ইতিহাস ও কল্পলোকের মিশ্রণে কবি শঙ্খ ঘোষ সৃষ্টি করেছেন এক কল্পজগৎ। বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটির বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে কবির সেই কল্পজগতের পরিচয় দাও।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় এক ঐতিহাসিক কিংবদন্তীর প্রচ্ছদে সমকালীন বেদনারক্তিম এক বাস্তবতাকে কিভাবে উপস্থিত করেছেন তা বিশ্লেষণ কর।

‘কবি তব মনোভূমি

রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”

কবি ও শিল্পী ইতিহাসের কাহিনীকে সৃষ্টি করেন নতুনভাবে তাঁর মনের জগতে; ইতিহাস ও কল্পলোকের মিশ্রণে গড়ে ওঠে স্রষ্টার সেই সৃষ্টিজগৎ। সেই সৃষ্টিজগৎ কোন বাস্তব ইতিহাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় না বলেই তা চিরন্তন সত্যের উদ্ভাসনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কবির মনোভূমিতেই জন্ম নেয় চিরন্তন সত্য যা ইতিহাসের চেয়েও সত্য। ঐতিহাসিক সত্য বৃত্তান্তের সঙ্গে কাল্পনিক আখ্যায়িকা প্রথিত করা যেতে পারে, সেই আখ্যায়িকা ঐতিহাসিক না হলেও কোন ক্ষতি নেই, কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে তা যেন সেই যুগের পক্ষে অসম্ভাব্য বা অবিশ্বাস্য না হয়। কল্পনার অবাধ গতির দ্বারা ইতিহাসের পুরাতন বৃত্তান্তের মধ্যে অতিরঞ্জন এসে পড়া স্বাভাবিক : সাধারণ জিনিষেও একটু রঙ চড়িয়ে দিয়ে তাকে বর্ণাঢ্য করে তুলতে হয়। এগুলির মধ্যে বর্ণিত ঘটনা ও চরিত্রগুলি বাস্তব ইতিহাসের দিক থেকে সত্য বলে লেখকের বর্ণনাগুণে গভীরভাবে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। ইতিহাসের সঙ্গে রোমান্টিসিজমের সহজ মিশ্রণের ফলে কাব্য রসাস্বাদ্য হয়ে ওঠে। কল্পনাবৃত্তির অসাধারণ বিকাশক্ষমতাই যে পাঠকচিত্তকে মুগ্ধ করে, একথা মনে রেখে কবি শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটির রসাস্বাদন করাই সমীচিন।

জীবনমনস্ক, ইতিহাস-রসিক কবি শঙ্খ ঘোষ নিরাসক্ত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে বাবরের নামে প্রচলিত কিংবদন্তীকে অবলম্বন করে কবিতা রচনা করেছেন। তিনি যেন নিজেই হয়েছেন ইতিহাসের নায়ক। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি নিজেই হয়েছেন বাবর একমাত্র পুত্রের স্নেহশীল পিতা। তাই সমগ্র কবিতাটি রচিত হয়েছে বাবরের জবানীতে উত্তম পুরুষের বাক্যবিন্যাসে – 

এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম

আজ বসন্তের শূন্য হাত। 

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের মৃত্যু সম্পর্কে ঐতিহাসিকের সূত্র সন্ধানে জানা যায়, “Babur died at Agra at the age of forty seven or forty eight, on the 25th December, 1530. The Muslim Historians relate a romantic anecdote regarding his death. It is said when Humayun fell ill, Babur by a fervent prayer to God, had his son’s disease transferred to his own body, and thus while the son began to recover, the father’s health gradually declined till he ultimately succumbed two or three months after Humayun’s recover.”-Advanced History of India Mazumder Roychoudhury and Dutta,

আবুল ফজলের বর্ণিত সম্রাট বাবরের জীবন ইতিহাসের অন্তিম সময়ের ঘটনাকে অবলম্বন করে। ঐতিহাসিকগণ তথ্যের ভিত্তি পেয়েছিলেন; বাবরের আত্মজীবনীতেও অনুরূপ তথ্যের সমর্থন পেয়েছেন তাঁরা। কথিত আছে, বাবর ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে গোগ্রার যুদ্ধে বাংলা ও বিহারের সমবেত দুর্ধর্ষ আফগান শক্তিকে পরাজিত করেন। জয়ের উল্লাসে প্রমত্ত হয়ে সম্রাট প্রাসাদে ফিরে আসেন রোশনাই এর মধ্য দিয়ে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে করতে। প্রাসাদে এসে দেখেন—তাঁর একমাত্র পুত্র তরুণ ও কাস্তি সম্পন্ন হুমায়ুন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত—বাঁচার কোন লক্ষণই নেই। চিকিৎসক, হাকিমদের কাছে পুত্রের রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনার কোন ইঙ্গিত পেলেন না। বিজয়ী সম্রাট বাবরের মনে তখন দুশ্চিন্তার করাল ছায়া; তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রের জীবনভিক্ষায় আল্লাহর দোয়া প্রার্থনা করেন। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় দেখা গেল, পুত্র হুমায়ুন ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন এবং পিতা বাবর কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলেন। সেই পীড়ায় বাবরের মৃত্যু হয়।

