‘বাবরের প্রার্থনা” কবিতাটির প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক জীবন কাহিনি। ১৫২৯ সালে মোঘল সম্রাট বাবর গোগরার যুদ্ধে বাংলা বিহারের আফগান রাজশক্তিকে পরাজিত করে নিজে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিলেন। রাজ্যবিজয়ের আনন্দ ও উন্মাদনায় তিনি যখন মাতোয়ারা ঠিক সেই সময়টিতেই খবর আসে তাঁর ২১ বছরের সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত পুত্র হুমায়ুন অত্যন্ত অসুস্থ। রাজ্যবিজয়ের সমস্ত আনন্দ নিমেষে ম্লান হয়ে যায় সম্রাটের কাছে। আল্লাহর কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্র হুমায়ুনের জীবন প্রার্থনা করেন বাবর। কথিত আছে, এই ঘটনার পরে পুত্র হুমায়ুন নবজীবন লাভ করলেও সম্রাট বাবর মৃত্যুমুখে পতিত হন।

কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার বিশ্লেষণ সম্পর্কে একটি কথাই সর্বাগ্রে মনে আসে। ‘তোমার কোনো ধর্ম নেই আর/শিকড়টাকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া’। ঐতিহ্যের প্রথানুগ এবং কালানুক্রমিক বিশ্লেষণের আর্তি, পরম্পরাগত বিকাশের সঙ্গে লগ্ন করে শঙ্খ ঘোষ যেমন বিন্যস্ত করেন। তেমনটি বোধ হয় আধুনিকের আর কারো রচনায় পাওয়া সম্ভব নয়। অতীত ঐতিহ্যের প্রতি এমন বিরল নিষ্ঠা ছিল বলেই ইতিহাসের পরম্পরাগত অবকাশ অনেকক্ষেত্রেই তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটির পশ্চাতেও বাবরের শেষজীবন ও তাঁর মৃত্যু সম্পর্কিত কাহিনিটি রূপকথার ন্যায় বিন্যস্ত। আবুল ফজল বর্ণিত ঐতিহাসিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে, “But Babur was not destined to enjoy for long the fruits of his hard won victories. He died Agra at the age of forty seven or forty eight, on the 26th December, 1530. The Muslim historians relate a romantic anecdote regarding his death. It is said that when son Humayun fell ill, Babur, by a fervnent Prayer to God, had his son’s desease transferred to his own body, and, thus while the son began to recover, the father’s health gradually declined till he ultimately Succumbed two or three months after Humayun recovery.”

ঐতিহাসিক এই কাহিনিতে, সম্রাট বাবরের সন্তুতির জন্য আকুল প্রার্থনাকে উপজীব্য করেই কবি শঙ্খ ঘোষ নিজের সন্ততির জন্য প্রার্থনায় উন্মুখ হয়েছেন। বিশ্বনিয়ন্ত্রার কাছে প্রার্থনা জানাতেই তিনি আজ পশ্চিমের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছেন। আসলে ব্যক্তি কবির‌ আত্মচিন্তা ও সম্রাট বাবরের ঐতিহাসিক ঘটনার অনুপুঙ্খ অবলেশ কোনো এক অদৃশ্য সম্পর্কসূত্রে গ্রথিত হয়ে যায়, যখন দেখি প্রিয় কন্যার লাবণ্যহীন মুখ, শীর্ণ রোগগ্রস্ত দুটি চোখের কোণে পরাভবের কালো আঁধার ঘনীভূত। একই সঙ্গে ডাক্তারের অসহায়তা। ভালো করে ধরতে পারছেন না তিনি অসুখটা কোথায় ? ঠিক সেই মুহূর্তটিতেই সন্তানের আরোগ্য কামনায় বাবরের আত্মদানের মহতী ভাবনা কবির মনে আসে। অবশ্য শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের এই অসহায়তাই নয়, অনুজের জন্য আত্মজের জন্য, ভবিষ্যত প্রজন্মের দিশাহীন নীরব অবক্ষয়ের জন্যও কবির প্রার্থনা ভাষামূর্তি পেয়েছে কবিতাটিতে।

বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের অধীশ্বররূপে নয়, সম্রাট বাবর তার পিতৃসত্তার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন আত্মজের রুগ্নতাকে নিজ শরীরে ধারণ করে। ঐতিহাসিক কাহিনির প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র পিতৃসত্তার দ্বন্দ্বময় আর্তিটিকেই মনে রেখেছিলেন কবি। তাই সমকাল, ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক-সামাজিক টানাপোড়েনের সঙ্গে সঙ্গে প্রজন্মবাহিত অবক্ষয় কবিকে প্রাণিত করেছিল সন্ততির সুস্থতা ও আরোগ্য কামনায়। নিজের জীবন বিপন্ন করেও সন্ততিকে সুস্থ দেশ-কাল, নীরোগ শরীরের উজ্জ্বল প্রাণময় রূপ ফিরিয়ে দিতে চান তিনি। কবি অনুভব করেছেন দেশের তরুণ সম্প্রদায় যাদের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে একটি উজ্জ্বল ভারত, তাদের স্বচ্ছ সুন্দর যৌবন আজ অপসৃয়মান। কোনো এক গোপন ক্ষয়ে জীবনের সমস্ত প্রবাহ যেন স্তব্ধ করে দিতে চায় তাদের তারুণ্য। জীবনের সমস্ত পরাভব তাদের চোখের কোণে বিছিয়ে দিয়েছে অন্ধকারের ছায়া। বসন্তের সমস্ত শূন্যতার মাঝখানে, ধূসরতার বিবর্ণ প্রেক্ষিত জুড়ে কবি আজান গানকে গীত হতে দেখতে চান। কারণ আজান গান আসলে প্রার্থনার সাঙ্গিতিক আবহ রচনা করে। পশ্চিম দিগন্তে আজানের সুর ধ্বনিত হোক এমনটাই চেয়েছিলেন কবি। কারণ এই আজানের সুরই সম্রাট বাবরকে এনে দিয়েছিল সন্ততির সুস্থ জীবন। কবি ভেবেছেন তার শরীরে, রক্তকণায় হয়তো এতদিনের নিরন্তর পাপ বীজাণু হয়ে সুপ্ত ছিল। নানা সামাজিক রাজনৈতিক জয়ের বর্বর উল্লাসে আজ সেই বীজাণু পরবর্তী প্রজন্মের রক্তকণায় ছড়িয়ে গিয়ে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল সম্রাট বাবরের ক্ষেত্রে। জয়ের আনন্দে উদ্বেল হয়ে বিলাসিতার প্রবল প্রশ্রয়েই যেন উৎসবের আলোর ঝলকানি ব্যাধিগ্রস্ত সংখ্যাহীন ভয়ঙ্কর পতঙ্গকে ঘরে ডেকে এনেছে। তাইতো কবির দ্বিধাহীন স্পষ্ট উচ্চারণ –

“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম

আজ বসন্তের শূন্য হাত

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও 

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”

সাম্রাজ্য জয়ের প্রবল আনন্দে উল্লসিত বাবর প্রাসাদ শিখরে যে বিলাসিতার ভোগ্যপণ্যে নিমজ্জিত হয়েছিলেন, সেই অবিলতাই মৃত্যুবাহী পতঙ্গের নির্মম আবির্ভাব হয়ে নিজের সন্ততির শরীরে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছিল।

“নাকি এ প্রাসাদের আলোর ঝলসানি

পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়

এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে

লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের।”

বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হওয়ার পরও যেমন বাবরের পক্ষে সন্তান হুমায়ুনের যন্ত্রণা সহ্য করা অসম্ভব, আর প্রিয় পুত্রের মৃত্যু তো আরও বেশি দুর্বিষহ এবং কল্পনাতীত। পিতা তার উত্তরাধিকারীর জন্যই এই পৃথিবীর যাবতীয় অর্জন সঞ্চিত করে রেখে যান। বাবরের এই প্রভৃত সম্পদ, সাম্রাজ্যবিস্তারের দুর্নিবার বাসনা তো উত্তরাধিকারীর জন্যই। কিন্তু হুমায়ুনের এই ব্যাধিগ্রস্ত দেহ, ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পিছনে সম্রাট বাবর কীভাবে যেন প্রভূত জয়ের পিছনে পরাজয়ের নির্মম ভ্রুকুটির অনিবার্য ফল লক্ষ করেছিলেন। বুঝেছিলেন সন্তানের মৃত্যু কতখানি দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তার জন্য। আল্লার কাছে তাই তার নিঃশর্ত আকুতি,

