‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে বাবাজির চরিত্রটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। সৎ আদর্শনিষ্ঠ ভক্ত বৈক্ষ্ণব কর্তামশায়ের বিপরীতে মধুসূদন ভণ্ড লোলুপ ও উৎকোচ গ্রহণে পটু এই চরিত্রটিকে উপস্থাপিত করেছেন। সে কর্তামশায়ের আশ্রিত তার বিশ্বাসভাজন কিন্তু এই বিশ্বাসের মর্যাদাস রাখতে চেষ্টা করেনি। নবকুমার কালীনাথের সঙ্গে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় চলে গেলে কর্তামশায়ের মনে সন্দেহ হয়, এবং তিনি বাবাজিকে পাঠান সিকদার পাড়ায় পুত্র সম্পর্কে যাবতীয় সংবাদ আনার জন্য। এই পটভূমিকায় বাবাজি চরিত্রের আবির্ভাব। পরনে গেরুয়া বসন, গলায় কণ্ঠি হাতে জপমালা, মুখে কৃষ্ণনাম নিয়ে যখন সে সিকদার পাড়ায় উপস্থিত হয় তখন তাকে একজন যথার্থ বৈষ্ণব বলেই মনে হয় কিন্তু একটু পরেই পোষাক পরিচ্ছদের ভড়ং-এর অন্তরালে তার কুৎসিত মনের নগ্ন চেহারাটি ধরা পড়ে যায়। পতিতা পল্লিতে দুই বারবিলাসিনীকে দেখে তার লোলুপ দৃষ্টি প্রমাণ করে দেয় তার ভোগবাসনার গোপন ইচ্ছাটিকে। এই কারণেই পতিতা নারী দুটি তাকে নিয়ে কৌতুক করেছে এবং তাকে ‘কাচাখোলা মোল্লা’ ‘তুলসী বনের বাঘ’ ‘বিড়াল তপস্বী’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেছে।

ধূর্ত এই বৈষ্ণব অতি সহজেই জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়েছে, নবকুমার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য অবগত হয়েছে, কিন্তু আশ্রয়দাতা বন্ধুর বিশ্বাসের মর্যাদাকে ধূলুণ্ঠিত করে দিয়ে নবকুমার কর্তৃক প্রদত্ত উৎকোচ গ্রহণ করেছে এবং কর্তামশাইকে কোনো কিছু না বলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। সেজন্য কালীনাথ এই চরিত্রকে ‘হিপাক্রিট’ বলে অভিহিত করেছে। সে মালাও জপে আবার ঘুষও খায়। ‘হিপাক্রিট’ তার যোগ্য অভিধা। জিতেন্দ্রিয়তার পরিবর্তে ইন্দ্রিয়সুখের আকাঙ্ক্ষা, বৈরাগ্য সাধনার পরিবর্তে অর্থলোলুপত। তার চরিত্রটিকে হেয় এবং হাস্যাস্পদ করে তুলেছে।

বাবাজির বাস্তব জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর। চোর সন্দেহে সার্জেন্ট ও চৌকিদার যখন তাকে ধরেছে তখন তাদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য এবং হাজত বাস এড়ানোর জন্য সে তাদেরকে ঘুষ দিয়েছে। সমকালীন যুগ ও পুলিশ সম্পর্কে তার একটা ধারণা ছিল। সে জানত এদের হাতে পড়লে নিষ্কৃতির কোনো পথ নেই, তাই অর্থ দ্বারা তাদের বশীভূত করার চেষ্টা করেছে।

প্রশ্ন হতে পারে, আলোচ্য প্রহসনে বাবাজির চরিত্রের উপযোগিতা কী ? মধুসূদন তাঁর সমকালে অনেক ভণ্ড বৈঝব দেখেছিলেন যারা বৈষ্ণবীয় নামাবলি গায়ে উড়িয়ে অবৈক্ষ্ণবীয় আচার আচরণে মত্ত হত। ইয়ং বেঙ্গল দলের দামাল ছেলেরা এদের নানাভাবে পর্যুদস্ত করত। পথ চলা বৈষ্ণবদের গলায় রুমালে গোমাংস বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে নানাভাবে মস্করা করা হত। মধুসূদন যেমন ভণ্ড এবং ইয়ং বেঙ্গলদের বিরুদ্ধে শাণিত ব্যঙ্গ বাণ নিক্ষেপ করেছেন তেমনি ভণ্ড বৈষ্ণবরেরা তাঁর বিদ্রুপের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মনে রাখতে হবে সৎ বৈষ্ণবদের মধুসূদন যথার্থ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সেজন্য কর্তামশায়ের চরিত্রে তিনি কোনো কালিমা লেপন করেননি বরং তাঁর চরিত্রকে যথার্থ মর্যাদার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন।

সর্বোপরি, বাবাজির শিকদার পাড়ায় আনার সূত্রে তৎকালীন নগর নটীদের জীবনাচরণের একটি নিখুঁত বাস্তবনিষ্ঠ চিত্র আমরা দেখতে পাই। আরও দেখতে পাই, সমকালীন পুলিশের নির্বোধ কার্যকলাপ ও উৎকোচ গ্রহণের জন্য ব্যগ্রতা। সুতরাং নানা দিক দিয়ে চরিত্রটির উপযোগিতা আছে। চরিত্রটিকে বাদ দিলে প্রহসনটির অঙ্গহানি হত, একথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।