বাবরের মৃত্যু সম্পর্কিত কাহিনীটি ইতিহাস অপেক্ষা অবিশ্বাস্য এক রোমান্সের জগতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; কাহিনীটির ভিত্তি যা-ই হোক না কেন, পরবর্তীকালে যে বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে লোকপ্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। অনেক সময় প্রচলিত লোকপ্রসিদ্ধি ইতিহাসের ঘটনাকেও অবলীলাক্রমে অতিক্রম করে যায়।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি পুত্রের রোগমুক্তির কামনায় বাবরের পিতৃসত্তার আকুতিটিকে নিপুণ তুলিকায় অঙ্কন করেছেন। কবিতাটিতে ইতিহাস নয়— ইতিহাসের একটি ছবি তার নিজস্ব রঙে প্রকাশিত হয়েছে। পুত্র হুমায়ুনের রোগশয্যায় বসে করুণাময় আল্লাহর নিকট পশ্চিমমুখী হয়ে জানু পেতে প্রার্থনা জানাচ্ছেন। অসুস্থ পুত্রের রোগমুক্তির কামনায় তিনি যেন আল্লাহর নিকট প্রাণ-মন সমর্পণ করেছেন— নিজের জীবনের বিনিময়ে পিতা ভিক্ষা চান তাঁর একমাত্র সন্তানের রোগমুক্তি। সম্রাট বাবর এখানে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নন–যোদ্ধা নন-বীর নন। এখানে তিনি কেবল পিতা–অসুস্থ পুত্রের সুস্থ পিতা; যে পিতা নিজের সুস্থতাকে বিসর্জন দিতে চান পুত্রের অসুস্থতার আরোগ্যের জন্য। সন্তানবৎসল পিতৃ-হৃদয়ের একান্ত আপন প্রার্থনাটি যেন অদৃষ্টের কঠিন পাষাণে প্রতিধ্বনিত হয়ে ইতিহাসের পটভূমিকায় অপূর্ব এক জীবন-সংগীত রচনা করেছে।

শীতের রিক্ততায় বসন্তের হাত শূন্য-বসন্ত এখনো আসেনি তার কচি কিশলয় নিয়ে। প্রকৃতির দিকে দিকে জীর্ণতা ও শীর্ণতার রিক্ততা। পিতা তাঁর স্বপ্নকে রূপায়িত করতে চান পুত্রের মধ্য দিয়ে তাই পুত্রের জীবন পিতার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রের আরোগ্যের বিনিময়ে নিজেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিতে প্রস্তুত। তাঁর ব্যাকুল প্রার্থনা—‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর’; এর পরিবর্তে তিনি চান সন্তানের রোগমুক্তি—’আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’ পুত্রের জীবন যেন স্বপ্নের কামনার মধ্য দিয়ে আনন্দ ও শান্তি লাভ করে।

পুত্রের স্বচ্ছ-উদ্ভাসিত যৌবন আজ রোগজর্জরিত: জীবনের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। গোপন ক্ষয় তার জীবনকে পোকার মতো কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে, জীবনের পাঁপড়ি-দল পাণ্ডুর ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। চোখের কোণে কালিমার আভাস, জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের যেন নিদর্শনচিহ্ন। তার ফুসফুস-ধমনী-শিরায় বিষক্রিয়ার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ; সমস্ত দেহ যেন জীবনীশক্তির অভাবে বিষগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাঁচার আর কোন সম্ভাবনাই নেই একমাত্র আদরের পুত্র হুমায়ুনের। ‘কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন’ কথাটির মধ্য দিয়ে পিতৃহৃদয়ের অব্যস্ত নির্বাক বেদনা এবং সংহত ভাবগম্ভীর মূর্তি লাভ করেছে।

শহরের প্রান্তে ও প্রান্তরে আজ জেগে উঠুক ধূসর শূন্যের আজান সংগীত; সেই আজানের আহ্বানে আল্লাহ যেন তাঁকে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিশ্চল পাষাণ করে দেন এবং তাঁর পুত্রকে সুস্থ করে স্বপ্নময় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মানুষের শরীরে আছে জন্ম পাপের জীবাণু : এই জীবাণুর সংক্রমণে জন্ম জন্ম ধরে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা আক্রান্ত হয় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ভবিষ্যতের পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। যে বর্বর জয়ের উল্লাসে বর্তমান কাল অভিনন্দিত, সেই জয়ের উল্লাসই অনাগতকালে মৃত্যুর শোচনীয় পরিণতি ডেকে আনে। বিক্রমের নিষ্ঠুরতার রন্দ্রপথ দিয়ে যে পাপ প্রবেশ করে, সেই পাপই ভবিষ্যৎ বংশধরদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। এই তো মানবেতিহাসের নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডি।