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর 

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটিতে একটি আত্মবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু এই আত্মবিসর্জন সে সফল হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না। একটি দ্বান্দ্বিক আবহ যে রয়েছে একথা বলা যায়। কারণ এই অপরাধ বা পাপ ব্যক্তির দ্ব্যর্থসীমায়, বিচ্ছিন্নতায়, এবং আত্মমগ্নতায় নিবদ্ধ। একক সুখের নিশ্চিন্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষায় উৎপন্ন যে পাপ সেই পাপ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন কবি সকলের সঙ্গে মিশে, এক যৌথ জীবন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায়। কবিতাটিতে নামাজের আজানের অনুসরণ দেখানো হয়েছে। যে আল্লার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ছেন বা আজান গানে আকাশ ভরিয়ে তুলছেন তার জীবনের বসন্তদিন আজ শূন্য হয়ে গেছে। ঈশ্বরের কাছে জানু পেতে রসে নিজের সন্তান, এই দেশ-কাল-সমাজ সংসারের প্রতিটি তরুণ প্রাণের জন্য নিজের সবকিছু উজার করে দিতে চান তিনি। এই সন্তান যেমন মানুষের অস্তিত্ব বা বংশ পরম্পরার ধারণা ঠিক তেমনি অজস্র তরুণ প্রাণ, (এই দেশ, এই কাল যার শরীরে পাপের বীজাণু ছড়িয়ে দিয়েছে) সেও পূর্বসূরির ঐতিহ্য পরম্পরার ধারক। তাই শুধুমাত্র সন্তানের সীমায়িত ধারণায় নয়, পরবর্তী মানুষ ধরার জন্য, নিজের চিন্তা, সাধনা, সময়কে ধরে রাখবার আর্তিতেই নিজের জীবন বিসর্জনের এমন আকাঙ্ক্ষা। আত্মলোপের এই শপথ যার জন্য নিয়েছেন কবি অথবা সম্রাটরূপী বাবর, তার স্বচ্ছ যৌবন বিনষ্ট। পরাভবের গ্লানি ও ক্ষয় তার জীবনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ফুসফুস ধর্মনী-শিরা যার বিষিয়ে উঠেছে।

কবিতাটির অন্তিম অংশে সম্রাট বাবর তথা কবি, সর্বোপরি ভারতের সমকালীন প্রেক্ষিতের সকল প্রাজ্ঞ মানুষের মনে একই প্রশ্ন জাগে। কেন এই ক্ষয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের সমস্ত স্বপ্ন, তাদের জীবন যৌবন কেন এই ব্যর্থতার চোরাবালিতে হারিয়ে গেল। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আরও একটু পিছিয়ে যেতে হয়, মনে পড়ে মধুসূদনের সেই বিখ্যাত উক্তিটির কথা—‘মরে পুত্র জনকের পাপে’ সম্রাট বাবরের শরীরের পাপ না ঐশ্বর্যের পাপ পুত্র হুমায়ুনের জীবন দীপ নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, তবে একটি স্ববিরোধ তিনি প্রকৃতিগত ভাবেই সম্রাট সত্তার পরতে পরতে লালন করেছিলেন। নিজের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য, নিজের পুত্রকে রক্ষার জন্য মসজিদের নতজানু প্রার্থনা গান উচ্চারণ করলেও সহস্র সহস্র প্রাণ সংহারের নির্মম খেলায় যুদ্ধক্ষেত্র রক্তাক্ত করেছেন তিনি। ষড়যন্ত্র করেছেন গোপনে। ওই মৃত্যুই যেন ফিরে ফিরে আসে পূর্বসূরি থেকে উত্তরসূরিতে এক প্রজন্ম থেকে অন্যপ্রজন্মে।

“না কি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে 

কোনোই প্রাণ নেই ভবিষ্যের ?

আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে 

মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে এ”

বাবর নিজে এ প্রশ্নের উত্তর জীবিতকালে পাননি। কিন্তু একথা অনুভব করেছিলেন সম্ভান যদি না-ই থাকে, তাহলে সকল ঐশ্বর্যই অর্থহীন বিড়ম্বনা। তাই নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েও পুত্রের মানুষের জীবন ও স্বপ্নকে জাগিয়ে রাখতে চাইছেন তিনি। এই যে আত্মবিলোপ, পরবর্তী প্রজন্মের মাটিকে শক্ত করে দেবার জন্য এই যে আত্মঅবক্ষয়, এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ব। কবিতাটির আঙ্গিকে মনুষ্যত্ব বোধের চরম পূর্ণতাকে বাবরের দ্বন্দ্ব বিক্ষত জীবন পরিক্রমায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কবিতাটির নিবিড় পাঠে সমকালীন দেশীয় অবক্ষয়ের চোরাস্রোত-নকশাল আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তগুলির অবলেশও ভীষণভাবে ক্রিয়াশীল। কিন্তু মানুষের হিতকর কার্যে আত্মবিসর্জনের যে মর্মান্তিক অথচ মনুষ্যত্বপূর্ণ ঐকান্তিক প্রেরণা তা ইতিহাসনিষ্ঠ সম্রাট চরিত্র বাবরের প্রার্থনায় সম্পূর্ণ ও অখণ্ড হয়ে উঠেছে। ইতিহাস চেতনার এমন সর্বব্যাপী প্রসারণে কবিতাটি আমাদের অতীত ঐতিহ্যেরও সার্থক প্রেরণা হয়ে উঠেছে একথা বলা যায়।