প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে ঝটিক গতিতে খবরের কাগজ ওল্টালেও চোখ আমাদের বিবেকহীন, মানবতাহীন পিতা বা পুত্রের লোভরিপুর অনলে দগ্ধিত কোনো পিতা বা পুত্রের খবর পাই-ই। একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে এই রকম টুকরো খবর – খবর পিপাসু পাঠকের মনের তৃপ্তি দূরের কথা, পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ জাগায়। যে ভারতবর্ষ আমাদের তপোবনের গুরুবাদী দর্শনের, পিতা-পুত্র, মাতা-কন্যা, ভাই-বোন, স্ত্রী, প্রেমিকার প্রেমে সুবাসময়—সেই ভারতবর্ষে আজ এ কি চিত্র! সামান্য টাকা বা দু’বিঘে জমির মালিকানার জন্য হাসিমুখে বা ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে পিতা বা পুত্রের কণ্ঠনালিতে কোপ বসায়। আধুনিক মানবতার নামে অমানবিক এই মনুপুঙ্গবদের দেশে প্রেম, ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। “পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম’র মতো বৈদিক স্তোত্র বাক্যগুলি আজ শুধু উপহাস ছড়ায় মাত্র।

শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি নিঃসন্দেহে আধুনিক যুগের মানবতাহীন সময়ের পটে এক সুবাতাস, এক নতুন ‘হাওয়াটি কি ঝোকা’। সম্রাট বাবর তার রাজকীয় মহিমা, প্রবল প্রতাপ, রাজ্যজয়ের নেশা ভুলে আজ নিরাকার ঈশ্বরের পায়ে সর্বস্ব সমর্পণ তথা নিজেকে সমর্পণ করেছেন। বাবরের বিপুল ঐশ্বর্য তার সাম্রাজ্যের বিপুল প্রদীপ্ত বিভা তাঁর কাছে মূল্যহীন। একজন ভিখারীর মতন বাবর ঈশ্বরের পায়ে মাথা কুটে নিজের কৃতপাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। এই দৃশ্য সত্যিই অন্য কোনো সদাগরী বাজারে বিক্রি না হলেও মানবতার বাজারে রেখে যায় অমলিন পাকা স্থান। বাবর নির্দ্বিধায় ঘোষণা করছেন তার কৃত-পাপকর্মের জন্য অন্য কেউ নয়—তিনি নিজেই দায়ী। তার সন্তানের অসুস্থতার জন্য তারই পূর্বকর্ম দায়ী, অর্থাৎ সুদূর কান্দাহার থেকে রাজ্যজয়ের নেশায় নিজে কত রাজা, প্রজা, পিপড়ের মতো সারি সারি নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হত্যা করেছেন। সেই কাজের ফল পেতে হচ্ছে তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে। ঈশ্বরের এই বিধান তিনি মানতে নারাজ। বাবর একজন পিতা। তাঁর সন্তানের প্রতি রয়েছে অবর্ণনীয় অপত্যস্নেহ। তাঁর সন্তানের জন্য তিনি নিজের প্রাণ, রাজ্য, রাজ্যের সমস্ত কিছু নিপাত দিতে পারেন—এত বড়ো ত্যাগ আমরা বাবরের হৃদয়ে, যে হৃদয় একদা লাখ-লাখ মানুষকে খুন করেছে, জখম করেছে তার হৃদয়ে এত ত্যাগ, এত পুত্ৰ স্নেহ দেখে প্রথমত অবাক হলেও যখনই বাবরকে একজন পিতা হিসেবে দেখি তখন মানতে আর কোনো বাঁধা থাকে না। একজন পিতৃত্বের দৃষ্টিতে বাবরের জয় ঘোষিত হয়। অন্নদামঙ্গলকাব্যে ঈশ্বরী পাটনীর প্রার্থনার মতোই বাবর তার পুত্রের সুখের জন্য নিজের পরমায়ু উৎসর্গ করছেন। ঈশ্বরী পাটনী কখনোই তার জীবনের বিনিময়ে তার সন্তানের দুধভাত চাননি। বাবর যেন মানবিকতার এই লড়াইয়ে অনেক উঁচুতে অবস্থান করছেন।

তাই বলতে বাধা থাকে না, শঙ্খ ঘোষের উপলব্ধিজাত পিতা বাবর এক নতুন বাবর, যে বাবরের অন্তঃস্থলে বহমান পুত্র প্রেমের গঙ্গা-ভাগীরথ। আধুনিক সমস্যমান যুগ জটিলতায় যখন আমরা হৃদয়ের প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, মায়ের স্নেহ, পিতার ভালোবাসা একেবারে ভুলতে বসেছি, তখন সন্দেহ নেই ‘বাবরের প্রার্থনা, আমাদের চেতনায় নিয়ে আসে এক নতুন ভালোবাসার স্রোত, নতুন গীতি মূর্ছনা। দুর্দশা, সমস্যাগ্রস্ত পৃথিবীতে আত্মীয় স্বজন-সুজনের কোমল রন্দ্রগুলো যখন প্রায় শূন্য হয়ে যাচ্ছিল—সেই সময়ে শঙ্খ ঘোষের এই কবিতা মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ‘জেন্টল বাম্’।