারী বুদ্ধি ও রসিকতা, শিল্পকুশলতা, অত্যুতকৃষ্ট উজ্জ্বল নাটকীয় সংলাপ প্রভৃতি সাহিত্য হিসেবে নাটককে আরো উঁচু গ্রামে তুলে নিয়ে গেল।
বার্নার্ড শ’র ওপর আর একজন নাট্যকার প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি হচ্ছেন নরওয়ের নাট্যকার আধুনিক নাট্য আন্দোলনের গুরু ইবসেন (Henrik Ibsen)। সামাজিক সমস্যাসমূহকে নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি সুন্দর রূপ দিয়েছেন। বার্নার্ড শ’ ছিলেন তাঁর অনুরাগী ও অনুগামী। ‘কুইন্টেসেন্স অব ইবসেনিজম্’ (Quintessence of lbsensim) প্রবন্ধে তিনি এ বিষয়ে তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেছেন।
এই সময়ের এই নব নাটকের পথ তৈরীতে পিনেরো (A. W. Pinero) এবং জোনস্ (Henry Arther Jones) তাঁদের সমাজসমস্যামূলক নাটক নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। শ’ থেকে বয়সে এরা সামান্য বড়।
পূর্বসুরীদের এই পথ ধরেই ইংরেজী নাটকের প্রশস্ত অঙ্গনে এলেন বার্নার্ড শ’। শেকসপীয়রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেও তার রোমান্টিক কল্পনার প্রতি তিনি কটাক্ষ করেছেন। ইবসেন প্রদর্শিত পথই হল তাঁর নাটক রচনার আদর্শ। তিনি যখন নাটক লেখা আরম্ভ করেন সেই সময় পেটার (Pater) প্রভৃতি কথিত ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ (art for art’s sake) বা শিল্পের জন্যই শিল্প—এই ছিল সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রচলিত মত। এই মতের তিনি সমর্থক ছিলেন না। তাঁর মতে এই মতবাদ সাহিত্যিকের দৈন্য এবং জীবন ও সামাজিক সমস্যাসমূহের গভীর অনুধাবনের অক্ষমতাকে ঢেকে রাখে। তাই তাঁর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপ্যারম্যান’ (Man and Superman) নাটকের ভূমিকায় তিনি বলেন—“শুধু শিল্পের খাতিরে আমি একটি লাইন লেখার কষ্টও স্বীকার করতে রাজী নই” (For art’s sake alone, I would not face the toil of writing a single line.”)। সোস্যালিস্ট শ’ নাটকের মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন, পালন করেছেন সমাজ-শিক্ষকের দায়িত্ব। তিনি মনে করতেন শিল্পের চেয়ে জীবন বড় এবং সাহিত্য সামাজিক শিক্ষার জন্য, জীবনের জন্য তাই তাঁর কাছে নাটকের মণ্য স্টেজ-ই হচ্ছে স্কুল বা চার্চতুল্য, একাধারে শিক্ষা এবং আনন্দলাভের ক্ষেত্র। এর মধ্য দিয়েই তিনি জাতিকে তাঁর মতে দীক্ষিত ও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন।
এর ফলে শ’-র নাটকগুলি হয়ে উঠেছে সমস্যামূলক নাটক (Problem Play), সেই সমস্যা শ’-র সমসাময়িক যুগের সমস্যা। সমস্যা সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, জীববিজ্ঞান, চিরন্তন নীতির দোহাই দিয়েই প্রচলিত রীতিনীতি নিয়ে উদ্ভুত সমস্যা। হাস্যরস, ব্যঙ্গ, শাণিত বক্তব্য ও নাটকীয় সংলাপের দ্বারা তিনি বক্তব্যকে উপভোগ্য করে তুললেন। অবশ্য শ’ তাঁর নাটকে সমস্যাই তুলে ধরেছেন। নিজে কোনো সমাধান দেন নি। পাঠক বা দর্শকের মনকে জাগিয়ে তুলে তাদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন সমাধানের ভার।