বিজয়ের পর প্রাসাদে চলে বিজয়োল্লাসের প্রতীক আলোর রোশনাই, আর আলোর রোশনাইতে কত শত পতঙ্গ পুড়ে মরে। তেমনি ভোগসুখের অজস্র উপকরণে সজ্জিত রাজপ্রাসাদের বিলাসিতার পরিণতিতে আসে নিশ্চিত ক্ষয় ও মৃত্যুর বিভীষিকা; সেই বিভীষিকায় যেন সমস্ত হৃদয়-হাড় পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ পতঙ্গ পুড়ে মরার মধ্য দিয়ে জীবনের নিষ্ঠুর ট্র্যাজিক রূপটি প্রকাশিত হয়েছে।

রাজ্যজয়ী পিতার হাতে এত ঐশ্বর্যের সম্ভার অথচ সেই পিতার একমাত্র পুত্র আজ মৃত্যুশয্যায়—রোগযন্ত্রণায় কাতর ও দীর্ণ। তাই সন্তানবৎসল পিতৃহৃদয়ের প্রার্থনা—দয়াময় আল্লাহ তাঁকে ধ্বংস করে দিয়ে তাঁর পুত্রকে আরোগ্যের মধ্য দিয়ে শাস্তিতে প্রতিষ্ঠিত করুন। অর্থাৎ অতীতের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যেন প্রতিষ্ঠিত হয় অনাগত ভবিষ্যতের স্বাচ্ছন্দ্য। পুত্র হুমায়ুনের জীবনে আসুক সেই স্বাচ্ছন্দ্যের অভিব্যক্তি।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতার ভাববস্তুটি যেমন অন্তরঙ্গ, তেমনি তার প্রকাশভঙ্গিটিও অনবদ্য। কবি শঙ্খ ঘোষ ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে সংগ্রহ করে এনেছেন জীবনের রস; ঘটনা ও তথ্যের মধ্য থেকে সনাতন হৃদয় সম্ভারে তিনি আবিষ্কার করেন জীবনের তাৎপর্য। ইতিহাসের উচ্ছ্বাস ও কলরব যেখানে মূক, সেখানে তিনি শুনতে পান মানব-হৃদয়ের গুঞ্জন—অকথিত বাণীকে প্রকাশের হিরণ্য-দৃতির সাহায্য নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন কল্পনার রাজ্যে এক মগ্ন-চৈতন্যের জগৎ। ইতিহাস চেতনা ও ঐতিহ্যানুসৃতির মধ্য দিয়ে কবি যে জগৎ সৃষ্টি করেন, তা একদিকে যেমন ইতিহাস,তেমনি আবার কল্পলোকও বটে। ইতিহাস ও কল্পলোকের মিশ্রণে রচিত হয় কবির এক নতুন সৃষ্টি—তা যে ইতিহাসের চেয়েও অধিকতর সত্য। কবি শঙ্খ ঘোষ সেই সত্যকে চিত্রায়িত করেছেন তার অপূর্ব সৃজনী প্রতিভার সাহায্যে।

কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ইতিহাসাশ্রিত কবিতায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। প্রায় প্রতিটি কবিতায় তিনি ইতিহাসের সঙ্গে যেন নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছেন। কবি নিজেই যেন ইতিহাসের চরিত্র হয়ে গেছেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষকেই যেন তাঁর রোগশয্যায় শায়িত পুত্রের পাশে বসে প্রার্থনা করতে দেখি। ইতিহাস এখানে তার বর্ণবহুল বিন্যাস নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় না—ইতিহাসের ঘটনা মুক্ত হয়ে যায়; তার পরিবর্তে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ইতিহাসের প্রাণস্পন্দন। কেবল অতীত ইতিহাসের ক্ষেত্রে একথা সত্য নয়—সমকালীন ঘটনার ইতিহাস নিয়ে যেমন ‘ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড’, ‘ঢাকা ১৯৭৫’ প্রভৃতি কবিতায় আমরা দেখি কবির লেখনীতে ইতিহাসের প্রাণস্পন্দন।

কবি শঙ্খ ঘোষ নির্জনতার কবি-শান্তির কবি-কল্যাণের কবি। তিনি নগরের কোলাহল থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখতে চান, তিনি চান বোধি ও মননের জগতে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে। বোধি ও মননের জগতে তিনি প্রত্যক্ষ করতে চান এক চিরন্তন সত্যকে সে সত্যের ভিত্তি মানব হৃদয়ের গভীরে। তিনি আকাশের নীলিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন শান্তির প্রার্থনায় সত্যের অন্তরঙ্গ স্বরূপের প্রতিষ্ঠায়। সম্রাট বাবর যেমন একমাত্র পুত্রের রোগমুক্তির প্রার্থনায় প্রাসাদের বিলাসবহুল কোলাহলময় রোশনাই-এর উল্লাস ত্যাগ করে পশ্চিমদিকে মুখ করে আকাশের দিকে ধ্যানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন; কবি শঙ্খ ঘোষের যেন সেই ধ্যানী দৃষ্টি।