শ’-র ‘উইডোয়ার্স হাউসেস’ নাটকটিতে লণ্ডনের বস্তি জীবনের বাস্তব রূপ, তার অসহ দারিদ্র্য ও বঞ্চনাময় জীবন এবং তার পাশাপাশি বিলাসবৈভব দেখান হয়েছে। মানব সমাজের এই বৈষম্যকে পাশাপাশি তুলে ধরে এই সামাজিক সমস্যার প্রতি সহৃদয় মানুষের চিন্তা ও চেতনাকেই তিনি আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন। ‘মিসেস ওয়ারেন্স প্রফেস’ নাটকের বিষয়বস্তু ছিল পতিতা সমস্যার কারণ ও স্বরুপ। ‘আমর্স এণ্ড দ্য ম্যান’ নাটকের বিষয়বস্তু যুদ্ধ। উভয়ের মধ্য দিয়েই সমাজের অন্তঃসারশূন্যতা দেখান ছিল এই নাটকদুটিতে শ’-র উদ্দেশ্য। শ’র থ্রি প্লেজ ফর পিউরিনাস শুচিতাপন্থীদের জন্য লিখিত। নাটক তিনটিতে তিনি ধর্ম, কামনা, প্রতিহিংসা প্রভৃতিকে নিয়ে কাহিনীকে রূপ দিয়েছেন। এখানেও সুপ্ত পাঠকমনকে প্রশ্নের আঘাতে জাকিয়ে দেওয়াই শ’-র উদ্দেশ্য ছিল। নাটকে বক্তব্যই প্রধান। নিছক আনন্দদান নাট্যকারের উদ্দেশ্য নয়। ফলে সাধারণ দর্শক সমাজের কাছে নাটকগুলি অপ্রিয় হয়ে উঠল। এই বিরূপতার মধ্য দিয়েই নাট্যকারকে নতুন যুগের পথ নির্মাণ করতে হল।
বক্তব্যের দিক থেকে ‘ম্যান এন্ড সুপারম্যান’ নাটকটি উল্লেখ্য। শ’র থিসিসস্বরূপ এই নাটকে জীবনশক্তি বা Life Force বিষয়টি চিন্তা বিশ্লেষণের মধ্যে নিহিত ছিল না, তাকে নাট্যকার প্রায় জীববিদ্যার স্তরে টেনে নিয়ে গেছেন। নাট্যকার বলেছেন ইচ্ছাশক্তি ও জীবনশক্তি—এই উভয়ের যোগে পৃথিবীতে একদিন অতিমানবের (Superman) আবির্ভাব ঘটবে এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
নাট্যকারের ‘ব্যাক টু মেথুসেলা’ (Back to Methuselah) নাটকটির বক্তব্য আকর্ষণীয়। বার্নাড শ’ এখানে ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিবর্তনবাদ’-এর (Theory of Evolution by Natural Selection) প্রতিবাদ করেছেন। দুর্বলকে হত্যার দিয়েই সক্ষমেরা টিকে থাকে ডারউইনের এই মতের প্রতিবাদে শ’ Will Force বা মনের জোরে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। এই মনের জোরেই একদিন উৎকৃষ্ট মানুষ যুদ্ধ ও পাপহীন পৃথিবীকে গড়ে তুলবে। এই-ই হল মিল্টন-কল্পিত ‘প্যারাডাইস রিগেইণ্ড’। ধর্মান্ধতা বনাম দেশপ্রেম নিয়ে শ’ তাঁর বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন ‘সেন্ট জোয়ান’ (St. Joan) নাটকে। এইভাবেই মানব সংসারের সমস্ত ক্ষেত্রেই শুধু তাঁর চিন্তা ও ভাবনা ঘোরাফেরা করে নি, এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর স্পষ্ট বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে তিনি প্রতিটি নাটকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। চিকিৎসা বিভ্রাট, ধ্বনিবিজ্ঞান ও সঠিক উচ্চারণ পদ্ধতি, এমন কি বিবাহ সম্বন্ধেও তিনি তাঁর নিজস্ব বক্তব্যকে নাটকের মাধ্যমে পরিবেশিত করেছেন। ফলে তাঁর নাটকগুলি হয়েছে বক্তব্যপ্রধান (Drama of ideas)I
ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদী বার্নার্ড শ’ প্রথম যৌবনে ছিলেন সমাজবাদী বক্তা ও প্রচারক। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে তৎকালীন মানুষের কাছে অপ্রিয় সমাজতন্ত্রী বক্তব্যই তুলে ধরেছিলেন। নাটকের মধ্যেও আমরা এই সমাজের মঙ্গল চেতনায় প্রবুদ্ধ এই সমাজতন্ত্রী মানুষটিরই পরিচয় পাই। তাই শিল্প নয়, মানুষ ও মানুষের সমাজের মঙ্গলচিন্তাই তাঁর সাহিত্যের কলমকে পরিচালিত করেছে। সমাজ মঙ্গল এষণার কেন্দ্রবিন্দুতেই এক হয়ে মিশে গেছে বক্তা, প্রচারক, উপন্যাসিক, নাট্যকার বার্নার্ড শ’, জ্ঞানবিজ্ঞানের আধুনিক ভাবনায় বিদগ্ধ, সমাজবাদী চেতনায় ভাস্কর, চিন্তাবিদ ও সংগ্রামী বার্নার্ড শ’।
Leave a comment